বিশ্ববাজারে কমলেও দেশের বাজারে বাড়ছে চিনির দাম
বিশ্ববাজারে কমলেও দেশের ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য চিনির দাম আবারও বেড়েছে। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারি পর্যায়ে পণ্যটির দাম মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) ১৫০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, মাঝখানে কিছুদিন উর্ধ্বমুখী থাকলেও আন্তর্জাতিক বাজারে এখন নিম্নমুখী চিনির দাম। কিন্তু দেশীয় আমদানিকারকরা সবাই একযোগে কারসাজি করে পণ্যটির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। যে কারণে গত এক থেকে দেড় মাসে পণ্যটির দাম মণে প্রায় ৪০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে।
তবে আমদানিকারকদের দাবি, আন্তর্জাতিক বাজারে কম দামে বুকিং করা পণ্য এখনো বাজারে আসেনি। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বুকিং দিয়ে অপরিশোধিত চিনি এনে তা পরিশোধন করে বাজারে আসতে আড়াই মাসের বেশি সময় লাগে। ফলে দেশিয় বাজারে চিনির দাম এখনো কমেনি।
এছাড়া, ডলারের দাম বৃদ্ধি ও নিয়ন্ত্রিত শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ বাড়িয়ে পূর্বের ন্যায় ৩০ শতাংশ করায় আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও দেশীয় বাজারে পণ্যটির দাম কমছে না বলে মনে করছেন তারা।
দেশের বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে, বর্তমানে পাইকারি পর্য়ায়ে প্রতিমণ (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) চিনি বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ২০০ টাকা দামে, যা দুই সপ্তাহ আগে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সেই হিসেবে, গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে চিনির দাম বেড়েছে মণে ১৫০টাকা। এর আগে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত বাজারে মণপ্রতি চিনির দাম ছিল ২ হাজার ৭৫০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা।
এদিকে, বৃহস্পতিবার (২২ সেপ্টেম্বর) চিনির দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। নির্ধারিত দাম অনুযায়ী আগামী রোববার (২৫ সেপ্টেম্বর) থেকে খোলা চিনির সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৮৪ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনির সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৮৯ টাকায় বিক্রি হবে।
বর্তমানে খোলা বাজারে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকায়।
খাতুনগঞ্জের চিনি ব্যবসায়ী মেসার্স ইসমাইল ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, "সরকার খুচরা পর্যায়ে চিনির যে দাম নির্ধারণ করেছে, তার চেয়েও বেশি দামে চিনি বিক্রি হচ্ছে পাইকারি বাজারে। সরকার খুচরা পর্যায়ে খোলা চিনির দাম নির্ধারণ করেছে ৮৪ টাকা। কিন্তু পাইকারিতে প্রতিমণ চিনি বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ২০০ টাকায়। অর্থাৎ প্রতিকেজি চিনির দাম পড়ছে ৮৫ টাকা ৭৫ পয়সা।"
এতে ব্যবসায়ীরা আমদানিকারক ও কারখানা মালিকদের কাছ থেকে চিনি কিনে তা বাজারে বিক্রি করতে লোকসানে পড়বে বলে মনে করছেন আব্দুর রাজ্জাকসহ বাজারের চিনি ব্যবসায়ীরা।
সিটি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক (কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, "জুন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী চিনির দাম বাড়তি থাকায় আমদানিনির্ভর দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কিছুটা সংকটে রয়েছে। তাছাড়া, বর্তমানে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও ১০ শতাংশ মওকুফ করা শুল্ক পুনর্বহাল হওয়ায় আমদানি খরচ বেড়েছে। যে কারণে আমদানিকৃত পণ্যটির বাজার এখন উর্ধ্বমুখী রয়েছে।"
চিনি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স আরএম ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী আলমগীর পারভেজ জানান, বিশ্বের প্রধান চিনি উৎপাদন ও রপ্তানিকারক দেশ ব্রাজিলে চিনির উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। যার কারণে রপ্তানিতে কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ করেছে দেশটি।
"তাছাড়া বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকটের কারণে বিকল্প উৎস থেকে জ্বালানি উৎপাদন প্রবণতায় পাম অয়েলের পাশাপাশি চিনির ওপরও প্রভাব পড়েছে। যে কারণে চিনির আমদানি ও সরবরাহ কিছুটা কছে," যোগ করেন তিনি।
চট্টগ্রাম কাস্টমস'র তথ্যমতে, গেল অর্থবছরে (২০২১-২২) চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মাত্র ১৭ লাখ টন চিনি আমদানি হয়েছে। এর আগে, ২০২০-২১ অর্থবছরে চিনি আমদানি হয়েছিল ২১ লাখ টন। এক বছরের ব্যবধানে ৪ লাখ টন চিনি কম আমদানি হওয়ায় সরবরাহ সংকটে পড়েছে দেশের প্রধান বেসরকারি রিফাইনারি মিলগুলো; পাশাপাশি দামও বেড়েছে।
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন (বিএসএফআইসি) ২০২১ সালের ৬ এপ্রিল চিনির দাম ৭০ টাকা থেকে ৫ টাকা বাড়িয়ে ৭৫ টাকা নির্ধারণ করে। সবশেষ, ১০ আগস্ট বেসরকারি মিল মালিকদের অ্যাসোসিয়েশন সরকারের কাছে চিনির দাম পুনর্নির্ধারণের আবেদন করে। মূলত বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়া, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এবং প্রত্যাহার করা শুল্ক সুবিধা উঠে যাওয়ায় দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মিল মালিকরা। সেই চিঠির প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার চিনির দাম নির্ধারণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বর্তমানে দেশে চিনির চাহিদা প্রায় ১৮ থেকে ২০ লাখ টন। দেশীয় চাহিদার মধ্যে সরকারি মিলগুলো একসময় দেড় থেকে দুই লাখ টন চিনি উৎপাদন করত। তবে সর্বশেষ দুই বছরে ১৫টি সরকারি চিনিকলের মধ্যে ছয়টির উৎপাদন বন্ধ থাকায় উৎপাদন যথাক্রমে ৪৮ হাজার টন ও ২৫ হাজার টনে নেমে এসেছে। যে কারণে দেশের চিনি খাতটি এখন প্রায় শতভাগ বেসরকারি মিলগুলোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।