ভোগ্যপণ্য: বিশ্ববাজারে দাম ও জাহাজ ভাড়া কমলেও প্রভাব নেই দেশীয় বাজারে
করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব কাটিয়ে চার মাসের বেশি সময় ধরে নিম্নমুখী রয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম। একই সময়ে প্রায় ৫০ শতাংশ কমে এসেছে পণ্য পরিবহনে জাহাজ ভাড়া। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে দেশের ভোগ্যপণ্যের দামে তেমন প্রভাব পড়ে নি। এখনো আগের বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে বেশিরভাগ ভোগ্যপণ্য।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে বুকিং দর ও জাহাজ ভাড়া কমে আসায় দেশীয় বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম কমে আসার কথা। কিন্তু আমদানিকারদের কারসাজি ও সরকারের সংস্থাগুলোর তদারকির অভাবে সেই সুফল পাচ্ছে না ভোক্তারা। এমনকি সরকার ভোজ্যতেল ও চিনির যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে তাতে ভোক্তাদের তুলনায় আমদানিকারদের সুরক্ষা দেয়া হচ্ছে বেশি।
তবে আমদানিকারকদের দাবি, বিশ্ববাজারে পণ্যের বুকিং দর ও পরিবহন ভাড়া কমে এসেছে ঠিকই। কিন্তু টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বৃদ্ধিতে আমদানি খরচ আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। এতে আমদানিকৃত পণ্যের দাম সেই হারে কমছে না।
ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট কাটিয়ে বিশ্ববাজারে এখন ভোগ্যপণ্যের দাম প্রায় নিম্নমুখী। কিন্তু যেই সময় থেকে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমতে শুরু করে ঠিক তখন থেকেই দেশে ডলারের দাম বাড়তে শুরু করে। প্রতি ডলারের বিপরীতে আমদানিকৃত এসব পণ্যে আগের চেয়ে ১৫ টাকা বেশি পরিশোধ করতে হচ্ছে। একইভাবে আন্তর্জাতিক রুটে পণ্য পরিবহনে খরচ কমলেও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে দেশে পণ্য পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। ফলে আন্তর্জাতিক কিংবা দেশীয় পাইকারি বাজারে কোন পণ্যের দাম কমলেও সেই সুফল পাচ্ছে না ভোক্তারা।
ভোজ্যতেল
আন্তর্জাতিক বাজারে মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে কমতে শুরু করেছে ভোগ্যপণ্যের দাম। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে ভোজ্যতেলের দাম। তবে বিশ্ববাজারে যেভাবে বুকিং দর এবং পণ্য পরিবহনে জাহাজ ভাড়া কমে এসেছে সেভাবে কমেনি পণ্যটির দাম।
ধারাবাহিক দরপতনের পর গত মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন পাম অয়েল ৮১৯ ডলার বিক্রি হয়েছে। এর আগে ইউক্রেন সংঘাত শুরুর পরপর মার্চে পণ্যটির দাম উঠে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৯৪৫ ডলারে। সেই হিসেবে চার মাসের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির দাম কমেছে কমপক্ষে ১১২৬ ডলার। যা প্রতি লিটার হিসেবে হয় কমপক্ষে ১০০ টাকার বেশি।
আন্তর্জাতিক বাজারে মঙ্গলবার প্রতি টন সয়াবিন তেল ১ হাজার ৫৩৩ ডলারে বিক্রি হয়েছে। এর আগে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে বেড়ে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রতি টন সয়াবিনের দাম উঠে ১ হাজার ৭৬১ ডলারে। সেই হিসেবে গত তিন মাসে পণ্যটির দাম কমেছে টনে ২২৮ ডলার। যা প্রতি লিটার হিসেবে কমপক্ষে ২১ টাকা পর্যন্ত কমেছে।
ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে প্রতি মণ (৪০ দশমিক ৯০ লিটার) পাম অয়েল ৫০০০ টাকা এবং সয়াবিন ৬৭০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে জুনের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত প্রায় দুই মাস রেকর্ড দামে বিক্রি হয়েছে ভোজ্যতেল। ওই সময় প্রতি মণ (৪০ দশমিক ৯০ লিটার) পাম অয়েল ৭০০০ টাকা ও সয়াবিন ৭৫০০ টাকা দামে বিক্রি হয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের আগে বাজারে প্রতি মণ পাম অয়েল ৫০০০ টাকা এবং সয়াবিন ৫৫০০ টাকায় বিক্রি হতো। উপরোক্ত বাজার দর অনুযায়ী, পাইকারি পর্যায়ে প্রতি লিটার পাম অয়েলে ৪৯ টাকা ও সয়াবিনে ১৯ টাকা পর্যন্ত দাম কমেছে।
গম
রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত শুরুর সাথে সাথেই বিশ্ববাজারে অস্থির হয়ে উঠে গমের দাম। যুদ্ধের আগে ৯১৬ ডলারে বিক্রি হওয়া প্রতি টন গম যুদ্ধের দুই সপ্তাহের মধ্যে ১৪২১ ডলারে ঠেকে। এই ঊর্ধ্বমুখী বাজার মে পর্যন্ত অবস্থান করে আস্তে আস্তে কমতে শুরু করে পণ্যটির দাম।
গত চার মাসে টানা কমে মঙ্গলবার বিশ্ববাজারে প্রতি টন গম বিক্রি হয়েছে মাত্র ৯১৮ টাকায়। অর্থাৎ যুদ্ধের আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে গমের দাম। সেই হিসেবে এই সময়ে পণ্যটির দাম ৫০৩ ডলার কমেছে। যা কেজিপ্রতি ৫১ টাকা পর্যন্ত কমে এসেছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও গত চার মাসে দেশীয় বাজারে গমের দামে তেমন প্রভাব পড়েনি। জুলাই-আগস্টে মণে ১০০-১৫০ টাকা কমলেও এখন আরো বৃদ্ধি পেয়েছে পণ্যটির দাম।
মঙ্গলবার খাতুনগঞ্জে প্রতি মণ (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) ভারতীয় গম ১৬৫০ টাকা এবং কানাডার গম ২২০০ টাকা দামে বিক্রি হয়েছে। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারতীয় গম ১৬৫০ এবং কানাডার গম ২১৫০ টাকায় ঠেকেছিল।
অথচ রাশিয়া ইউক্রেন সংঘাতের আগে প্রতি মণ ভারতীয় গম মাত্র ৯০০ টাকা এবং কানাডার গম ১১০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হতো।
চিনি
রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের আগের দিন বিশ্ববাজারে প্রতি টন চিনির দাম ছিল মাত্র ৪৯৫ ডলার। এরপর থেকে ক্রমান্বয়ে বেড়ে জুনের প্রথম সপ্তাহে চিনির সর্বোচ্চ দাম হয় ৫৯৩ ডলার। গত চারমাসে পণ্যটির দাম কমে মঙ্গলবার বিক্রি হয়েছে ৪১০ ডলারে। সেই হিসেবে চার মাসে পণ্যটির দাম টনে ১৮৩ ডলার পর্যন্ত কমে এসেছে। যা কেজিপ্রতি কমেছে ১৮ টাকা।
গত চার মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক দরপতন হলেও দেশীয় বাজারে না কমে উল্টো বাড়ছে। পাইকারি বাজারে বর্তমানে প্রতি মণ চিনি বিক্রি হচ্ছে ৩২৫০ টাকা দামে। যা এপ্রিল থেকে মে মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে ২৮৫০ টাকায়। অথচ ইউক্রেন সংঘাতের আগে বাজারে প্রতি মণ চিনির দাম ছিল ২৬০০ টাকার নিচে। সেই হিসেবে গত চার মাসে না কমে উল্টো চিনির দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ১১ টাকা।
ভুট্টা
রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থির হয়ে উঠে দেশ দুটির অন্যতম উৎপাদিত খাদ্যশস্য ভুট্টা। সংঘাতের শুরুর দিন থেকে ক্রমান্বয়ে বেড়ে এপ্রিলের শেষ দিকে ভুট্টার বুকিং দর ঠেকে ৮১৭ ডলারে। এরপর কমতে কমতে মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন ভুট্টা বিক্রি হয়েছে মাত্র ৬৯৭ ডলারে। যা যুদ্ধের আগের ধারায় ফিরে এসেছে। উপরোক্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে চার-পাঁচ মাসে প্রতি টন ভুট্টায় ১২০ ডলার কমেছে। যা কেজিপ্রতি কমেছে কমপক্ষে ১২ টাকা।
আন্তর্জাতিক বাজারে বড় দরপতন হলেও দেশীয় বাজারে তেমন কমেনি ভুট্টার দাম। মঙ্গলবার পাইকারি বাজারে প্রতিমণ ভুট্টা বিক্রি হয়েছে ১৩০০ টাকা দামে। যা এপ্রিলে সর্বোচ্চ দাম উঠেছিল ১৪১৮ টাকা। অথচ যুদ্ধের আগে প্রতি মণ ভুট্টার দাম ছিল মাত্র ৭০০ টাকা। সেই হিসেবে দেশীয় বাজারে গত দুই মাসে ভুট্টার দাম কমেছে মাত্র ৩ টাকা।
করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুষছেন ব্যবসায়ীরা
ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে গত চার-পাঁচ মাস ধরে প্রায় সব ভোগ্যপণ্যের দাম কমে এসেছে। কিন্তু দেশীয় বাজারে আগের বর্ধিত দামেই বিক্রি হচ্ছে বেশিরভাগ পণ্য। কয়েকটি পণ্যে কিছু দাম কমে আসলেও তা আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় খুবই সামান্য।
খাতুনগঞ্জের ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী ও মেসার্স হক ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী আজিজুল হক বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশীয় বাজারেও হু হু করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয় আমদানিকারকরা। কিন্তু বিশ্ববাজারে একই পণ্যের দাম যখন কমে আসে তখন দেশীয় বাজারে সহজে কমে না।'
আজিজুল হকসহ খাতুনগঞ্জের একাধিক ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ীর অভিযোগ, দেশের ভোগ্যপণ্যের আমদানি এখন কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের হাতে জিম্মি। ফলে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো সিন্ডিকেট করে নিজেদের ইচ্ছেমতো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। সরকারের বাজার মনিটরিং টিমগুলো বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ভূমিকা রাখছে না। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম কমে আসলেও তার সুফল পাচ্ছে না ভোক্তারা।
এই বিষয়ে চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, 'বিশ্ববাজারে গত কয়েক মাসে বেশিরভাগ ভোগ্যপণ্যের দাম কমে গেছে। তবে চাইলেও দেশীয় বাজারে এসব পণ্যের দাম কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ ডলার ক্রাইসিসের কারণে আমদানি পণ্যে আগের চেয়ে বাড়তি আমদানি মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে আমদানিকারকদের। তবে যেহেতু আন্তর্জাতিক রুটে পণ্য পরিবহন ভাড়াও কমে গেছে ফলে আমদানিকারদেরও উচিত পণ্যের দাম সমন্বয় করা।'