বন্দরে বিদেশি অপারেটর নিয়োগে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে: ব্যবসায়ীরা
বাংলাদেশ নৌ ও বিমান বাহিনী ঘাঁটির কাছাকাছি অবস্থিত চট্টগ্রাম বন্দরের নিউ মুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) এবং পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) পরিচালনার জন্য বিদেশিদের নিয়োগ করলে এতে জাতীয় নিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
তারা বলেন, বিদেশিরা সামান্য টাকা বিনিয়োগ করে হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে নিয়ে যাবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের দক্ষ অপারেটররা দেশের পাশাপাশি বিদেশেও আন্তর্জাতিক মানের বন্দর পরিচালনা করছে।
তাছাড়া, পাশের দেশ ভারত প্রথমদিকে বিদেশি অপারেটরদের হাতে নিজেদের বন্দর পরিচালনার ভার দিলেও পরে তা ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে।
তবে নৌ মন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী আশ্বস্ত করে বলেন, দেশের নিরাপত্তার স্বার্থ রক্ষা করেই বিদেশি বিনিয়োগের কথা ভাবছে সরকার।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের আয়োজনে 'হাউ চট্টগ্রাম পোর্ট ক্যান বি টার্ন ইন্টু আ রিজিওনাল হাব' শীর্ষক গোল টেবিল আলাচনায় ব্যবসায়ী নেতারা এসব কথা বলেন। রাজধানীর ইস্কাটনে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের প্রধান কার্যালয়ে রোববার এ গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
সিকম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বলেন, 'চট্টগ্রাম বন্দরের বিষয়টি সিগনিফিকেন্ড। আমরা ইচ্ছে করলেই বলতে পারি না এখানে কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠান নিয়ে আসবো। একটি কেপিআই প্রতিষ্ঠানে কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠান কাজ করলে বন্দর নিরাপত্তার জন্য কী ঝুঁকি হতে পারে, বন্দরের চেয়ারম্যান তা ভালো জানবেন। তাই পোর্টকে নিয়ে কোনো অপরাজনীতি করা যাবে না।'
চাইলেই বিদেশে যে কোনো বন্দরের শেয়ার কেনা যায়না উল্লেখ করে আমিরুল ইসলাম বলেন, 'আপনি ইচ্ছে করলেই কাল গিয়ে সিঙ্গাপুর পোর্ট বা কিং আবদুল আজিজ পোর্টের শেয়ার কিনতে পারবেন না। চট্টগ্রাম পোর্ট অথরিটি নিজেরা বা চাইলে তারা বন্দর চালাবে বাকি পাঁচজন মিলে। কিন্তু অপারেটর কাউকে (বিদেশ থেকে) এনে বসিয়ে দেওয়া যাবে না।'
তিনি উল্লেখ করেন, বন্দরের কাছাকাছি রয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ঘাঁটি এবং একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এনসিটি এবং নবনির্মিত পিসিটিতে কোনো বিদেশি অপারেটর নিয়োগের আগে বন্দর কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই তা বিবেচনায় নিতে হবে।
এসময় তিনি নৌ মন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, 'মাননীয় মন্ত্রী আপনি আমাদের কথা দিয়েছিলেন বে টর্মিনাল করে দেবেন। আগামী বছরের মধ্যে অন্তত একটি স্টেশন হলেও করে দিতে হবে। বে-টার্মিনালের জন্য আমাদের বিদেশি কোনো অপারেটর চাই না। বে-টার্মিনার চট্টগ্রাম বন্দর করবে। সাথে বিভিন্ন কোম্পানিকে এসোসিয়েট বা হোল্ডিং কোম্পানি হিসেবে নিয়ে এ কাজ বাস্তবায়ন করবে।'
বক্তারা বলেন, বন্দর পরিচালনার জন্য প্রয়োজনে একটি লিমিটেড কোম্পানি করা হোক। এটি একটি সেপারেট কোম্পানি হবে। যাতে সাধারণ মানুষও সেখানে অংশ নিতে পারে।
একসময় ব্যবসার প্রায় সব খাত বিদেশিদের হাতে ছিলো। কিন্তু এখন দেশেই সিমেন্ট, ইস্পাত করেছি, গার্মেন্টস সবকিছুর ফ্যাক্টরি হয়েছে। তাদেরকে যাতে পলিসি সাপোর্ট দেওয়া হয় সেটিই চান তারা।
অনুষ্ঠানে মুল প্রবন্ধ পাঠ করেন বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারস অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট খাইরুল আলম সুজন।
তিনি বলেন, বন্দরের নিজস্ব কর্মকর্তা কর্মচারী রয়েছে প্রায় ৬ হাজার। বিভিন্ন অপারেটরের অধীনে নিয়োজিত কর্মকর্তা কর্মচারী সহ বন্দরের কার্যক্রম পরিচালনায় জড়িত আছে প্রায় ১৫ হাজার কর্মী। কোন সমীক্ষা ছাড়া অপারেটর হিসেবে বিদেশী কোম্পানি আসলে এসব টাকা বিদেশে চলে যাবে।
তিনি আরো বলেন, 'এনসিটি এবং সিসিটিতে দক্ষ অপারেটরের কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম স্মুথলি চলছে। এসব দক্ষ অপারেটরের কথা চিন্তা করে করে কিভাবে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং আরো অপোরেরটরের সংখ্যা বৃদ্ধি করা যায় সরকারকে তা জোর দিতে হবে। বিদেশি কোম্পানি নয়, বরং প্রযুক্তি এনে দেশে বন্দরের অপারেশন আরো কিভাবে স্মুথলি করা যায় সেভাবে চিন্তা ভাবনা করা উচিত।'
চেম্বার পরিচালক অঞ্জন শেখর দাশ লিখিত বক্তব্যে বলেন, শুধুমাত্র চট্টগ্রাম বন্দরই নয়, মংলা বন্দর, পাঁনগাও ইনল্যান্ড কন্টেইনার টার্মিনাল, ঢাকা কমলাপুর আইসিডিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বন্দরের কার্যক্রম পরিচালনায় অবদান রাখছে।
চিটাগাং চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, "আমাদের দেশে দক্ষতার সাথে দেশীয় অপারেটর কাজ করছে। পাশাপাশি দুবাইতেও কাজ করছে। আমাদের দেশীয় অপারেটরদের দক্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে দেশী এবং বিদেশি প্রতিষ্ঠান নিয়োগের নামে বন্দরের কাজে যাতে বাধা না হয় সেটি আগে দেখতে হবে।'
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো এসোসিয়েশনের পরিচালক ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, 'বন্দরের ভেতর যারা বার্থ অপারেটর এবং টার্মিনাল অপারেটর নিয়ে কাজ করছেন এ ব্যাপারে নজর দিতে হবে। আমরা যদি চুক্তিগুলো সেভাবে করতে পারি তাহলে বিদেশি অপারেটরের মাধ্যমে আমাদের জনবলকে শিক্ষিত করার সুযোগ তৈরি হবে।'
ডিপার্টমেন্ট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের প্রফেসর ও চেয়ারম্যান ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, 'আমরা যে শতাব্দী অতিক্রম করছি এবং বাংলাদেশে যে সময় অতিক্রম করছে সেখানে বঙ্গোপসাগর খুব গুরুত্বপুর্ণ অংশ। এই অঞ্চলের সম্পদকে আমরা কিভাবে ব্যবহার করবো এবং সেই সম্পদটা ব্যবহার করার জন্য আমাদের কী কৌশলটা নেব বা সেই যোগ্যতা আমাদের আছে কিনা সেটার আলোচনা খুব জরুরী। সে জন্য ইনক্লুসিভ ইন্ডিপেন্ডেন্ট পলিসি প্রয়োজন। এ জন্য ন্যাশনাল সিকিউরিটির আন্ডার্স্ট্যান্ডিং প্রয়োজন আছে।'
নৌ মন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, 'সরকারের কাজ হলো পথ দেখিয়ে দেওয়া। সবার কাজ হলো সে পথ ধরে চলা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেরিটাইম সেক্টরের জন্য ঝুঁকি নিয়েছেন, বিনিয়োগ করেছেন এবং বিদেশের বিনিয়োগকে আহ্বান করেছেন। বর্তমানে তিনি প্রাইভেট সেক্টরে উন্নতির জন্য একজন এডভাইজার নিয়োগ করেছেন।'
'বিদেশিদের বিষয়ে শুনলেই আমরা ভয় পাই। কিন্তু আমাদের তো পৃথিবীর মধ্যেই থাকতে হবে। পৃথিবীর অনেক চুক্তির সঙ্গে জড়িত। একটা দেশ প্রেমিক সরকার এখানে আছে। তাই দেশের স্বার্থ রক্ষা করেই বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে আনা হবে। সরকারের উপর আস্থা রাখতে হবে,' বলেন তিনি।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর সম্পাদক ইনাম আহমেদ। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের নির্বাহী সম্পাদক শাহরিয়ার খানের সঞ্চালনায় বৈঠকে আলোচনায় অংশ নেন বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার এ্যাডমিরাল এম শাহজাহান, চট্টগ্রাম বন্দরের সদ্য বিদায়ী সদস্য (প্ল্যানিং এন্ড অ্যাডমিন) জাফর আলম, এফবিসিসিআই'র পরিচালক প্রিথী চক্রবর্তী, বাংলাদেশ ইকোনোমিক এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আইনুল ইসলাম, বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ, বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডারস এসোসিয়েশনের সভাপতি কবির আহমেদ ও বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফেকচারাস এন্ড এক্সপোর্ট এসোসিয়েশনের এক্সিকিউটিভ প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম।