নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করা না গেলে সংকট গভীর হবে
ডলার সংকটের কারণে শিল্পের কাঁচামাল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করা না গেলে দেশের চলমান বহুমাত্রিক সংকট আরও গভীর হবে বলে মত দিয়েছেন সিকম গ্রুপ ও প্রিমিয়ার সিমিন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমিরুল হক।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রয়োজন।
দেশে বর্তমান অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক পরিস্থিতি নিয়েও নিজের পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করেন বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর এই শীর্ষ কর্মকর্তা।
প্রশ্ন: ব্যবসা-বাণিজ্যের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
আমিরুল হক: করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক সংকট সৃষ্টি করেছে। আমরা সেই সংকটে পড়েছি। ডলার সংকটের কারণে গ্যাস-বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সবকিছু মিলে টিকে থাকা কঠিন।
এই পরিস্থিতিতেই আমরা প্রায়োরিটি ঠিক করতে পারিনি।
সংকটে শুধু যে নিত্যপ্রয়োজনীয় শিশুখাদ্য, ভোগপণ্য, চিনি, চাল, ডাল, গম আমদানিতে ভাটা পড়েছে এমন নয়। শিল্পের কাঁচামালেও ভাটা পড়েছে। অপরদিকে বিদেশি ফলমূল, চকলেট, এমনকি গাড়ি আমদানিও বন্ধ নেই। এই সংকটকালীন সময়ে আমাদের প্রয়োরিটি ঠিক করতে হবে কোন পণ্য আমদানি করা হবে, কোনটি নয়।
দেশের বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের বিস্কুট তৈরি হচ্ছে, এখনো কেন বিদেশি বিস্কুট আমদানি করতে হবে? ক্যান্ডি/চকলেট, মাছ কেন আমদানি করতে হবে! গরু আমদানি বন্ধ করার পর বাংলাদেশ চলেনি? অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি বন্ধ করে দিন। শক্তভাবে নজরদারি করুন। প্রয়োজনে আইন করে অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি বন্ধ করতে হবে।
প্রশ্ন: শিল্পের উৎপাদন কীভাবে অব্যাহত রাখা যায়?
আমিরুল হক: এখন সব শিল্পপ্রতিষ্ঠানেরই আধুনিক যন্ত্রপাতি রয়েছে। এসব যন্ত্রপাতি বিরতিহীন চলতে হয়। দিনের বেলা শিল্পকারখানার বিদ্যুৎ বন্ধ রাখতে বলা হচ্ছে। এভাবে শিল্প চলতে পারে না। এই গ্যাসের সংকটের মধ্যে শিল্প কারখানা চালাবেন নাকি বাসার চুলা চালাবেন? এটি আগে ঠিক করতে হবে। গ্যাস (এলপিজি) আমদানি করতে বলছি আমরা। প্রয়োজনে আমরা গ্যাসের জন্য বেশি টাকা পরিশোধ করতে রাজি। গ্যাস আমদানি করা হলে উৎপাদনের চাকা ঘুরবে। ডলার আসবে। আমরা কমার্শিয়াল অ্যাডজাস্টমেন্ট করার কথা বলছি। গাড়িতে গ্যাস বন্ধ রাখেন কিছুদিনের জন্য। আবার এলপিজি আমদানি করে আবাসিকে দেওয়া যেতে পারে।
প্রশ্ন: এই পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবিলা করা যায়?
আমিরুল: সংকট মোকাবিলায় চারটি বিষয়ে নজর দিতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য আমদানি, অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি সীমিতকরণ, শিল্পের কাঁচামাল এবং রপ্তানি অব্যাহত রাখা।
একেবারে প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য আমদানি অব্যাহত রাখতে হবে। সংকটের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানির প্রয়োজন নেই। গাড়ি আমদানির প্রয়োজন নেই। আপেল আমদানি করে খাওয়ার দরকার নেই।
তবে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি যেন ব্যাহত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। উৎপাদন না হলে অর্থনীতির চাকা ঘুরবে না। আর রপ্তানিকে কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। যে গাড়ি চালাতে বেশি তেল প্রয়োজন, সে গাড়ির অনুমতি না দেওয়া হোক। গাড়িগুলো শিডিউল আকারে চালানো হোক। সপ্তাহে তিনদিন জোড়, বাকি তিনদিন বিজোড় সিরিয়ালের গাড়ি চালানো হোক। অফিসে এসি বন্ধ থাকলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু শিল্প কারখানাগুলো চালু রাখতে হবে। সেগুলোকে চলতে দিন।
রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। এটা আমরা ইতিবাচক দেখি। দেশের প্রধান নির্বাহী হিসেবে তিনি সবাইকে সতর্ক করেছেন। এখন আমাদের গাইডলাইন দিতে হবে। কীভাবে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা যায়, তা ঠিক করতে হবে।
প্রশ্ন: ব্যাংকগুলো এলসি না খোলায় কী সংকট তৈরি হচ্ছে?
আমিরুল: খাদ্যপণ্য আমদানির এলসি না খুললে সাপ্লাই চেইন ধসে পড়বে। ৩ মিলিয়ন ডলারের বেশি এলসি খোলার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। খাদ্যপণ্যের সংকট তৈরি হতে পারে। ডলার সংকটের কারণে আমি ৩ মিলিয়ন ডলারের দুটি এলসি খুলতে পারিনি। অনেক ব্যাংকের মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশে শাখা থাকায় তারা ডলার ম্যানেজ করে থাকে। আমি যে ব্যাংকের এলসি খুলি, সে ব্যাংকের দেশের বাইরে কোনো শাখা নেই।
এছাড়া আরেকটি ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে আমাদের। আমদানিকারকদের জন্য ডলারের এক ধরনের মূল্য, রপ্তানিকারকদের জন্য আরেক ধরনের এবং প্রবাসীদের জন্য ডলারের আরেক ধরনের মূল্য ধরা হয়। আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে ডলারের মূল্য পার্থক্য কেন হবে!
আমরা সবসময় দাবি জানিয়ে আসছি, আমদানির জন্য এলসি খোলার সময় ডলারের যে মূল্য থাকে, পেমেন্টের সময় যেন সেই মূল্য একই রাখা হয়। একজন ব্যবসায়ী যদি এক মিলিয়ন ডলারের এলসিতে ২০ টাকা পার্থক্য হলে অনেক টাকা লোকসান হয়! এই লোকসান কীভাবে পোষাবে?
প্রশ্ন: পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনলে ডলার সংকট সমাধান হবে? বিদেশে ব্যবসা করছেন এমন বাংলাদেশিদের সংকট কী?
আমিরুল: বিদেশে পাচার হওয়া টাকাগুলো ফিরিয়ে আনতে হবে। আইএফএমর যে ঋণ নিয়ে আলোচনা চলছে, তা মাত্র দেড় বিলিয়ন ডলার। আমরা চেষ্টা করলে এই পরিমাণ টাকা বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। কালো টাকা সাদা করতে ৭.৫ শতাংশ দিতে হবে সরকারকে। সেটা না রেখে যদি সব টাকাই সাদা করে দেওয়া হয়, তাহলে অর্থ সংকট হবে না। দেশে টাকা আসবে।
আর কেউ যদি দেশে বসে বিদেশ থেকে ডলার আয় করে, তা ট্যাক্স ফ্রি করে দেওয়া দরকার। একজন বিদেশি টাকা আয় করছেন, এখানে কেন সরকার ট্যাক্স নেবে! তাহালে তো মানুষ অবৈধ পথ বেছে নেবেন। হাজার হাজার বাংলাদেশি দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের চেষ্টায় দোকান দিয়েছেন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। বিদেশে ব্যবসা করতে কেন সরকারের অনুমতি লাগবে! এখানে মুক্ত বিহঙ্গ করে দিতে হবে। এই টাকার কাটাকাটি বন্ধ করতে হবে।
বিশ্বায়নের যুগে জটিল করলে চলবে না। সহজ করতে হবে। বাংলাদেশিদের মধ্যে যাদের অন্য দেশের পাসপোর্ট আছে, তারা বাংলাদেশ আসতে চান না। কারণ বিদেশে যারা ব্যবসা করছেন তাদের জন্য কোনো নীতিমালা করা হয়নি। শুধু একটি ডিক্লারেশনের (ঘোষণাপত্রের) মাধ্যমে যেন প্রবাসিরা বৈদেশিক আয় দেশে আনতে পারেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশে শুধু ডিক্লেয়ার দিয়ে বিলিয়ন ডলার আনা সম্ভব।
প্রশ্ন: দেশের রপ্তানির পরিধি আরও বাড়াতে কী করণীয়?
আমিরুল: নীতিসহায়তা প্রয়োজন। অর্থাৎ রপ্তানিসহায়ক নীতি প্রণয়ন করতে হবে। আমাদের তৈরি পোশাক খাতে (আরএমজিতে) এখনো বিরাট সুযোগ রয়েছে। এগুলো আরও কাজে লাগাতে হবে। অনেক বিদেশি ক্রেতার কাছে বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো অপশন নেই। বাংলাদেশের প্রায় ৫০০ কোম্পানি এই খাতে অনেক ভালো করছে। এই সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। যারা ভালো করছে, তাদের আরও ভালো করতে হবে।
আমরা মধ্যপ্রাচ্যে শাক-সবজি রপ্তানি করছি। এই সবজির গ্রাহক আমাদের এথনিক গ্রুপ। আমরা ঠিকমতো চিংড়ি উৎপাদন করতে পারছি না। আমাদের জাহাজ নির্মাণ শিল্প নেই। এই শিল্পের জন্য সহায়ক নীতি তৈরির কথা ছিল। এখনো তা করা হয়নি। সহায়ক নীতি না থাকলে তো রপ্তানির পরিধি বাড়ানো সম্ভব নয়। আমাদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-আমলারা অনেক ভালো জানেন। তারা আন্তরিকও বটে। আরও ২০ জন ভালো লোককে এখানে দেওয়া হলেও লাভ হবে না। সহায়ক নীতি ছাড়া জানাশোনা বা ভালো লোক দিয়ে কী করবো? তারা কী করবেন!