খাদ্য আমদানির জন্য ১০০ কোটি ডলার ঋণ গ্যারান্টির প্রস্তাব বিশ্বব্যাংকের সংস্থার
দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতি ও চলমান ডলার সংকটের সময়ে– বিশ্বব্যাংক গ্রুপের একটি সংস্থা- মাল্টিলেটারাল ইনভেস্টমেন্ট গ্যারান্টি এজেন্সি (বা মিগা) অত্যাবশ্যকীয় নিত্যপণ্য আমদানির মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তার উন্নতির জন্য বাংলাদেশকে ৫০ থেকে ১০০ কোটি ডলারের ঋণ গ্যারান্টির প্রস্তাব দিয়েছে।
মিগা- বিশ্বব্যাংক গ্রুপের রাজনৈতিক ঝুঁকির বিপক্ষে নিশ্চয়তা দানকারী একটি অঙ্গঃপ্রতিষ্ঠান। তারা তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য একটি রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল গঠনে– বিদেশী ঋণদাতাদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সহায়তা পাওয়ার বিষয়ে গ্যারান্টি দেওয়ারও আগ্রহ প্রকাশ করেছ।
মিগার দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ও অস্ট্রালোশিয়া অঞ্চলের প্রধান টিমোথি হিস্টেড এর পাঠানো একটি ইমেইলের বরাত দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্রগুলো জানায়, বিদেশি বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক মিগার গ্যারান্টিতে 'ফুড সিকিউরিটি ইমপোর্ট ফ্যাসিলিটেশন প্রোগ্রাম (এফএসআইএফপি)' কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার থেকে ১ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত স্বল্প-মেয়াদি ঋণ দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে, যা এক বছরে পরিশোধ করতে হবে।
গত ৪ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরসহ উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের দেওয়া ইমেইলে বলা হয়েছে, 'বাংলাদেশ ব্যাংক এসব তহবিল দিয়ে একটি কর্মসূচি চালু করবে, যার আওতায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো খাদ্য নিরাপত্তার জন্য আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলতে তহবিল দেবে। এলসি ম্যাচিউরড হলে, আমদানি দায় মেটাতে অনুমোদিত ডিলার ব্যাংককে বৈদেশিক মুদ্রা দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক'।
সুদহার নির্ধারণসহ ঋণ চুক্তি চূড়ান্তকরণের অন্যান্য শর্ত আলোচনার জন্য ঢাকায় একটি প্রতিনিধি দল পাঠানোর আগ্রহও ব্যক্ত করেছেন টিমোথি হিস্টেড।
সরকার আশা করছে, মিগার গ্যারান্টিতে বৈদেশিক মুদ্রার ঋণ প্রাপ্তি– ডলার সংকটের কারণে বৈশ্বিক ব্যাংকগুলির দ্বারা বাংলাদেশি ব্যাংকগুলো আমদানি এলসি নিশ্চিতকরণের (এলসি কনফার্মেশন) চলমান সমস্যাকে লাঘব করবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ টিবিএসকে বলেন, 'বিদেশি ব্যাংকগুলো আমাদের এলসির কনফার্মেশন দিতে চায় না। এই প্রেক্ষাপটে, মিগার গ্যারান্টিতে বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশি ব্যাংক ঋণ দিলে খাদ্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে জটিলতা দূর হবে'।
তিনি আরও বলেন, 'মিগার সঙ্গে প্রাথমিক আলাপ হয়েছে। খাদ্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ডলার সাপোর্ট পাওয়ার জন্য তারা বাংলাদেশের পক্ষে গ্যারান্টার হতে চাচ্ছে। আমরা তাদেরকে ডিটেইলস প্রস্তাব দিতে বলেছি, তারা একটা প্রস্তাবও দিয়েছে'।
দেশের শীর্ষস্থানীয় নিত্যপণ্য আমদানিকারক সিটি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বাণিজ্য সচিবের সাথে একমত পোষণ করে বলেছেন, 'বিদেশি ব্যাংকগুলো আমাদের ব্যাংকগুলোর ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। ফলে তারা আমাদের এলসি কনফার্ম করে না। এমন ঘটনাও আছে যে, গত সেপ্টেম্বরে খোলা এলসির বিপক্ষে এখনও কনফার্মেশন পাওয়া যায়নি'।
'এই বাস্তবতায়, বিশ্বব্যাংকের একটি এজেন্সি গ্যারান্টার হলে এবং তার ভিত্তিতে অনুমোদিত ডিলার (এডি) ব্যাংকের পক্ষে বিদেশি ব্যাংকগুলো রপ্তানিকারকদের মূল্য পরিশোধ করলে- তা আমাদের জন্য খুবই ইতিবাচক হবে'।
চুক্তি স্বাক্ষরের তিন মাসের মধ্যে ব্যবসায়ীরা এই ঋণ সুবিধার আওতায় পাওয়া বৈদেশিক মুদ্রায় খাদ্য পণ্য আমদানি করতে পারবে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। তারা বলেছেন, এই তহবিলটি রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের মতোই পরিচালিত হবে।
বর্তমানে দেশের অনুমোদিত ডিলার ব্যাংকগুলো বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করতেই হিমশিম খাচ্ছে। একারণে আমদানিকারকরা প্রয়োজনীয় খাদ্য এবং খাদ্য-সম্পর্কিত পণ্য যেমন গম, ভোজ্য তেল, চিনি, সার এবং পশুখাদ্য (ফিডস্টক) আমদানির জন্য এলসি খোলার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বিলম্বের সম্মুখীন হচ্ছে।
গত বুধবার দ্রব্যমূল্য সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সভাতেও ব্যবসায়ীদের ভোগ্যপণ্য আমদানিতে এলসি খোলার সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন বলে জানান বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। এ সমস্যা সমাধানে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে ব্যয় করতে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় থেকে ডলারের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কোটা সংরক্ষণ করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এদিকে, গত সপ্তাহে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের টাস্ক ফোর্স দ্রব্যমূল্য এবং বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বলেছে, প্রধানত ডলার সংকটের কারণে রমজানে চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পায় এমন অত্যাবশ্যকীয় পণ্য– বিশেষত ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা এবং খেজুর আমদানির জন্য এলসি খোলার ক্ষেত্রে ২০২২ সালের শেষ প্রান্তিকে তীব্র পতন দেখা গেছে। ফলে রোজার মাসের আগে সরবরাহের ঘাটতি এবং পণ্যমূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
মিগার ইডিএফ প্রস্তাব নিয়ে আশাবাদী পোশাক খাত
সরকারের ৭ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে ডলারে ঋণ নিতে পারতেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু, ডলার সংকটের কারণে বিদ্যমান এ তহবিল থেকে ঋণ দেওয়া কমিয়েছে সরকার। এই পরিস্থিতিতে, পোশাক শিল্পের জন্য মিগার একটি ইডিএফ গঠনে সহায়তা দানের প্রস্তাবকে সুখবর বলে মনে করা হচ্ছে।
বিদ্যমান ইডিএফ তহবিলটির পরিধি হ্রাসের আলোচনাও চলছে। এরমধ্যে, দেশের রপ্তানিমুখী শিল্পের ব্যবসায়ীদের নিম্ন সুদে উৎপাদনে দরকারি কাঁচামাল আমদানিতে সহায়তা দিতে 'এক্সপোর্ট ফ্যাসিলিটেশন ফান্ড' (ইএফএফ) নামে ১০ হাজার কোটি টাকার একটি নতুন তহবিল গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ৩১ ডিসেম্বর জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে একথা জানানো হয়।
তবে যদি ইডিএফ থেকে ঋণ নেওয়া কঠিন হয়ে যায় এবং নতুন গঠিত ইএফএফ থেকে টাকা ধার করে আমদানি বিল পরিশোধের জন্য ডলার কিনতে হয়– তাহলে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন রপ্তানিকারকরা। টেক্সটাইলসহ (বস্ত্র) বেশকিছু রপ্তানি খাতেও 'বিপর্যয়ের' আশঙ্কা করছেন তারা।
ইডিএফ গঠনে মিগার সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাবটি সম্পর্কে জানতে চাইলে, বাংলাদেশের নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সমিতি (বিকেএমইএ)'র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম টিবিএসকে বলেন, মিগার প্রস্তাব অনুযায়ী, ডলারে এই তহবিল গঠন করা হলে তা পোশাক শিল্পের জন্য খুবই ভালো হবে। বিশেষত বর্তমান পরিস্থিতিতে, যখন সরকার ইডিএফ থেকে অর্থায়ন কমাচ্ছে।
'তবে এক্ষেত্রে ঋণের শর্ত ও সুদহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে' বলে মন্তব্য করেন তিনি।
যেভাবে কাজ করবে
ফুড সিকিউরিটি ইমপোর্ট ফ্যাসিলিটেশন প্রোগ্রাম এর আওতায়– বিদেশি ঋণে খাদ্যপণ্য আমদানি ও এর মূল্য পরিশোধে এলসি প্রক্রিয়া কীভাবে কাজ করবে তার একটি বিস্তারিত উদাহরণ (ইলাস্ট্রেটেড, গ্রাফসহ সচিত্র) বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আলোচনার জন্য পাঠিয়েছে মিগা।
সে অনুযায়ী, প্রথমে আমদানিকারক অনুমোদিত ডিলার (এডি) ব্যাংকের কাছে এই কর্মসূচির আওতায় অনুমোদিত পণ্য আমদানির লক্ষ্যে এলসি খোলার আবেদন করবে। এরপর এডি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন করবে।
এরপর এডি ব্যাংক একটি এলসি খুলবে এবং সে মাফিক বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে রপ্তানিকারককে পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে জানাবে। তখন রপ্তানিকারক এদেশের আমদানিকারকের কাছে পণ্যের চালান পাঠাবে এবং এসংক্রান্ত নথিপত্র ওই বিদেশি ব্যাংকে জমা দেবে। রপ্তানির কাগজপত্র নিয়ে আলোচনার পর, রপ্তানিকারককে মূল্য পরিশোধ করবে বিদেশি ব্যাংকটি। এরপর তারা অর্থদাবি ও বাণিজ্য সংক্রান্ত অন্যান্য কাগজ এদেশের এডি ব্যাংককে পাঠাবে।
অর্থদাবি পরিশোধে তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন করবে এডি ব্যাংক। এর প্রেক্ষিতে, ডিলার ব্যাংকের ফরেন কারেন্সি ক্লিয়ারিং একাউন্টে বৈদেশিক মুদ্রা দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন বিদেশি ব্যাংকটির অর্থদাবি পরিশোধ করে দেবে এডি ব্যাংক।
এডি ব্যাংককে আমদানিকারক টাকাতেই মূল্য পরিশোধ করতে পারবে। চুক্তির শর্ত অনুসারে, বাংলাদেশ ব্যাংককে আবার সমপরিমাণ টাকায় বা বৈদেশিক মুদ্রায় রিপেমেন্ট করবে অনুমোদিত ডিলার ব্যাংক।
মিগা বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করে জানিয়েছে, আমদানি দায় পরিশোধে বৈদেশিক মুদ্রা সহায়তা পাওয়া যাবে এবং সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যেই দেওয়া হবে।
বহুপাক্ষিক সংস্থাটি বলেছে, তাদের ফুড সিকিউরিটি ইমপোর্ট ফ্যাসিলিটেশন প্রোগ্রাম বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতির লক্ষ্যে নেওয়া হবে। তবে এর আওতায় শুধুমাত্র খাদ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত পণ্য যেমন- খাদ্যশস্য, ভোজ্যতেল সার, চিনি ও ফিডস্টক আমদানি করা যাবে।