রোজার বাজার: সপ্তাহের ব্যবধানে ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ৫ শতাংশের ওপরে
ইফতারের অন্যতম অনুষঙ্গ খেজুর। এক সপ্তাহ আগে খাতুনগঞ্জে মরিয়ম জাতের খেজুরের পাঁচ কেজির কার্টন ৩২০০ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে তা ৩৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খুচরায় এই জাতের খেজুর বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায়।
শুধু খেজুর নয়, রমজান শুরুর আগ মুহুর্তে অস্থির হয়ে উঠেছে প্রায় সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের বাজার, যা অস্বস্তিতে ফেলেছে ভোক্তাদের।
রমজান মাসে ডাল জাতীয় ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়ে। বুধবার দেশের প্রধান ভোগ্যপণ্যের বাজারে মটর ডাল পাইকারিতে ৭৫ টাকায় এবং খুচরায় ৮৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। যা গত বৃহস্পতিবারও পাইকারিতে ৭০ ও খুচরায় ৭৮ টাকায় বিক্রি হয়। সেদিন মুগডালের পাইকারি দাম ছিলো ৭৫ এবং খুচরায় ১১০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছিলো, গতকাল বুধবার সেই ডাল বিক্রি হচ্ছিল পাইকারিতে ৮০ এবং খুচরায় ৯০ টাকা। মসুর ডাল (মোটা) বর্তমানে পাইকারিতে ৮৮ টাকা এবং খুচরায় ১১০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সাতদিন আগে মসুর ডাল বিক্রি হয়েছিলো পাইকারিতে ৮৫ ও খুচরায় ৯৫ টাকা দরে।
খাতুনগঞ্জ ডাল মিল মালিক সমিতির সভাপতি সঞ্জয় দেব টিবিএসকে বলেন, 'খাতুনগঞ্জে এক সপ্তাহ ধরে ডালের দাম বাড়ছে। ডলার রেট ও আমদানি খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় এটা হচ্ছে।'
বহদ্দারহাটের খুচরা ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বলেন, 'ভালো মানের ডাল বাজারে পাওয়া যাচ্ছে কম। দুই-তিন রকমের ডালের মিশ্রণ 'ভালো' বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ডালের সঙ্গে ঝুট বেশি আসছে। অপচয় ও পরিবহন খরচ যোগ করে বিক্রি করতে হচ্ছে, তাই দাম একটু বাড়তি।'
বেসরকারি একটি ফার্মে চাকরি করেন আমিনুল ইসলাম। মাসে সর্বসাকুল্যে বেতন পান ২৫ হাজার টাকা। দুই সন্তান নিয়ে থাকেন চকবাজারের ভাড়া বাসায়।
তিনি বলেন, 'মাসে ১০ হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিতে হয়। দুই সন্তানের স্কুলের খরচ লাগে অন্তত ৫ হাজার টাকা। এছাড়া নিজের ও সন্তানদের যাতায়াতের খরচ হয় আরো অন্তত ২ হাজার টাকা। বাকি ৮ হাজার টাকায় পুরো মাসের খরচ চালাতে হয়। রমজানে কিভাবে সন্তানদের নিয়ে বাঁচবো বুঝতে পারছিনা।'
বুধবার চট্টগ্রামের বাজারে পাইকারিতে চিড়া ৫ টাকা বেড়ে ৫০ টাকা ও খুচরায় ৫৫ টাকা, আলুবোখারা পাইকারিতে ১০ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি ৪২০ টাকা ও খুচরায় ২৫ টাকা বেড়ে ৫০০ টাকা, কিসমিস পাইকারিতে ১০ টাকা বেড়ে ৩৯০ টাকা ও খুচরায় ২০ টাকা বেড়ে ৪৫০ টাকা, জিরা পাইকারিতে ২০ টাকা বেড়ে ৫৯০ টাকা ও খুচরায় ৩০ টাকা বেড়ে ৬৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
একইভাবে লবঙ্গ পাইকারিতে ৩০ টাকা বেড়ে ১ হাজার ৩৪০ টাকা ও খুচরায় ৫০ টাকা বেড়ে ১৪২০ টাকা, দারুচিনি পাইকারিতে ২০ টাকা বেড়ে ৪১০ টাকা ও খুচরায়ও ২০ টাকা বেড়ে ৪৫০ টাকা, এলাচি পাইকারিতে ২৫ টাকা বেড়ে ১৩৮০ টাকা ও খুচরায় ৫০ টাকা বেড়ে ১৬০০ টাকা, চিনি পাইকারিতে ৩ টাকা বেড়ে ১০৯ টাকা ও খুচরায় ৫ টাকা বেড়ে ১১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া মিয়ানমারের আদা পাইকারিতে ৫ টাকা বেড়ে ৭৫ টাকা ও খুচরায় ৮ টাকা বেড়ে ৯০ টাকা, রসুন পাইকারিতে ৮ টাকা বেড়ে ১১০ টাকা ও খুচরায় ১০ টাকা ১৩০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
খুচরা বাজারে জেলা প্রশাসনের অভিযান শুরুর পর এখন সাইনবোর্ডে রোজার পণ্যের ক্রয়-বিক্রয়ের দর থাকে। কিন্তু নগরের বহদ্দারহাট ও চকবাজারে সরেজমিনে গিয়ে তালিকার সঙ্গে বাজার দামের কোনো মিল পাওয়া যায়নি। এছাড়া পাইকারি ক্রয়মূল্য যাচাই করতে চাইলেও তা সরবরাহ করা হয়নি।
চাদগাঁও এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ সোহেল বলেন, 'রমজানকে ঘিরে দ্রব্যমূল্যের দামবৃদ্ধির কারণে দৈনন্দিন খরচ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এভাবে যদি দ্রব্যমূল্য বাড়তে থাকে, তাহলে পরিবার নিয়ে রমজানে চট্টগ্রাম শহরে বাস করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।'
চট্টগ্রামের পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, জাতভেদে ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ দাম বেড়েছে খেজুরের। মাবরুম জাতের খেজুর পাইকারিতে ৭২০ টাকা হলেও খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকায়, কালমী খেজুর পাইকারিতে ৫০০ টাকা এবং খুচরায় ৭৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
খাতুনগঞ্জের খেজুরের আড়তদার আব্দুল মালেক জানান, ভাল মানের খেজুরের মধ্যে মারিয়াম ও মাবরুমে ১৫০-২০০ টাকা, দাবাসে ৩০০ টাকা পর্যন্ত প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে। আবার নাগাল, জাহিদির মত একটু কম দামের খেজুরে কেজিপ্রতি ২০-৫০ টাকা দাম বেড়েছে।
ভারত থেকে পেয়াঁজ না আসায় কেজিপ্রতি পাঁচ থেকে সাত টাকা বেড়েছে ভারতীয় পেঁয়াজের দাম। দেশি পেঁয়াজের দামও বেড়েছে কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা।
খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে মঙ্গলবার ভারতীয় নাসিক পেঁয়াজ কেজিপ্রতি বিক্রি হয়েছে ৩৩ থেকে ৩৪ টাকা। দুদিন আগেও এটি বিক্রি হয়েছিল ২৮ থেকে ২৯ টাকা। দেশি পেঁয়াজ কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৯ থেকে ৩০ টাকায়।
পেঁয়াজের পাইকারি আড়ত খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ মিঞা মার্কেট কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, 'সরকার গত বুধবার থেকে ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ করেছে। এর প্রভাবে খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। সেখানে দেশি পেঁয়াজ তেমন নেই। তাই ভারতীয় পেঁয়াজ না এলে রমজানে আরও বাড়বে দাম।'
ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি কারণ জানিয়ে তিনি বলেন, 'মূলত ডলারের দাম বৃদ্ধি ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে।'
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, 'কিছু পণ্য হয়তো আমদানি নির্ভর, ডলারের দাম বৃদ্ধি অনুসারে দাম বাড়তে পারে। কিন্তু ডলারের বাজারের তুলনায় রোজাকে সামনে রেখে পণ্যের দাম বেশি বাড়ানো হচ্ছে।'