এখনও গতি পায়নি নতুন রপ্তানি সহায়তা তহবিল
রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোকে স্থানীয় মুদ্রা টাকায় ঋণসহায়তা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গঠন করা রপ্তানি সহায়ক প্রাক-অর্থায়ন তহবিল (ইএফপিএফ) থেকে ঋণ বিতরণ এখনও গতি পায়নি। কারণ রপ্তানিকারকরা এখনও বৈদেশিক মুদ্রায় গঠিত ইডিএফ থেকেই ঋণ নিতে বেশি আগ্রহী।
রপ্তানিকারকরা সাধারণত রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে নেওয়া ঋণ দিয়ে বিদেশি ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি (ঋণপত্র) নিষ্পত্তি করে। সে কারণে বৈদেশিক মুদ্রায় গঠিত ইডিএফের ঋণের চাহিদা স্থানীয় মুদ্রায় গঠিত ইএফপিএফের ঋণের চেয়ে বেশি।
ইডিএফ থেকে রপ্তানিকারকরা যে ঋণ নেয়, তার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর প্রতিদিন সেই ঋণ পরিশোধ করা হয় এবং অন্যান্য রপ্তানিকারকরা নতুন ঋণ নেয়। প্রতিদিন গড়ে ১০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি ইডিএফ ঋণ বিতরণ করা হয়। অর্থাৎ প্রতি মাসে বিশ কার্যদিবসে ২ বিলিয়ন ডলারের (প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা) বেশি ইডিএফ ঋণ বিতরণ করা হয় বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত জানুয়ারিতে রপ্তানিমুখী খাতগুলোর জন্য মূলধনি যন্ত্রপাতি ও রপ্তানিপণ্যের কাঁচামাল আমদানিতে সহায়তা দিতে ইডিএফের বিকল্প হিসেবে রপ্তানিকারকদের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার ইএফপিএফ তহবিল গঠন করা হয়। কিন্তু এর পরের তিন মাসে এখান থেকে মাত্র ২ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ইডিএফ থেকে ঋণ দেওয়া হয় বৈদেশিক মুদ্রায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা বলেন, এইফপিএফ ঋণ যেহেতু টাকায় দেওয়া হয়, তাই স্বাভাবিকভাবেই এ ঋণের চাহিদা ইডিএফের চেয়ে কম হবে। তিনি জানান, এর কারণ হলো, রপ্তানিকারকরা ইএফপিএফ থেকে ঋণ নিয়ে শ্রমিকদের মজুরি ও ভাতা পরিশোধ এবং দেশীয় উৎস থেকে কেনা পণ্যের দাম শোধ করতে পারবে। কিন্তু বিদেশি ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি পেমেন্ট করার জন্য রপ্তানিকারকদের বাজার থেকে ডলার কিনতে হয়।
চলমান ডলার সংকটের মধ্যে ইডিএফের ওপর থেকে চাপ কমাতে ইএফপিএফ গঠন করা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ রপ্তানিকারকই ইডিএফ থেকে ঋণ নেওয়া অব্যাহত রাখতে চাইছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা বলেন, ইডিএফের আকার আরও কমিয়ে আনলে ইএফপিএফের আওতায় ঋণ বিতরণ আরও বাড়তে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারির শুরুতে ইডিএফের আকার ছিল ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি, মার্চের চতুর্থ সপ্তাহে যা প্রায় ৫.৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা জানান, ইএফপিএফ থেকে ঋণের চাহিদা বাড়লে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই তহবিলের আকার বাড়াবে এবং ইডিএফের আকার কমিয়ে আনবে।
কিছু সমস্যার কারণেও ইএফপিএফ থেকে ঋণ বিতরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
ইডিএফ থেকে ঋণ নিতে সরাসরি অনলাইনে আবেদন করা যায়, কিন্তু ইএফপিএফেরর জন্য এখনও অনলাইনভিত্তিক সেবা চালু হয়নি। এছাড়া ইডিএফের জন্য ব্যাংকগুলো আলাদা কর্মকর্তা নিয়োগ দিলেও অনেক ব্যাংকই এখনও ইএফপিএফের জন্য আলাদা কর্মকর্তা নিয়োগ করেনি। যদিও এ তহবিলে অংশ নিতে এখন পর্যন্ত ৫১টি ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করেছে।
ধীরগতিতে শুরু হলেও এখন পর্যন্ত ইএফপিএফ থেকে ইসলামি ধারার বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে বেশি। আর সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করেছে জনতা ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র টিবিএসকে জানায়, রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন ইডিএফ থেকে নতুন ঋণ বিতরণের চেয়ে এ তহবিল থেকে বিতরণকৃত ঋণ আদায়ে বেশি তৎপর। এখন ১০ টাকা ফেরত পেলে সর্বোচ্চ ৮ টাকা ঋণ দেওয়া হচ্ছে। অবশিষ্ট ২ টাকা রিজার্ভের সঙ্গে সমন্বয় করা হচ্ছে।
যেসব ব্যাংক ইডিএফের ঋণ যথাসময়ে পরিশোধ করতে পারছে না, সেগুলোর জন্য ৪ শতাংশ করে 'পেনাল ইন্টারেস্ট'ও চালু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বেশ কয়েকটি ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে ইডিএফ ঋণ পরিশোধে বিলম্ব করছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে টিবিএসকে জানান কর্মকর্তারা।
সম্প্রতি ইডিএফ থেকে ঋণ নিয়ে 'ওভারডিউ' হওয়ায় একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে এই সুবিধা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম টিবিএসের সঙ্গে আলাপকালে ইএফপিএফ থেকে ঋণ বিতরণে ধীরগতির জন্য ব্যাংকগুলোর 'অনীহা'কে দায়ী করেন।
তিনি অভিযোগ করেন, ব্যাংকগুলো ইএফপিএফ থেকে টাকা না দিয়ে তাদের নিজস্ব উৎস থেকে রপ্তানিকারকদের ঋণ দেওয়ার চেষ্টা করছে।
'ব্যাংকগুলোর নিজস্ব তহবিল থেকে দেওয়া ঋণের সুদহার বেশি। ব্যাংকগুলো যদি রপ্তানিকারকদের চাহিদা অনুযায়ী ইএফপিএফ থেকে ঋণ নেয়, তাহলে এর ব্যবহার অনেকগুণ বাড়বে,' বলেন হাতেম।
বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দেন তিনি। বলেন, 'আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্দেশনা হচ্ছে ইডিএফের আকার কমিয়ে ফেলা। আমি বলব, ইডিএফের আকার ডলারে অন্তত ৪ বিলিয়ন ডলার রাখা উচিত, যার মাধ্যমে বিদেশি ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি পরিশোধ করা যাবে।
'একইসঙ্গে ইএফপিএফের আকার ৩০ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা উচিত, যার মাধ্যমে দেশের ভেতরে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি পেমেন্ট করা যাবে।'
নাম প্রকাশে অনিশ্চুক কয়েকজন রপ্তানিকারক ইডিএফের আকার কমানোর বিরোধিতাও করেন। তারা বলেন, ইডিএফের আকার কমানোর জন্য অন্তত আরও এক-দেড় বছর সময় নেওয়া দরকার। একইসঙ্গে ইডিএফের পরিমাণ কমালেও ইএফপিএফের আকার বাড়ানো উচিত বলে মন্তব্য করেন তারা।
ইডিএফের আকার কমায় তাদের সমস্যার জায়গাগুলো উল্লেখ করে একজন রপ্তানিকারক বলেন, 'আমরা আগে ডলারে ঋণ পেতাম, আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতাম ডলারে। কোনো সমস্যা ছিলো না। কিন্তু এখন ব্যাংক থেকে ঋণ পাব টাকায়, তারপর অন্য ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে হবে, যা বর্তমানে সহজে পাওয়া যায় না। এভাবে ডলার কিনতে গেলে অতিরিক্ত ৬ থেকে ৭ শতাংশ বাড়তি ব্যয় হয়।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসারে, ইএফপিএফ থেকে দেশের সব তফিসিলি ব্যাংক মাত্র ১.৫ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে পারবে, তবে রপ্তানিকারকরা ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ঋণ নিতে পারবে হবে ৪ শতাংশ সুদে। এই ঋণের ঋণের মেয়াদ হবে ১৮০ দিন। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে এ মেয়াদ আরও ৯০ দিন বাড়ানো যাবে।
ইএফপিএফের আওতায় ঋণগ্রহীতাভেদে ৫ কোটি টাকা থেকে ২০০ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া যাবে।
সম্ভাব্য ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্তাবলি নিয়ে আলোচনা করার জন্য গত ডিসেম্বরে ঢাকা সফর করে যাওয়া আইএমএফের প্রতিনিধিদলও বিদ্যমান ইডিএফ ঋণগুলোকে বাদ দিয়ে রিজার্ভ হিসাব করার পরামর্শ দেয় বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র টিবিএসকে জানিয়েছে।
বর্তমানে দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩১.২৮ বিলিয়ন ডলার। তবে আইএমএফের হিসাব বিবেচনায় নিয়ে গণনা করা হলে রিজার্ভের পরিমাণ প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার হবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র।