নতুন পে-স্কেল নয়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ২০ শতাংশ মহার্ঘভাতার প্রস্তাব
নতুন পে-স্কেলের প্রত্যাশায় থাকা সরকারি চাকরিজীবীরা পে-স্কেলের বদলে আগামী অর্থবছরে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পর্যন্ত মহার্ঘভাতা পেতে পারেন বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সূত্রের বরাতে জানা গেছে।
চলমান মূল্যস্ফীতির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়াকে বিবেচনায় নিয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে বিশেষ এ ভাতার জন্য প্রস্তাব তৈরি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
তবে বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত অর্থবিভাগের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, নতুন পে-স্কেল দেওয়া হবে না। নির্বাচনের বছরের আগামী বাজেটটি বর্তমান সরকারের মেয়াদের শেষ বাজেট।
নতুন বাজেটে স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ কিংবা এমপিওভূক্তি করার জন্যও কোনো বরাদ্দ থাকছে না বলে জানিয়েছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থবিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, মে মাসে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে বাজেট নিয়ে একটি চূড়ান্ত সভা হবে।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সরকারি চাকরিজীবীরা দীর্ঘদিন ধরে আসন্ন বাজেটে নতুন পে-স্কেলের আশা করছিলেন কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তা নাকচ করে দিয়েছেন। আগামী বাজেটে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছেন সরকার প্রধান।
চলতি অর্থবছরে বিভিন্ন খাতে ব্যয়সংকোচ করেছে সরকার। সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা থেকে ১,০৯৩ কোটি টাকা সাশ্রয় করা হয়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে বেতন-ভাতার জন্য মোট বরাদ্দ ছিল ৭৩,১৭৩ কোটি টাকা। তবে আসন্ন অর্থবছরে বেতন-ভাতাখাতে ৭৭,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রাক্কলন করেছে অর্থবিভাগ।
সাধারণত পাঁচ বছর পরপর নতুন পে-স্কেল ঘোষণা করে সরকার। ২০০৯ সালে সপ্তম পে-স্কেল কার্যকর করার পর ২০১৫ সালে প্রায় শতভাগ বেতন বাড়িয়ে নতুন পে-স্কেল কার্যকর করে সরকার। তারপর থেকে প্রতিবছর জুলাই মাসে ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট পাচ্ছেন চাকরিজীবীরা।
এরপর আট বছর কেটে গেছে এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে খাদ্যপণ্যসহ পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে উল্লেখ করে সরকারি চাকরিজীবীদের বিভিন্ন সংগঠন নতুন পে-স্কেলের দাবি তুলছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ উপাত্ত অনুযায়ী, এ বছরের মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯.৩৩ শতাংশ। আর গত বছরের একই সময়ে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৮.৩৯ শতাংশ।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতির প্রাক্কলন করা হয়েছে ৬ শতাংশে, যা বর্তমান অর্থবছরের মূল বাজেটের ৫.৬ শতাংশ ছিল।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি চাকরিজীবী প্রায় ১৪ লাখ। তবে সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকসহ এ সংখ্যা প্রায় ২২ লাখ।
মহার্ঘ্যভাতা মূল বেতনের সঙ্গে যুক্ত হয় না। ফলে তাদের বাড়িভাড়া ভাতাসহ অন্য কোনো ভাতার হেরফের হবে না।
মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পেরে উঠছে না বর্তমান ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট
অর্থবিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ২০১৫ সালে বাস্তবায়ন করা বেতন স্কেলের জন্য গঠিত পে-কমিশন নতুন করে আর কোন কমিশন গঠন না করার সুপারিশ করেছিল। তার বদলে এটি সরকারি চাকরিজীবীদের প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট দেওয়ার সুপারিশ করেছিল।
'বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতির হার ৫ শতাংশের বেশি হলে ইনক্রিমেন্টের হারও সে অনুযায়ী সমন্বয় করার পরামর্শও দিয়েছিল পে-কমিশন। কিন্তু সরকার ওই সুপারিশ বাস্তবায়ন করেনি। ফলে মূল্যস্ফীতির হার বেশি হলেও চাকরিজীবীরা ৫ শতাংশ হারেই ইনক্রিমেন্ট পাচ্ছেন,' বলেন তিনি।
'দ্রব্যমূল্য বেড়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সে বিবেচনায় আর্থিক সঙ্গতি বিবেচনা করে সরকার মহার্ঘ্যভাতা দিতে পারে। তবে এ মুহূর্তে নতুন করে পে-স্কেল দেওয়া যৌক্তিক হবে না,' মাহবুব আহমেদ বলেন।
সর্বশেষ পে-স্কেল বাস্তবায়নের পর এখন পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির হার বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, ২০১৫ সালে ১০০ টাকা দিয়ে যে পরিমাণ পণ্য ও সেবা কেনা যেত, একই পরিমাণ পণ্য ও সেবা এখন কিনতে ১৫৪ টাকা ব্যয় করতে হবে।
চাকরিজীবীদের জন্য বিশেষ ইনক্রিমেন্টের প্রস্তাব সিপিডি'র
সম্প্রতি বাজেট প্রস্তাবনা তুলে ধরার সময় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বলেছে, খাদ্য মূল্যস্ফীতি হার এখন ২৫ শতাংশ এবং নির্দিষ্ট আয়ের সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীরা এ সময়ে সবচেয়ে কষ্টে আছেন।
তাই এ সমস্যা মোকাবিলায় জরুরিভিত্তিতে সকল সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য একটি বিশেষ ইনক্রিমেন্ট দেওয়ার প্রস্তাব করে সংস্থাটি।
অন্য খাতে বরাদ্দ
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, সরকার শেষ বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আকার ও উপকারভোগীর সংখ্যা প্রায় ১০ শতাংশ হারে বাড়িয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে ভাতার পরিমাণও বাড়ানো হয়েছে। এ বছরও সব ধরনের ভাতার পরিমাণ ও উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিল মন্ত্রণালয়গুলো।
কিন্তু আনকন্ডিশনাল ক্যাশ ট্রান্সফার—যেখান থেকে সরাসরি দরিদ্র জনগোষ্ঠী লাভবান হন—সামাজিক নিরাপত্তার এমন কর্মসূচিতে এ বছর বরাদ্দ খুব বেশি বাড়ছে না। কেবল বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা এবং বিধবা ভাতার পরিমাণ বাড়িয়ে উপকারভোগীর সংখ্যা ৭.৩৫ লাখ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে ব্যয় বাড়বে ১,৫০০ কোটি টাকা।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসৃজন কর্মসূচিতে ২০২১-২২ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ১৬,৫০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ কমানো হয়েছে। আগামী বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ অপরিবর্তিত থাকবে।
ভিজিডি, ভিজিএফ-এর আওতায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য স্বল্পমূল্যে চাল সরবরাহ করে সরকার। টিসিবির মাধ্যমে বর্তমানে প্রায় এক কোটি পরিবারকে ভর্তুকি মূল্যে খাদ্যপণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে।
চলতি অর্থবছরে এসব খাতে বরাদ্দ ছিল ৫,৯৬৫ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে ৬,৭৭৭ কোটি টাকা। আগামী বাজেটে এ খাতে আরও ১,২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হবে।
তবে স্থানীয় পর্যায়ে রাস্তাঘাট মেরামত ও সংস্কার এবং বাঁধ নির্মানে প্রায় ৬,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ ও পানি উন্নয়ন বোর্ড।
দেশজুড়ে ছোট ছোট প্রকল্পের আওতায় এ অর্থ ব্যয় করতে চায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। প্রত্যেকটি প্রকল্পের ব্যয় ৫০ কোটি টাকার কম হওয়ায় এসব অর্থ ব্যয় করতে একনেকের অনুমোদন নিতে হবে না।
করোনাভাইরাস মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক পতনের দরুন গত অর্থবছর এবং চলতি অর্থবছর এ ধরনের প্রকল্পে অর্থ ব্যয় নিরুৎসাহিত করেছে সরকার।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, অপারেটিং খরচ কমিয়ে রাখতে এ দুটি খাতে বরাদ্দ দেওয়ার পক্ষে নয় সরকার। তবে মন্ত্রণালয়গুলোর চাপে শেষ পর্যন্ত খাত দুটিতে অর্থ বরাদ্দ রাখতে হতে পারে।