পরিবেশবান্ধব পারফর্মেন্স রেটিংয়ের আওতায় আসছে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো
দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর (ইকনোমিক জোন) উৎপাদন প্রক্রিয়াকে পরিবেশবান্ধব করার উদ্যোগ হিসেবে প্রথমবারের মত আন্তর্জাতিক সংস্থার আদলে ব্রোঞ্জ, সিলভার, গোল্ড ও প্লাটিনাম ক্যাটাগরি করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)।
মূলত বিশ্ববাজারে পরিবেশবান্ধব শিল্প থেকে উৎপাদনের চাহিদা ও ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ মাথায় রেখে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
গ্রিন অ্যান্ড রেজিলিয়েন্ট ইকনোমিক জোন (জিআরইজেড) নামে এ লক্ষ্যে নতুন একটি গাইডলাইন তৈরি করতে যাচ্ছে সরকার।
সোমবার সরকারের সংশ্লিষ্ট পক্ষ এবং ইকোনমিক জোনগুলোর প্রতিনিধিদের কাছে এই গাইডলাইনের খসড়া উপস্থাপন করতে রাজধানীর একটি হোটেলে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
খসড়া গাইডলাইন অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মত দেশের ইকোনমিক জোনগুলোকে পরিবেশ, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ব্যবস্থাপনা পারফর্মেন্সের ভিত্তিতে ব্রোঞ্জ, সিলভার, গোল্ড ও প্লাটিনাম ক্যাটাগরিতে রেটিং করা হবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে বিদেশে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বিশেষত তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল খাতের কারখানাগুলো ইউনাইটেড স্টেটস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি)-এর আওতায় পরিবেশবান্ধব হিসেবে পারফর্মেন্সের ভিত্তিতে লিড (লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভাইরনমেন্টাল ডিজাইন) সনদ পায়, যা মূলত শুরু হয় রানা প্লাজা পরবর্তী সময় থেকে।
দেশে বর্তমানে দুই শতাধিক লিড সনদপ্রাপ্ত কারখানা রয়েছে, যেখানে আলোচ্য চার ক্যাটাগরিতে সনদ দেওয়া হয়।
তবে স্থানীয়ভাবে পরিবেশবান্ধব কারখানা হিসেবে এভাবে ক্যাটাগরি করার উদ্যোগ এটিই প্রথম।
বাংলাদেশে সরকার ১০০টি ইকোনমিক জোন তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে, যার মধ্যে বেজা'র তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ৯২টি অনুমোদন পেয়েছে। সেখানে ১২টি ইকোমিক জোনে ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে শিল্পোৎপাদন। বাকি আরও ৩২টির অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ চলমান।
বেজা'র পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রাথমিকভাবে ৩টি ইকোনমিক জোনে আলোচ্য পরিবেশবান্ধব পারফর্মেন্সের ভিত্তিতে পাইলটিং কার্যক্রম শুরু হবে। এই তিনটির মধ্যে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর এবং নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে অবস্থিত মেঘনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকনোমিক জোনও রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরের প্রকল্প পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ফারুক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সোমবার আমরা প্রস্তাবিত গাইডলাইন সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর কাছে উপস্থাপন করেছি। শিগগিরই এটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হবে। সেখানে অনুমোদন পেলে আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে এটি চূড়ান্ত করে কার্যক্রম শুরু করা যাবে বলে আশা করছি।"
তিনি বলেন, "বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ৪৫০টি ইকোফ্রেন্ডলি রেটেড ইকোনমিক জোন রয়েছে। আমরা যদি এ ধরনের রেটিংয়ের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব হিসেবে জোনগুলোকে স্বীকৃতি দিতে পারি, তাহলে বিশ্বব্যাপী রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং এখানে বিনিয়োগ বাড়ারও সুযোগ তৈরি হবে।"
ঢাকা এক্সপোর্ট প্রোসেসিং জোনে (ডেপজা) অবস্থিত বাংলাদেশের অন্যতম বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান শাশা ডেনিমসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এটি খুবই সময়োপযোগী উদ্যোগ। কেননা বিশ্বব্যাপী এখন পরিবেশবান্ধব পণ্য উৎপাদনকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে বিনিয়োগকারীরা রেটিং দেখে এ ধরনের জোনে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেবেন।"
"পরিবেশবান্ধব হিসেবে স্বীকৃত ইকোনমিক জোনের পণ্য রপ্তানি বাড়ার সুযোগ তৈরি হবে এবং এসব জোনে বিনিয়োগও বাড়বে। ফলে জোনগুলোর মধ্যেও পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিযোগিতা তৈরি হবে," বলেন তিনি।
সোমবার সেমিনারে প্রধান অতিথি ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জেল হোসেন মিয়া বলেন, "ইউরোপী ইউনিয়ন কার্বন বর্ডার অ্যাডজাস্টমেন্ট মেকানিজম (সিবিএএম), ডিউ ডিলিজেন্স অ্যাক্টসহ বেশকিছু উদ্যোগ নিচ্ছে। ফলে সেসব দেশে রপ্তানিতে যোগ্য হতে হলে ইন্টারন্যাশনাল অব্লিইগেশন (আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা) মানতেই হবে।"
যেভাবে করা হবে পারফর্মেন্স রেটিং
জিআরইজেডের নির্দেশিকা অনুযায়ী, অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে মোটাদাগে ৪টি পারফর্মেন্স ইন্ডিকেটর বা নির্দেশকের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হবে। নির্দেশকগুলো হচ্ছে– ম্যানেজমেন্ট পারফর্মেন্স ইন্ডিকেটর, এনভায়রনমেন্ট পারফর্মেন্স ইন্ডিকেটর, সোশ্যাল পারফর্মেন্স ইন্ডিকেটর এবং ইকোনোমিক পারফর্মেন্স ইন্ডিকেটর। এই ৪টি ইন্ডিকেটরের আওতায় মোট ২১টি ক্রাইটেরিয়া (শর্ত) পূরণ করতে হবে।
আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ফারুক ব্যাখ্যা করেন, "প্রতিটি ক্রাইটেরিয়া পূরণে সর্বোচ্চ ৫ নম্বর পাওয়া যাবে; এভাবে সবগুলো ক্রাইটেরিয়া পুরেপুরি পূরণ করলে একটি জোন প্লাটিনাম বা সর্বোচ্চ পরিবেশবান্ধব হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।"
মেঘনা গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার সুমন চন্দ্র ভৌমিক টিবিএসকে বলেন, "বর্তমানে পরিবেশবান্ধব হিসেবে যেসব শর্ত রয়েছে, সেন্ট্রাল ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্টসহ (সিইটিপি) তার প্রায় শতভাগ আমরা অনুসরণ করছি। ফলে এটি চালু হলে আমাদের জোন প্লাটিনাম রেট পাবে বলে আশা করছি।"
আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতায় গুরুত্ব
সেমিনারে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক নাফিউল হাসান বলেন,"বর্তমানে লিড, আইএসও স্ট্যান্ডার্ডের কারখানা আছে। ইন্টারন্যাশনাল এক্সেপ্টেন্স বা আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা (স্থানীয় নতুন রেটিং উদ্যোগ) না পেলে বিনিয়োগকারীরা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে এর মুনাফা তুলতে পারবেন না।"
এছাড়া, এর কস্ট ইফেক্টিভ অ্যানালাইসিসে গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, "আমাদের ইনভেস্টরদের বুঝাতে হবে, এটা তাদের জন্য লাভজনক।" তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত কর্ম পরিকল্পনারও অনুরোধ জানান।
শামস মহমুদও মনে করেন, আন্তর্জাতিক ক্রাইটেরিয়াকে মাথায় রেখেই পারফর্মেন্স ক্রাইটেরিয়া তৈরি করা উচিত।
এদিকে আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ফারুক জানান, তারা বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে দেখছেন।