স্মার্ট বাংলাদেশ: প্রযুক্তিগত দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে নাগরিকের আয় বাড়ানোতে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার
স্মার্ট বাংলাদেশের পরিকল্পনায় নাগরিকদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে আর্থিক সংগতি বাড়াতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এজন্য অর্থনীতি, সমাজ ও সরকার ব্যবস্থায় ব্যাপকভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন 'স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্স'।
টাস্কফোর্সের প্রথম সভায় স্মার্ট বাংলাদেশের প্রধান চার স্তম্ভ- স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সমাজ ও স্মার্ট সরকার গঠনের জন্য মোটা দাগে ২১টি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রাগুলো প্রধানত দক্ষতা উন্নয়ন, ক্যাশলেস ও উদ্যোক্তামুখী অর্থনীতি, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক সরকার ব্যবস্থা এবং অন্তর্ভূক্তিমূলক, ন্যায়ভিত্তিক ও টেকসই সমাজ গঠনকে কেন্দ্র করে।
টাস্কফোর্সের সদস্য সচিব এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব মোঃ সামসুল আরেফিন টিবিএসকে বলেন, "পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নে অ্যাকশন প্লান তৈরির কাজ শুরু করা হয়েছে। ১৫ জন মন্ত্রীর নেতৃত্বে ১৫টি কমিটি গঠন করা হয়েছে। শীঘ্রই এসব কমিটির সদস্য সচিব বা ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি সভা করা হবে। যেখানে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেওয়া হবে। পাশাপাশি সকল মন্ত্রণালয়ের কাছে স্মার্ট বাংলাদেশ বিষয়ে তাদের পকিল্পনা ও চাহিদা জানতে চাওয়া হয়েছে। বেসরকারি খাত থেকেও পরামর্শ চাওয়া হয়েছে। এসব বিষয় থেকে সুনির্দিষ্ট ও সময়াবদ্ধ অ্যাকশন প্লান তৈরি করা হবে। কর্মপরিকল্পনাগুলোর একটি ডকুমেন্ট প্রকাশ করা হবে। কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী বিনিয়োগ পরিকল্পনায় নেওয়া হবে।"
স্মার্ট বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ কী জানতে চাইলে আইসিটি বিভাগের সচিব বলেন, "স্মার্ট বাংলাদেশ বিশাল পরিকল্পনা। এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জতো অবশ্যই রয়েছে। অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জনসাধারণ ও কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি। ভবিষ্যত প্রযু্ক্তির সাথে খাপ খাওয়ানোর উপযোগী করে জনসাধারণকে তৈরি করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এর পাশাপাশি ডাটা সিকিউরিটি আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ স্মার্ট বাংলাদেশের কার্যক্রমের বড় কাজ হচ্ছে পেপারলেস কার্যক্রম। সরকারি দপ্তরে কাগজের ব্যবহার জিরো পর্যায়ে নামিয়ে আনা। এক্ষেত্রে তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। আর সরকার চায় ক্যাশলেস সোসাইটি। এর অর্থ হচ্ছে মানুষের অর্থকড়ি ভার্চুয়ালি বা ক্লাউডে সংরক্ষণ ও লেনদেন। এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও খুব জরুরি। আরেকটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে কর্মসংস্থান কমে যাবে। সেক্ষেত্রে প্রযুক্তি খাতেই কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে।"
সরকার যেসব লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে তার কিছু স্বল্প মেয়াদে বা ২০২৫ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে। কিছু বাস্তবায়ন হবে মধ্যমেয়াদে বা ২০৩১ সালের মধ্যে। আর বাকি লক্ষ্যমাত্রাগুলো বাস্তবায়ন হবে দীর্ঘমেয়াদে বা ২০৪১ সালের মধ্যে।
সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়, সেজন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে সকল মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে কর্মপরিকল্পনা তৈরির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
১৫ জন মন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠন করা হয়েছে ১৫টি উপকমিটি। এসব কমিটি খাতভিত্তিক সমস্যা, সম্ভাবনা ও করণীয় নির্ধারণ করবে। পরবর্তীতে কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়ন অগ্রগতিও মনিটরিং করবে কমিটিগুলো।
তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব সামসুল আরেফিন এ বিষয়ে টিবিএসকে বলেন, এসব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকার নীতি সহায়তা দেবে। প্লাটফর্ম তৈরি করবে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করা হবে।
সরকার অনেকদিন ধরে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বললেও নতুন এই থিমের বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা ছিলো না। টাস্কফোর্সের নির্ধারণ করা লক্ষ্যমাত্রাগুলোর মাধ্যমে তা পরিষ্কার হলো।
২০২২ সালের আগস্টে স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। এরপর চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় এ বিষয়ে ধারণা দেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন অর্জনে স্মার্ট বাংলাদেশ কার্যক্রম কার্যকরী ভূমিকা রাখবে। স্মার্ট বাংলাদেশে নাগরিকের মাথাপিছু আয় হবে ১২,৫০০ মার্কিন ডলার। দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকবে ৩ শতাংশের কম মানুষ। চরম দারিদ্র্য নেমে আসবে শূন্যের কোটায়। মূল্যস্ফীতি নেমে আসবে ৪-৫ শতাংশের মধ্যে। বাজেট ঘাটতি থাকবে ৫% এর নিচে। রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত হবে ২০% এর ওপরে। বিনিয়োগ হবে জিডিপির ৪০%। শতভাগ ডিজিটাল অর্থনীতি আর বিজ্ঞান প্রযুক্তিভিত্তিক স্বাক্ষরতা অর্জিত হবে। সকলের দোড়গোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে যাবে। তৈরি হবে পেপারলেস ও ক্যাশলেস সোসাইটি। সবচেয়ে বড় কথা স্মার্ট বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা।
স্মার্ট সিটিজেন
নাগরিকদের 'স্মার্ট সিটিজেন' হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সরকার দক্ষতা উন্নয়ন ও উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। সরকারের পরিকল্পনা উদ্যোক্তা সৃষ্টি কার্যক্রম তৃণমূল পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। স্মার্ট কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে সরকারের পরিকল্পনায় রয়েছে জাতীয় উদ্যোক্তা ইকোসিস্টেম গড়ে তোলা। 'ওয়ান ফ্যামিলি, ওয়ান সিড' কার্যক্রমের আওতায় ২০৪১ সালের মধ্যে দেশের সকল পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর পরিবারের কমপক্ষে একজন সদস্যের জন্য স্মার্ট এমপ্লয়মেন্ট ও অন্ট্রাপ্রেনারশিপ ডেভেলপমেন্ট (সিড) ভিত্তিক সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। এর বাইরে স্বল্পমেয়াদে ডিজিটাল দক্ষতার সূচক ৫০% এ উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে স্মার্ট ডিভাইসের ব্যবহার ৬০% এ নেওয়া, সরকারি-বেসরকারি সেবা তৈরিতে নাগরিকদের ই-পার্টিসিপেশনের সুযোগ সৃষ্টি এবং শিক্ষার সাথে দক্ষতাকে সংযুক্ত করে সময়াবদ্ধ ব্লেন্ডেড শিক্ষা ও দক্ষতা মহাপরিকল্পনার কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে।
স্মার্ট ইকোনোমি
স্মার্ট ইকোনোমি গড়ার ক্ষেত্রে সরকার জোর দিয়েছে ক্যাশলেস লেনদেন, মাথাপিছু আয় বাড়ানো এবং দারিদ্র্য কমানোতে। এজন্য কুটির, মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ বা ছোট ছোট শিল্পসহ বেসরকারি খাতের ডিজিটালাইজেশনে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
স্বল্প মেয়াদে সরকারের লক্ষ্য ক্যাশলেস লেনদেন ৩০% এ নিয়ে যাওয়া। এরপর মধ্যমেয়াদে অর্থাৎ ২০৩১ সালের মধ্যে দেশের সকল লেনদেনেই নগদবিহীন করার লক্ষ্য নিয়েছে সরকার। এছাড়া ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের জিডিপিতে ১% টোটাল ফ্যাক্টর প্রডাকটিভিটি (টিএফপি) সৃষ্টি করা হবে। পরবর্তী ধাপে এই প্রবৃদ্ধি ২.৫% এ নিয়ে যেতে চায় সরকার।
এছাড়া ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজিতে সক্ষমতা বাড়ানো, ইউনিকর্ন স্টাটআপ স্থাপন এবং ব্যবসার সম্ভাবনা বাড়ানোর জন্য একটি কার্যকর সেবা প্লাটফর্ম তৈরি করা হবে।
সরকার ব্যবসা সহজ করার মাধ্যমে ২০৩১ সালের মধ্যে দেশের জিডিপিতে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের (এফডিআই) অবদান ৩% এ নিতে চায় এবং ২০৪১ এরমধ্যে বাংলাদেশকে ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজির আঞ্চলিক রপ্তানি হাব হিসেবে গড়ে তুলতে চায়।
স্মার্ট গভর্মেন্ট
এই অংশে সরকারের প্রথম লক্ষ্য ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনা, যা ভূমি মন্ত্রণালয় শুরু করেছে। এরপরেই রয়েছে মানসম্পন্ন সার্বজনীন স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা। স্বল্প মেয়াদের মধ্যে কাগজবিহীন, সহজ ও নাগরিকবান্ধব সেবা নিশ্চিত করা হবে। মধ্য মেয়াদে সকল সেবা কাগজবিহীন এবং পারসোনালাইহজড করা হবে। আর উন্নত দেশের রূপান্তরের আগেই ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি পরিচালিত ব্যক্তি চাহিদা অনুযায়ী সেবা দেওয়া হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ স্ট্যাকের মাধ্যমে সেবা দিবে সরকার।
সরকার জাতিসংঘের ই-গভ ডেভেলপমেন্ট সূচকে ২০২৫ সালের মধ্যে ১০০টি দেশের মধ্যে ঢুকতে চায়। সরকারের লক্ষ্য ২০৩১ সালে ৭০ দেশের মধ্যে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৫০ দেশের মধ্যে থাকা।
প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরকার কর-জিডিপি অনুপাত ২০২৫ সালের মধ্যেই ১২% এর বেশি নিতে চায়। এছাড়া ২০৩১ সালে এই অনুপাত ১৭% এবং ২০৪১ সালে ২২% এ নিতে চায়।
স্মার্ট সোসাইটি
স্মার্ট সোসাইটি গঠনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি পরিচালিত সেবা প্রদানে। সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০% এর বেশি আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে চায়। ২০৩১ সালের মধ্যে শতভাগ আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা সরকারের লক্ষ্য। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি হচ্ছে আয় বা সঞ্চয় নির্বিশেষে সকল মানুষের ব্যাংকিং ও আর্থিক সেবা নিশ্চিত করা।
গ্লোবাল সাইবার সিকিউরিটি ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান উপরে তোলার লক্ষ্য রয়েছে। স্বল্প মেয়াদে বাংলাদেশ এই সূচকে ৩০তম অবস্থানে আসতে চায়। ২০৩১ সালে বিশ্বের ২৫টি দেশের মধ্যে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ২০টি দেশের মধ্যে উন্নীত হওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
স্মার্ট বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ
এত পরিকল্পনা সত্ত্বেও স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে চ্যালেঞ্জ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এজন্য বিপুল বিনিয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করতে হবে, যেখানে চ্যালেঞ্জটা বেশি। বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা এজন্য গবেষণা ও উন্নয়নে অর্থায়ন বহুগুণ বাড়ানোর প্রস্তাব করছেন। মানুষ যাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অর্জন করতে পারে সেজন্য ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেন। বাংলাদেশের সামনে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তির সাথে তাল মেলানো। এজন্য তরুণ সমাজকে দক্ষ করে গড়ে তোলাও চ্যালেঞ্জ।
টাস্কফোর্সের প্রথম সভায় অংশ নিয়ে শিক্ষাবিদ ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, গবেষণা ও উন্নয়নে অর্থায়ন বাড়ানোর পাশাপাশি গবেষণার সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির পরামর্শ দেন।
বেসিসের সভাপতি রাসেল টি রহমান বলেন, মেগা প্রকল্পগুলোতে বিদেশি প্রতিষ্ঠান সম্পৃক্ত থাকে। তিনি দেশীয় প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রযুক্তি হস্তান্তরের ব্যবস্থা রাখার সুপারিশ করেন।