জুলাই-ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোর সিএসআর ব্যয় ৩৮% কমেছে
২০২৩ সালের শেষ ছয় মাসে স্বাস্থ্য এবং জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সংরক্ষণ খাতে দেশের ব্যাংকগুলোর কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি বা সিএসআর ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, ব্যাংকগুলোর অগ্রাধিকারের তালিকায় পরিবর্তন এসেছে অথবা আর্থিক সংকটের কারণে ব্যয় কমানো হয়েছে।
বুধবার (২৭ মার্চ) প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত সিএসআর ব্যয় কমেছে প্রায় ৬৭ শতাংশ। ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে এই ব্যয় ছিল ২১৬ কোটি টাকা, যা দ্বিতীয়ার্ধে ৭২ কোটি টাকায় নেমে আসে।
একইভাবে, জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সংরক্ষণ সংক্রান্ত ইস্যুতে সিএসআর ব্যয় আগের বছরের প্রথমার্ধের প্রায় ৫০ কোটি টাকা থেকে কমে দ্বিতীয়ার্ধে ১৪.৩২ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।
সব মিলিয়ে মাত্র ৬ মাসের ব্যবধানে ব্যাংকের সিএসআর ব্যয় ৩৮ শতাংশ কমেছে। ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকের মোট সিএসআর ব্যয় ছিল ৫৭১.২৫ কোটি টাকা। একই বছরের শেষ ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) সেই ব্যয় কমে ৩৫৩.০৮ কোটিতে নেমেছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, আর্থিক সংকটের কারণে ব্যাংকের মুনাফার হার কমে গেছে। তাছাড়া, ব্যাংকের ব্যয় কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও নির্দেশনা রয়েছে। এসব কারণে কমে এসেছে ব্যাংক খাতের সামাজিক ব্যয়।
বুধবার (২৭ মার্চ) বাংলাদেশ ব্যাংকের সিএসআর সংক্রান্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে এসব তথ্য। আলোচিত এই সময়ে সিএসআর ব্যয় কমেছে বেশিরভাগ খাতেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক টিবিএসকে বলেন, "গত বছর থেকে কন্ট্রাকশনারি মানিটরি পলিসি গ্রহণ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে লিকুইডিটি টাইট হয়েছে। এই অবস্থায় সবাই খরচ কমানোর চেষ্টায় আছে। তাছাড়া, আগের তুলনায় ব্যাংকের নিট মুনাফা কমার কারণে ব্যাংক খাতের সিএসআর ব্যয় কমতে পারে বলে।"
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মোট সিএসআর ব্যয়ের ৩০ শতাংশ শিক্ষা খাতে, ৩০ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে এবং ২০ শতাংশ পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রশমন ও অভিযোজন খাতে ব্যয় করতে হবে। বাকি ২০ শতাংশ ব্যয় করতে হবে আয়-উৎসারী কাজ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো উন্নয়ন, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি এবং অন্যান্য খাতে।
হিসাব অনুযায়ী সিএসআর খাতে ২০২৩ সালে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) ৯২৪.৩২ কোটি ব্যয় করেছে ব্যাংকগুলো, যা আগের বছরের তুলনায় ১৮ শতাংশ বা ২০৪.৬৭ কোটি টাকা কম। ২০২২ সালে এ খাতে ব্যয় করা হয়েছিল ১,১২৯ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ৬১টি তফসিলি ব্যাংক ২০২৩ সালে ৯২৪.৩২ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে, যা মোট খরচের ৩১.২৬ শতাংশ বা ২৮৯ কোটি টাকা। শিক্ষা খাতে ব্যয় হয়েছে ১৬৩.১০ কোটি বা ১৭.৬৫শতাংশ। পরিবেশ ও জলবায়ু খাতে ৬৮.১৭ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, যা মোট খরচের ৭.৩৮ শতাংশ। এছাড়া, অন্যান্য খাতে ব্যয় হয়েছে ৪০৪ কোটি টাকা, যা মোট ব্যয়ের ৪৩.৭২ শতাংশ।
প্রতিবেদন বলছে, দেশে কার্যরত তফসিলি ব্যাংকগুলোর মধ্যে ২০২৩ সালে ৫টি ব্যাংক এক টাকাও সিএসআরে ব্যয় করেনি। এগুলো হলো– বেসিক ব্যাংক, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিটিজেনস ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক এবং ন্যাশনাল ব্যাংক।
অন্যদিকে, ২০২২ সালে ৯টি ব্যাংক নিট মুনাফা অর্জন করতে পারেনি। সেগুলো হলো– বেসিক ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিটিজেনস ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক এবং ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান।
তবে এ ৯ ব্যাংকের মধ্যে ৫টি নিট মুনাফা অর্জন না করা সত্ত্বেও ২০২৩ সালে সিএসআরে ব্যয় করেছে। ব্যাংকগুলো হলো– বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক।
২০১৩ সালের পর লাইসেন্স পাওয়া ১৩টি ব্যাংকে আগের বছরের নিট মুনাফার অন্তত ১০ শতাংশ পরবর্তী বছরে সিএসআর খাতে ব্যয়ের শর্ত রয়েছে। কোনো ব্যাংক নিট মুনাফা করতে না পারলে তারা সিএসআরে ব্যয় করতে পারবে না। নতুন ব্যাংকের বাইরে অন্য ব্যাংক সিএসআরে খরচ করবে কি না, তাদের নিজস্ব বিষয়।
পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চতুর্থ প্রজন্মের ৬টি ব্যাংক (সাউথ-বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক লিমিটেড, মিডল্যান্ড ব্যাংক লিমিটেড, মধুমতী ব্যাংক লিমিটেড, সীমান্ত ব্যাংক পিএলসি, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক পিএলসি ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি) আলোচিত সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শর্ত পরিপালনে ব্যর্থ হয়েছে।
ব্যাংকগুলোর মধ্যে বরাবরের মতো এবারও সবচেয়ে বেশি সিএসআর ব্যয় করেছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ। ২০২৩ সালে ব্যাংকটি এ খাতে ব্যয় করেছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯৪ কোটি টাকা ব্যয় করেছে ডাচ-বাংলা ব্যাংক। যমুনা ব্যাংক ৫৬.৭৩ কোটি টাকা ব্যয় করে তৃতীয় অবস্থানে আছে। পর্যায়ক্রমে মার্কেন্টাইল ৫৫.৯২ কোটি, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ৫৩.৬২ কোটি, আল-আরাফাহ ৫১.৩২ কোটি, এক্সিম ৪৩.৯৩ কোটি, সাউথইস্ট ব্যাংক ৩৯.৬৯ কোটি, ইউসিবি ৩৮.৪০ কোটি এবং ব্যাংক এশিয়া ৩২.৬৩ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সিএসআর খাতে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আলোচ্য সময়ে সিএসআর খাতে ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যয়ে করেছে ৫.৩৬ কোটি টাকা। এরমধ্যে স্বাস্থ্য খাতে ৩৮ শতাংশ, শিক্ষায় ৩০ শতাংশ এবং পরিবেশ ও জলবায়ু খাতে ২১ শতাংশ ব্যয় করেছে।