ডলারের মূল্য ও ব্যয় বৃদ্ধির ধাক্কা সইতে পারছেন না যশোরের অটো পার্টস ব্যবসায়ীরা
ডলারের ক্রমবর্ধমান মূল্য, দুই অঙ্কের ঋণের সুদহার, মূল্যস্ফীতি ও পরিচালন খরচ বৃদ্ধির ফলে হুমকিতে পড়ে গেছে যশোরের মোটর যন্ত্রাংশ ব্যবসার অস্তিত্ব।
অটোমোটিভ পার্টস ব্যবসার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে যশোর। স্বনামধন্য পরিবহন কোম্পানিকে যন্ত্রাংশ সরবরাহ করা হয় এখান থেকে। দেশের মোটর যন্ত্রাংশের চাহিদার বড় একটি অংশ এখন মেটায় এ জেলার হালকা প্রকৌশল শিল্প।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত দুই বছরে ডলারের দাম বেড়েছে প্রায় ৪৫ শতাংশ। এর জেরে আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এতে ভোক্তারা পার্টস কেনা থেকে বিরত থাকছেন।
তারা বলেন, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির চাপও আছে। তার সঙ্গে সুদের হার আবার দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছেছে। দুই বছর ধরে এভাবে তাদের ব্যবসার মুনাফার মার্জিন কমে গেছে। এসবের ধাক্কা আর সইতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা।
যশোর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান খান টিবিএসকে বলেন, 'ডলার সংকট ও বিনিময় হার বৃদ্ধির কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন গাড়ি ও পার্টস আমদানিকারকরা। এলসি [ঋণপত্র] খোলা বন্ধ থাকার কারণে খাদ্যপণ্য ছাড়া সব আমদানিকারক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে একদিকে ব্যবসায়ীরা খেলাপি হয়ে পড়ছেন, অন্যদিকে এ খাতে কর্মসংস্থান নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা।
তিনি বলেন, ২০২২ সালে ডলারের দাম ছিল ৮৫-৮৬ টাকা, আর বর্তমান দর দাঁড়িয়েছে ১১৭ টাকা। কিন্তু আমদানিকারকরা ডলার কিনছেন ১২৩-১২৫ টাকায়। ফলে কাঁচামাল বা পণ্য আমদানির খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এতে ব্যবসার প্রতিযোগিতাসক্ষমতা কমে যাচ্ছে।
যশোর শহরের আরএন রোড মোটরপার্টস ও মোটর সাইকলে পার্টসজোন হিসেবে সবস্থানে পরিচিত। এখানে হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়ে থাকে।
ব্যবসার খরচ কমাতে না পারলে ব্যবসায়ীদের টিকে থাকা সম্ভব না উল্লেখ করে মিজানুর রহমান খান বলেন, সরকারের উচিত এ সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া।
দেশে ব্যবসার খরচ যে বাড়ছে, তা বিভিন্ন গবেষণায়ও উঠে এসেছে।
বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড) গত বছর ব্যবসার আস্থা সূচক নিয়ে বার্ষিক প্রতিবেদনে বলেছে, সামগ্রিকভাবে ব্যবসাসংক্রান্ত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের আস্থা বাড়লেও উৎপাদনে ব্যবহার করা কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি এবং বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, অফিসভাড়া ও অন্যান্য সরঞ্জামসংক্রান্ত ব্যয়ের বোঝা বাড়ছে। এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আগামী দিনগুলোতে উদ্যোক্তাদের কপালের চিন্তার ভাঁজ আরও চওড়া হতে পারে।
বাংলাদেশ মোটরপার্টস ও টায়ার টিউব ব্যবসায়ী সমিতি যশোর শাখার সভাপতি শাহিনুর হোসেন ঠান্ডু বলেন, 'যশোরে প্রায় ২ হাজার মোটর পার্টস ও মোটরসাইকেল পার্টসের দোকান রয়েছে, যেখানে কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে। এর বেশিরভাগই ব্যাংকঋণ।
তিনি বলেন, 'এই ২ হাজার দোকানে প্রায় ২০ হাজার কর্মচারী রয়েছে, যাদের বেতন ৭ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।
'কিন্তু গত দুই বছর ধরে এলসি খোলা কঠিন হয়ে যাওয়ায় বেশিরভাগ ব্যবসায়ী ব্যবসা করতে পারছেন না। কিছু বড় ব্যবসায়ী পণ্য আনলেও ডলারের কারণে খরচ বাড়ছে তাদেরও। এদিকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি তাদের কর্মীরাও এখন নিজেদের ব্যবসার ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন।'
যশোর-খুলনা মহাসড়কের পাশে অবস্থিত ফারিয়া মোর্টরসের স্বত্বাধিকারী ও আমদানিকারক রোজোয়ান আহমদ মুরাদ জানান, 'করোনায় গত দুই বছর ব্যবসা হয়নি। কোনোরকমে টিকে আছি। পুঁজি ভেঙে কর্মচারীদের বেতন দিয়েছি।
'এখন ঠিকমতো এলসি খুলতে না পারার কারণে পণ্য আমদানি করতে পারছি না। ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাবার কারণে আমাদের পণ্য আমদানিতে খরচ অনেক বেড়েছে। পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে ক্রেতারা খুব প্রয়োজন ছাড়া মাল কিনছেন না। সব মিলিয়ে ব্যবসার অবস্থা কী হবে বুঝতে পারছি না।'
বৃহৎ মোটরসাইকেল পাটর্স আমদানিকারক রিপন অটোস প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান এজাজ উদ্দিন টিপু বলেন, 'ডলারের বিনিময় হার প্রতিনিয়িত বেড়েই চলেছে। আবার সরকার-নির্ধারিত দামে ডলার মিলছে না। এতে করে পণ্য আমদানি খরচ প্রতিনিয়ত বাড়ছে, যার প্রভাব পড়ছে বিক্রিতে। ক্রেতারা ডলারের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি বুঝতে চায় না।'
এজাজ বলেন, এসব কারণে অটো পার্টস খাতে সবারই ব্যবসায় মন্দাভাব চলছে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা টিকতে পারছেন না।
বেনাপোল কাস্টমের রাজস্ব আহরণের সিংহভাগ আসে উচ্চ শুল্কযুক্ত গাড়ির চেসিস ও মোটর পার্টস আমদানি থেকে।
কিন্তু মোটর পার্টসের আমদানি কমে যাওয়ায় চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কাস্টমসে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব কম আদায় হয়েছে বলে জানান বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শামসুর রহমান।
এব্যাপারে বেনাপোল কাস্টম হাউজের যুগ্ম কমিশনার শেফায়েত হোসেনও জানান, মোটর পার্টস আমদানি কমায় রাজস্ব আয়ও কমেছে।