সরকারের বোরো ধান সংগ্রহে লাভবান হতে পারছেন না কৃষকরা
চলতি বোরো মৌসুমেও প্রতিমণ ধান ৯০০ থেকে ১,০০০ টাকায় বিক্রি করে লোকসানে পড়েছেন কৃষকরা। যদিও সরকার কৃষকদের কাছ থেকে মণপ্রতি ১,২৮০ টাকায় ধান কেনার ঘোষণা দিয়েছে— তবে সরকারের দেওয়া এই দামের সুযোগ নিতে না পেরে লোকসানেই ফসল বিক্রি করতে হচ্ছে চাষীদের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষকের ধান কাটার সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ধান কেনার তারিখ ঘোষণা, বাজারে প্রতিযোগীতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারায় প্রতি বছরই ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষকরা।
খাদ্য মন্ত্রণালয় গত ২১ এপ্রিল দেশব্যাপী প্রতিকেজি ধান ৩২ টাকায় সংগ্রহের ঘোষণা দেয়। চলতি বছরে ৫ লাখ টন ধান সংগ্রহের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে— যা ৭ মে থেকে শুরু হয়ে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত চলবে।
ধান কেনার ঘোষণা দেওয়ার দিন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, এ বছর বেশি ধান কেনা হবে হাওর থেকে। কৃষক যাতে ন্যায্য মূল্য পান, সেজন্য এবার ধানের দাম কেজিতে ২ টাকা বাড়ানো হয়েছে এবং এতে কৃষকরা উৎসাহিত হবেন।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুসারে, হাওরগুলোতে ধান কাটা শুরু হয় ১৫ এপ্রিল এবং মে মাস শুরু হতেই হাওরের বেশিরভাগ ধান কাটা শেষ হয়ে যায়। যখন কিনা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ধান কেনা শুরুই হয়নি। গত ২ জুনের কৃষি বিভাগের তথ্য বলছে, সারাদেশে ৯৪ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে।
এদিকে, ধান সংগ্রহ কার্যক্রম শুরুর প্রায় একমাসে সরকার মাত্র ৩৮,১২০ মেট্রিক টন ধান কিনতে পেরেছে।
লাভবান হতে পারছেন না কৃষকরা
জানা গেছে, ফসল ওঠার পর গ্রামের কৃষকদের উপজেলা খাদ্য গুদামে গিয়ে ধান দিয়ে আসতে হয়– এ সময় ধানের আদ্রতা থাকতে হয় ১৪ শতাংশ। সংকট তৈরি হয় এই আদ্রতা নিয়েই। নির্ধারিত আদ্রতার বেশি হলে, ধান ফেরত দেওয়া হয়।
ফলে গাড়ি ভাড়া করে খাদ্য গুদামে নিয়ে যাওয়া, আবার যদি আর্দ্রতার শর্ত পূরণ না হয়, তা ফেরত নিয়ে আসা— এসব জটিলতার কারণে কৃষকরা সেখানে যেতে চান না। আবার রাজনৈতিক প্রভাবও এখানে কাজ করে। অনেক সময় প্রভাশালী ব্যক্তিরা কৃষকের নামে সরকারের কাছে ধান বিক্রি করেন।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খাদ্য ও সরবরাহ বিভাগের ওয়েবসাইট সূত্রে জানা যায়— সেখানে সরকার যখন ধান কেনে, তখন পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সবগুলো ব্লকের বাজারে বাজারে একটি করে ক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। তারা ১৭ শতাংশ আর্দ্রতাসম্পন্ন ধান কেনে কৃষকদের কাছ থেকে।
তবে বাংলাদেশের বাজারে এ ধরনের ক্রয়কেন্দ্র স্থাপনের নজির নেই।
কোনো মধ্যসত্ত্বভোগী যদি বাজার থেকে বা কৃষকের জমি থেকে ১,০০০ টাকায় ভেজা ধান কিনে নেন এবং সেটি শুকিয়ে ৫ কেজি লোকসান হিসাব করেন— তারপরও তার কেজিপ্রতি ধানের দাম পড়ে ২৮ টাকার কিছু বেশি। অন্যান্য খরচ মিলিয়ে ২৯ টাকা পড়লেও তিনি সরকারকে যদি ৩২ টাকায় দেন, তবুও কেজিতে ৩ টাকা করে লাভ থাকে— যা মনের হিসাবে ১২০ টাকা বা তারও বেশি।
গবেষকদের মতে, ধানের পরিমাণ নিয়েও সমস্যা রয়েছে। সরকারের উচিত চাল কেনা কমিয়ে, কৃষকের সহায়তার জন্য আরও বেশি পরিমাণে ধান কেনা। সেক্ষেত্রে বাজারে আরও বেশি প্রতিযোগীতার পরিবেশ তৈরি হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস টিবিএসকে বলেন, "যদি এলাকাভিত্তিক স্টোরেজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেত, সেখানে কৃষক ধান সংরক্ষণ করে টাকা নিতে পারতেন। যেটি দিয়ে দেনা পরিশোধ করে, বাকিটা ধীরে ধীরে বিক্রি করতে পারতেন।"
চাষের সময়ে করা বিভিন্ন খরচ যেমন— সেচ, সার, জামি চাষের বিপরীতে নেওয়া ঋণের টাকা পরিশোধের জন্য কৃষকরা প্রায়শই জমি থেকেই ধান বিক্রি করে দেন বলে জানান তিনি।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, "খাদ্য মন্ত্রণালয় নানান শর্তজুড়ে দিয়ে রাখে ধান কেনায়। যে কারণে কৃষকরা সেখানে ধান বিক্রিতে আগ্রহী হন না। এই জটিলতা দূর করে বিভিন্ন এজেন্টের মাধ্যমে বা গ্রামীণ বাজারগুলোতে বিক্রয়কেন্দ্র তৈরি করে যখন সরকার কৃষকের ধান কিনবে, তখনই বাজারে প্রতিযোগীতার পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হবে।"
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু গত ৩০ মে ঢাকা চেম্বারের এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, "কৃষকের কাছে বাড়তি টাকা থাকলে তাকে দ্রুত ধান বিক্রি করতে হতো না। সে একটা সময় পর্যন্ত রেখে দিয়ে ধীরে ধীরে বিক্রি করতে পারতো। আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো কমডিটি একচেঞ্জ (পণ্য বিনিময় মাধ্যম) থাকলে হয়তো এই সমস্যা কাটানো যেত। মানুষ বিনিয়োগ করলে সেই টাকা কৃষকের হাতে গেলে তাকে আর ক্ষতিগ্রস্ত হতে হতো না। এই বিনিয়োগের ব্যবস্থাটি করতে হবে।"
বাংলাদেশ উন্নয়ন সমীক্ষার খণ্ড ৪১, বার্ষিক সংখ্যা ১৪৩০ এ এক প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)। সেখানে 'বাংলাদেশে ক্ষুদ্র কৃষকদের টিকে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু?'- শিরোনামের এই প্রবন্ধটি লিখেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং বিআইডিএস'র প্রফেসরিয়াল ফেলো এম এ সাত্তার মন্ডল।
তিনি বলেন, "এতে আপাতত কৃষকের কিছু আর্থিক লাভ হলেও পরিণামে চাল উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় বার্ধিত পরিমাণে চাল আমদানির ওপর নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কাম্য নয়।"
সুবিধা লুটছেন মিলাররা
ধানের দাম কম হওয়ায় এখন সারাদেশের মিল মালিকরা সুবিধাটি ঘরে তুলছে। তারা সরকারের কাছে যে চাল লাভসহ ৪৫ টাকায় বিক্রি করছে, সেটিই বাজারে বিক্রি করছে ৫২ থেকে ৫৩ টাকায়।
এই সময়ে তারা মজুদ তৈরি করলেও কৃষকের হাতে ধান শেষ হওয়ার পর থেকেই ধানের বাড়তি দামের কথা বলে চালের দামও বাড়িয়ে দেন। অর্থাৎ, একদিকে যেমন কৃষক ঠকছে, অন্যদিকে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তার ওপরেও বছরজুড়ে চাপ থাকছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, "ধানটা মিলারদের কাছে চলে গেলে তারাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, ইচ্ছেমতো চালের দাম বাড়ায়। অথচ তারা কিন্তু কম দাম দিয়েই ধানটা সংগ্রহ করছে।"