বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরে চড়া দামেই পানি সরবরাহ করতে অটল কর্তৃপক্ষ
দেশের বৃহত্তম অর্থনৈতিক অঞ্চল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে মেঘনা নদী থেকে ১৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইনের মাধ্যমে বর্তমান বাজারদরের দ্বিগুণেরও বেশি দামে পানি সরবরাহ করা হবে।
শিল্প নগরে বিনিয়োগকারীদের আপত্তি সত্ত্বেও বিগত সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মনে করেছিল, প্রস্তাবিত এই দর ওয়াসার বর্তমান পানির বাজারদরের দ্বিগুণের চেয়ে বেশি হলেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনৈতিক অঞ্চলে সরবরাহ করা পানির দামের তুলনায় কম।
সূত্রমতে, এ প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি তায়েইয়াং ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন জিটুজি ভিত্তিতে (সরকারের সঙ্গে সরকারের চুক্তি) ১.৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। পাইপলাইন স্থাপনে কোম্পানিটি তিন বছর সময় নেওয়ার পর ১৯ বছর ধরে দৈনিক ২৫০ মিলিয়ন লিটার পানি সরবরাহ করবে।
সরবরাহকৃত প্রতি ১ হাজার লিটার পানির দাম পড়বে ৯১.৩০ টাকা। সার্ভিস চার্জসহ অন্যান্য খরচ যোগ করলে এর দাম হবে ০.৯১ ডলার, যা বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী প্রায় ১০৭ টাকা।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক সভায় এই শিল্প নগরে বিনিয়োগ করার জন্য জমি নেওয়া ব্যবসায়ীরা পানির প্রস্তাবিত দামের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। তারা বলেন, বেজা বর্তমানে ওয়াসার বাণিজ্যিক রেটে পানি সরবরাহ করছে। এতে প্রতি ১ হাজার লিটার পানির দাম পড়ছে প্রায় ৪৫ টাকা। অর্থাৎ বেজা বর্তমান রেটের চেয়ে দ্বিগুণ দাম ধরেছে।
কিন্তু গত ২৯ জুলাই এক সভায় অর্থ বিভাগ, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) অথরিটি ও এই পরিকল্পনাত নিয়েই এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের দাবি, তারা আলোচনার মাধ্যমে ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করেছে, আর বিকল্প কোনো ব্যবস্থা করতে গেলে তা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল হবে।
বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সারওয়ার বারী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, পানির বর্তমান বাজারদর বা ওয়াসার দরের তুলনায় মেঘনা নদী থেকে সরবরাহ করা পানির দাম বেশি হলেও প্রস্তাবিত দর অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে সরবরাহ করা পানির দরের চেয়ে কম।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে সরবরাহ করা প্রতি টন (১০১৮.৩২ লিটার) পানির দাম ১.৩০ ডলার থেকে ২ ডলার।
পিপিপি কর্তৃপক্ষের মহাপরিচালক মো. আবুল বাশার টিবিএসকে বলেন, পৃথিবীতে সর্বোচ্চ ৮৭ কিলোমিটার দূর থেকে পাইপলাইনে অর্থনৈতিক অঞ্চলে পানি সরবরাহ করার নজির রয়েছে। তা সত্ত্বেও কোনো দেশে ১ ডলারের কমে ১ হাজার লিটার পানি সরবরাহ করার নজির নেই।
'কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে পানি সরবরাহ করতে ১৫০ কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ পাইপলাইন স্থাপন করতে হচ্ছে। তারপরও আমরা কোরিয়ান পার্টির সঙ্গে আলোচনা করে প্রতি ইউনিট পানির দাম ০.৯১ ডলারে স্থির করেছি,' বলেন তিনি।
আবুল বাশার আরও বলেন, কোরিয়ান বিনিয়োগের ৭২ শতাংশ হবে পাইপলাইনের জন্য। তিন বছর নির্মাণকালসহ মোট ২২ বছর মেয়াদে পিপিপির ভিত্তিতে তারা এটি পরিচালনা করবে।
প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা সমীক্ষা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এখন বেজা, পিপিপি অথরিটি ও চট্টগ্রাম ওয়াসার মধ্যে একটি ত্রি-পক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পর পিপিপি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোরিয়ান বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের চুক্তি সই হবে বলে জানান তিনি। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে।
প্রকল্পের বিস্তারিত
পিপিপি কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, প্রস্তাবিত পাইপলাইনটির দৈর্ঘ্য ১৫০.৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে মেঘনা থেকে অপরিশোধিত পানি একটি পরিশোধনাগারে নিয়ে আসার জন্য ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন থাকবে। ১১৪.১ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন দিয়ে পরিশোধিত পানি পরিশোধনাগার থেকে জলাধারে নিয়ে আসা হবে। বাকি ১৭.৭ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন দিয়ে জলাধার থেকে শিল্প নগরে পানি সরবরাহ করা হবে।
কর্তৃপক্ষের একজন কর্মকর্তা বলেন, শিল্প নগর উন্নয়নে বিলম্ব এবং নির্ভরযোগ্য সমাধান হিসেবে মেঘনা নদী থেকে পানি আনার কোরিয়ার প্রস্তাবের কারণে প্রকল্পটি এখন অগ্রাধিকার পেয়েছে।
তিনি বলেন, 'প্রথম পর্যায়ে তারা দৈনিক ২৫০ মিলিয়ন লিটার পরিশোধিত পানি সরাসরি অর্থনৈতিক অঞ্চলে সরবরাহ করার পরিকল্পনা করেছে।' এ প্রকল্পের পরিসর বিশাল হওয়ার কারণে পানির দাম থেকে নির্মাণ ব্যয় ওঠানো হবে।
পিপিপি কর্তৃপক্ষের প্রাক্কলন অনুসারে, কোরিয়ান জিটুজি প্রস্তাবের উপর ভিত্তিতে ২০৩০ সালের মধ্যে পানি সরবরাহ শুরু হতে পারে। বিকল্প কোনো পদ্ধতিতে গেলে প্রকল্পটি অন্তত পাঁচ বছর বিলম্বিত করতে পারে।
কর্তৃপক্ষের দাবি, পানির দাম ন্যায্য।
৭-৮ বছর পানির চাহিদা মেটাতে পারবে বেজা
বেজার একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরের আয়তন হওয়ার কথা ছিল ৩৩ হাজার ৮০০ একর। তবে বর্তমানে এই শিল্পনগরের আওতায় জমি রয়েছে ১৭ হাজার একর, আরও ৪ হাজার একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এর বাইরে আর কোনো জমি পাওয়া যাবে না। এর আয়তন ৩৩ হাজার ৮০০ একর হলে দৈনিক ৯৫০ মিলিয়ন লিটার পানি লাগত। কিন্তু যে পরিমাণ জমি পাওয়া যাচ্ছে, তাতে পুরোটা শিল্পায়ন হলে দৈনিক প্রায় ৫৫০ মিলিয়ন লিটার পানির দরকার হবে।
বর্তমানে ফেনী নদীর মহুরী রিজার্ভার থেকে দৈনিক ৫০ মিলিয়ন লিটার পানি সরবরাহ করার প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এখান থেকে আরও ৫০ মিলিয়ন লিটার পানি সরবরাহ করতে প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হবে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে তিনটি সিইটিপি (পরিশোধনাগার) স্থাপন করা হবে, সেখান থেকে দৈনিক ৫০ মিলিয়ন লিটার পানি পুনর্ব্যবহার করার জন্য সরবরাহ করা হবে। এছাড়া ৯০ দৈনিক মিলিয়ন লিটার পানি ডি-স্যালাইন করে এই শিল্প নগরে সরবরাহ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
সব মিলিয়ে বেজার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এই শিল্পনগরের আগামী ৭-৮ বছরের পানির চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
পানির সংকটের কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে অধিক পানি ব্যবহার করে, এমন শিল্প-কারখানায় বিনিয়োগের জন্য জমি বরাদ্দ দেওয়া বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানান বেজার ওই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, 'স্টিল, সিমেন্ট, নিটিং ও ওয়াশিং প্ল্যান্টের মতো অধিক পানি ব্যবহারকারী শিল্পের জন্য জমি বরাদ্দ দেওয়া হবে না। এ ধরনের শিল্প মালিকদের জামালপুর, কুষ্টিয়া ও সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোনগুলোতে বিনিয়োগে উৎসাহী করছি আমরা। এসব ইকোনমিক জোন নদীর তীরে হওয়ায় পানি সরবরাহ করতে কোনো সমস্যা হবে না।'