পোশাকশিল্পের পর বাংলাদেশের পরবর্তী বৈদেশিক আয়ের খাত হতে পারে বৈশ্বিক খেলনা বাজার
বিশাল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও, বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা এখনও বৈশ্বিক খেলনার বাজারের পুরো সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারেননি। প্রয়োজনীয় নীতিগত সহায়তা পেলে তৈরি পোশাক শিল্পের (আরএমজি) পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হয়ে উঠতে পারে এটি।
শিল্প খাতের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন, অনেক আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ব্র্যান্ড তাদের ফ্যাশন পণ্যের পাশাপাশি খেলনার ব্যবসাও পরিচালনা করছে। এটি বাংলাদেশের জন্য বিশাল সম্ভাবনা হয়ে উঠতে পারে। তবে স্থানীয় বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান এ খাতের রপ্তানি সম্ভাবনা সম্পর্কে সচেতন নয়।
বাজার বিশ্লেষণ এবং ডেটা ফার্ম স্ট্যাটিস্টার পূর্বাভাস অনুযায়ী, বৈশ্বিক খেলনার বাজারের মূল্য ২০২৩ সালের ১০২.৮ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০৩২ সালে প্রায় ১৫০ বিলিয়নে ডলারে পৌঁছাবে।
বৈশ্বিক খেলনার বাজারে চীন বর্তমানে শীর্ষে রয়েছে, অনেকটা তৈরি পোশাক খাতের মতো। ২০২৩ সালে চীন খেলনা রপ্তানি থেকে ৮৮.৫৮ বিলিয়ন আয় করেছে, যা বৈশ্বিক বাজারের ৮৬ শতাংশেরও বেশি।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ গত অর্থবছরে মাত্র ৭৭ মিলিয়ন ডলার মূল্যের খেলনা রপ্তানি করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের খেলনা ৮৮টিরও বেশি দেশে পৌঁছালেও, এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান অনেকটাই পিছিয়ে।
তৈরি পোশাক খাতের মতো খেলনা শিল্পেও ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন করতে হয়। এই খাত চারটি প্রধান বিভাগে বিভক্ত– ধাতব খেলনা, কাঠের তৈরি খেলনা, প্লাস্টিকের খেলনা এবং কাপড়ের তৈরি খেলনা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের খেলনা রপ্তানিতে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোই প্রধান ভূমিকা পালন করছে। এ খাতে স্থানীয় ব্যবসাগুলোর অবদান তুলনামূলকভাবে খুবই কম।
খেলনার বৈশ্বিক বাজারে শিশুদের জন্য তৈরি হওয়া পণ্যের পাশাপাশি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যও বিভিন্ন ধরনের পণ্য রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী খেলনা, ইলেকট্রনিক খেলনা, অ্যাকশন ফিগার, ধাঁধা, বোর্ড গেম, শিক্ষামূলক কিট এবং আরও অনেক কিছু।
বিদেশি প্রতিষ্ঠানের দখলে বাংলাদেশের খেলনা রপ্তানি
সনিক (বাংলাদেশ) লিমিটেড দেশের বৃহত্তম খেলনা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। এটি হংকং ভিত্তিক সনিক গ্রুপের একটি সহপ্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির কারখানা নীলফামারীর উত্তরা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে অবস্থিত।
সনিক প্রতি মাসে এক মিলিয়ন ডাই-কাস্ট স্কেল মডেল তৈরি করে, যেখানে আন্তর্জাতিক র্যালি বিজয়ী গাড়ির মডেলও অন্তর্ভুক্ত। এর প্রধান রপ্তানি গন্তব্য ইউরোপের স্পেন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ইতালির মতো দেশ এবং এশিয়ার জাপান।
প্রতিষ্ঠানটি ইউরোপীয় বাজারে রপ্তানি হওয়া ডাই-কাস্ট মডেলের বৃহত্তম নির্মাতা, যা সব প্রধান গাড়ি ব্র্যান্ডের মডেল উৎপাদন করে।
১৯৮৮ সালে হংকংয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সনিক ইন্টারন্যাশনাল ২০১৩ সালে বাংলাদেশে এর নিজস্ব কারখানায় উৎপাদন শুরু করে।
ইপিবি-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে প্রতিষ্ঠানটি ৪৩.১৭ মিলিয়ন ডলার মূল্যের খেলনা রপ্তানি করে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কাপকেক গ্রুপের সহপ্রতিষ্ঠান কাপকেক এক্সপোর্টস লিমিটেড বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় সফট টয় বা খেলনা রপ্তানিকারক। ২০১৯ সালে মাত্র ৬৫ জন কর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু করা প্রতিষ্ঠানটি এখন ৬০০ জনের বেশি কর্মী নিয়ে কাজ করছে। কারখানাটির মোট বিনিয়োগ ছিল প্রায় ৩ মিলিয়ন ডলার।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইয়াসির ওবায়েদ টিবিএস-এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, "আমাদের প্রথম বছরে রপ্তানি আয় ছিল ৩৫ হাজার ডলার এবং এ বছর আমাদের রপ্তানি আয় ২.৫ মিলিয়নে পৌঁছাবে বলে আশা করছি।"
তিনি বলেন, "যেদিন আমরা উৎপাদন শুরু করি, সেদিন কোভিড-১৯ এর কারণে দেশব্যাপী লকডাউনের ঘোষণা দেয় সরকার। এটি আমাদের অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করে।"
ইয়াসির আরও বলেন, "২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কার্যক্রম পুনরায় শুরু হয় এবং প্রথম ক্রেতা ছিল ইউক্রেন থেকে। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের কারণে এই উদ্যোগ পরে বাধাগ্রস্ত হয়।"
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মাঝারি আকারের দোকান লক্ষ্য করে শুরু করলেও এখন বড় খুচরা বিক্রেতাদের দিকে মনোযোগ দিয়েছে কাপকেক এক্সপোর্টস।
তবে ইয়াসির উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ থেকে খেলনা রপ্তানি এখনও চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে, কারণ দেশে খেলনার জন্য নির্দিষ্ট ক্রেতা অফিসের অভাব রয়েছে।
বর্তমানে কাপকেক এক্সপোর্টস লিমিটেড ছয়জন ক্রেতার সঙ্গে কাজ করছে এবং আরও কয়েকজন ক্রেতাকে যুক্ত করার অপেক্ষায় রয়েছে। তবে, দেশে ক্রেতা অফিস না থাকার কারণে ব্যবসায়িক আলোচনার জন্য রপ্তানিকারকদের বিদেশে যেতে হয়, যা একটি বড় বাধা বলে ইয়াসির উল্লেখ করেন।
তিনি আরও জানান, ওয়ালমার্ট, ইন্ডিটেক্স এবং এইচঅ্যান্ডএম-এর মতো বড় খুচরা বিক্রেতাদের খেলনার বিভাগ রয়েছে। তবে তারা মূলত লাইসেন্সকৃত পণ্যে মনোযোগ দেয়। এই খাতে বাংলাদেশ এখনও সীমিত ভূমিকা পালন করছে, কারণ এটির জন্য নির্দিষ্ট সার্টিফিকেশন প্রয়োজন।
ইয়াসির আরও ব্যাখ্যা করেন, খেলনার লাইসেন্সিংয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম ডিজনি। তারা "বেটার ওয়ার্ক" প্রোগ্রামের মাধ্যমে লাইসেন্সকৃত পণ্য রপ্তানির সার্টিফিকেশন প্রদান করে। যদি বাংলাদেশের খেলনা শিল্প এই প্রোগ্রামের অন্তর্ভুক্ত হয়, তবে দেশি ও বিদেশি উভয় বিনিয়োগই আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই তৈরি পোশাক ও জুতা খাতে "বেটার ওয়ার্ক" উদ্যোগে অংশগ্রহণ করছে, যা খেলনা শিল্পের বিকাশের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। কাপকেকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরও জানান, যদি ডিজনি সহ এ ধরনের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাংলাদেশের উৎপাদন কার্যক্রমকে সম্পৃক্ত করা যায়, তবে এই খাতে বিশাল সম্ভাবনা গড়ে উঠবে।
স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের নীতিগত সহায়তায় বেড়ে উঠতে পারে
স্থানীয় রপ্তানিকারকরা বিশ্বাস করেন, যদিও চীন বর্তমানে বৈশ্বিক খেলনা বাজারে আধিপত্য বজায় রেখেছে, সঠিক সরকারি নীতিগত সহায়তা পেলে বাংলাদেশ আগামী দশকের মধ্যে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম খেলনা রপ্তানিকারক হতে পারবে।
প্লাস্টিকের তৈরি খেলনার প্রধান রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান প্রান-আরএফএল গ্রুপের মার্কেটিং পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল টিবিএসকে বলেন, বাংলাদেশকে বৈশ্বিক খেলনা বাজারে প্রবেশ করতে হলে সরকারি সহায়ক নীতি প্রয়োজন, যা এই খাতের বিকাশে সহায়ক হবে।
প্রতিষ্ঠানটি প্রাথমিকভাবে স্থানীয় বাজারের জন্য প্লাস্টিকের খেলনা উৎপাদন করত। তবে সম্প্রতি এটি কয়েকটি দেশে রপ্তানি বাড়িয়েছে।
এনবিআর-এর তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ১ মিলিয়ন ডলার মূল্যের প্লাস্টিকের খেলনা এবং ট্রাইসাইকেল রপ্তানি করেছে।
কামাল বলেন, এক সময় সম্পূর্ণভাবে আমদানির ওপর নির্ভরশীল স্থানীয় খেলনা বাজার এখন রপ্তানিমুখী শিল্পে পরিণত হয়েছে এবং বর্তমানে এটি দেশের ৮০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করছে।
প্রতিষ্ঠানটি এখনও কম দামে পণ্য রপ্তানির প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তবে এটি উচ্চমানের খেলনা বাজারে প্রবেশের মাধ্যমে রপ্তানি পোর্টফোলিও বৈচিত্র্যপূর্ণ করার সুযোগ দেখতে পাচ্ছে। কামাল বলেন, রপ্তানি বাজারে উপস্থিতি বাড়াতে প্রতিষ্ঠানটি ধীরে ধীরে রপ্তানি বাজারের জন্য উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াচ্ছে।
তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা কমলে বৈশ্বিক অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হবে, যেহেতু রপ্তানি বাড়াতে স্থিতিশীলতা সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
রপ্তানিকারকরা বলেন, আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের সাথে সম্পর্ক এবং সরবরাহ চেইন পরিচালনায় তৈরি পোশাক খাত থেকে যে অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে, তা খেলনা বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে একটি বড় সুবিধা হতে পারে; বিশেষ করে যেহেতু অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ড ইতোমধ্যে খেলনা পণ্য সরবরাহ করছে।
প্যাকেজিং এখনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ রপ্তানিকারকদের ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী প্যাকেজিং উপকরণ আমদানি করতে হয়। এছাড়াও পণ্যের পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ রপ্তানিকারকদের বর্তমানে নমুনা বিদেশে পাঠিয়ে মূল্যায়ন করতে হয়।
চীনের খেলনা শিল্পের পতনের সুবিধা নিতে পারে বাংলাদেশ
পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশ-এর প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ড. মাসরুর রিয়াজ বলেন, "২০১৬-১৭ সালে চীন বৈশ্বিক খেলনা বাজারের প্রায় ৯৮ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করত, তবে এখন তারা ধীরে ধীরে এই শিল্প থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।" পলিসি এক্সচেঞ্জ একটি বেসরকারি থিংক ট্যাংক, যা অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য কার্যকর পাবলিক নীতি ও বাজার সমাধান নিয়ে কাজ করে।
তিনি বলেন, প্লাস্টিকের খেলনা একটি কম খরচের শিল্প এবং চীনে মজুরি বাড়ানোর ফলে, দেশটি এই খাতে আর প্রতিযোগিতামূলক থাকতে পারবে না। এ পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য বাজারের একটি বড় অংশ দখল করার সুযোগ তৈরি করেছে, কারণ এটি একটি শ্রমঘন শিল্প।
"যদি আমরা সঠিক নীতিগুলো গ্রহণ করি, তবে বাংলাদেশ এই খাত থেকে সম্ভাব্যভাবে ১০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করতে সক্ষম হতে পারে," তিনি বলেন।
মাসরুর আরও বলেন, তৈরি পোশাক খাতের পর, বাংলাদেশে আর কোনো বৃহৎ রপ্তানি আয়ের খাত নেই। এবং চামড়া, হোম টেক্সটাইল, এবং ফ্রোজেন ফুডসের মতো খাতগুলোর রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলার থেকে ২ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে রয়েছে।