ফ্ল্যাটের বিক্রি ও বুকিং কমে গেছে ৩৫ শতাংশ
মূল্যস্ফীতির চাপ, নির্মাণ সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি ও জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রভাবে রাজধানীতে ফ্ল্যাট বিক্রি ও বুকিং গত এক বছরে প্রায় ৩৫ শতাংশ কমে গেছে।
রিয়েল এস্টেট ডেভেলপাররা বলছেন, মূলত ইস্পাত ও সিমেন্টের মতো কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ও নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) কারণে ফ্ল্যাটের নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ।
ড্যাপ পুনর্বিবেচনা না করা হলে দাম আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন আবাসন খাত সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকার আগারগাঁওয়ে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে পাঁচ দিনব্যাপী রিহ্যাব আবাসন মেলায় দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে আলাপকালে প্রায় ২৫টি আবাসন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসব কথা বলেন।
ডেভেলপাররা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছে, এমন কোম্পানিগুলোর ছোট ও মাঝারি ফ্লাট বিক্রি ২০ শতাংশ কমেছে। আর ১০ কোটি টাকার বেশি দামের ফ্ল্যাট বিক্রি কমেছে ৫০ শতাংশ।
গ্রীন হাট রিয়েল এস্টেটের পরিচালক মেজবা উদ্দিন মারুফ বলেন, আগের ছরের তুলনায় বিক্রি প্রায় ৩০–৩৫ শতাংশ কমে গেছে। বিশেষ করে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ঢাকায় ফ্ল্যাট বুকিং ও বিক্রি কমে গেছে।
তিনি বলেন, 'আগে যেখানে প্রতি মাসে ৫ থেকে ৮টি ফ্ল্যাট বিক্রি হতো প্রতি মাসে, এখন তা কমে ২টিতে দাঁড়িয়েছে। যাদের খুবই প্রয়োজন, তারা এখন কিনছেন। আর যাদের নিজেদের ফ্লাট আছে, তারা নতুন করে কম কিনছেন।'
এ প্রতিষ্ঠানের ৩০টির বেশি প্রকল্প চলমান আছে রাজধানীতে। সেখানে প্রায় ২০০ ফ্লাট বিক্রির জন্য রয়েছে। বনশ্রীতে প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের দাম ৫ হাজার ৫০০ থেকে ৬ হাজার টাকা, বসুন্ধরায় ৭ হাজার ৫০০ থেকে ৯ হাজার টাকা ও জলসিঁড়ি আবাসনে ৯ হাজার ৫০০ টাকা। এসব ফ্ল্যাটের আয়তন ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ বর্গফুট, আর জলসিঁড়ি আবাসনে ২ হাজার ৮৫০ বর্গফুট।
আক্তার এপিএল প্রপার্টিজ লিমিটেডের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মো. সাজ্জাদ মাসুদ বলেন, গত বছরের তুলনায় দাম বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরে ফ্ল্যাট বিক্রি করা হয়েছে ১১ হাজার টাকা প্রতি বর্গফুট।
তিনি বলেন, 'আমাদের প্রতিষ্ঠানের একটি সুনাম আছে। আমাদের টার্গেট ক্রেতা উচ্চ-মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত শ্রেণি। আমরা পণ্যের মানের দিকে কমপ্রোমাইজ করি না। কোয়ালিটি সব মানতে হলে সঠিক কাঁচামাল দিতে হয়। রড ও সিমেন্টই সব না। এখানে বিদ্যুৎ সাবস্টেশন, জেনারেটর, লিফট এগুলো বিদেশ থেকে আনতে হয়।
'এখন ডলারের দাম বেশি। এলসি খুলতে সমস্যা। মূল্যস্ফীতি বেশি, ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়াও কঠিন হয়ে যাচ্ছে।'
মাসুদ আরও বলেন, 'ড্যাপের কারণে ঢাকায় নতুন করে ভবন নির্মাণের যায়গা পাওয়া সংকট হয়ে যাচ্ছে। অনেক জায়গায় বলা হচ্ছে ৭ তলার ওপরে ভবন করা যাবে না। আমাদের কমপক্ষে ১০ তলার বিল্ডিং না করলে লোকসান হয়ে যায়। সব মিলে রাজধানীতের ফ্ল্যাটের দাম বাড়ছে।'
তিনি বলেন, ২০২২ থেকে শুরু হয়েছে ফ্ল্যাটের দাম বাড়া। এখন ক্রেতারা বুঝছেন যে দাম আর কমছে না। 'দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এটা আরও বাড়বে।'
চাপে ক্রেতারা
নির্মাণ সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে র্যাংকন রিয়েল এস্টেটের এজিএম এবং হেড অভ সেলস দেবব্রত রায় বলেন, 'যে কাঁচামাল ১০০ টাকা ছিল, সেটা এখন ১২৫ টাকা। এ টাকা তো ক্রেতাকেই সর্বশেষ দিতে হয়।'
তিনি বলেন, 'আমরা একটি শ্রেণির ক্রেতাদের কথা চিন্তায় রেখে পণ্য তৈরি করি। আমাদের একটি ফ্ল্যাটের দাম ৩ কোটি টাকার বেশি। ধানমন্ডি ও গুলশানে আছে ১৬ থেকে ৩২ কোটি টাকার ফ্ল্যাট। এগুলো ৪ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজার ৭০০ বর্গফুটের। তবে এ শ্রেণির ক্রেতাও এখন কমছে।'
ফ্ল্যাটের বিক্রি কমার চিত্র তুলে ধরে দেবব্রত বলেন, 'আমাদের মাসে ১৬-২০টি ফ্ল্যাট বিক্রি হতো। এটা এখন ২০ শতাংশ কমেছে। তবে আমাদের মতো বড় প্রতিষ্ঠান দিয়ে বিবেচনা হবে না। সার্বিকভাবে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কথা বিবেচনা করলে ৩৫-৪০ শতাংশ কমেছে বিক্রি।'
শেলটেক (প্রা.) লিমিটেডের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা শাহজাহান রায়হান বলেন, রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে এ বছর বিক্রি গত বছরের চেয়ে ২০ শতাংশ কম। 'গ্রাহকরা এখন এই খাতে বিনিয়োগ করতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছেন।'
শাহজাহান আরও বলেন, আগের বছরের তুলনায় চাহিদায় ভাটা পড়ায় ৫ আগস্টের পর কিছু নির্মাণসামগ্রীর দাম কমেছে। 'বর্তমানে প্রতি কেজি রডের দাম ৮১ থেকে ৮২ টাকা, যা এক বছর আগে ৯৬ টাকার বেশি ছিল। সিমেন্টের দামও কমেছে। গত বছর প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম ছিল ৫২০ টাকা, এখন তা কমে ৪৫০ টাকা হয়েছে।'
তবে বিনিময় হার ওঠানামার কারণে আমদানি করা ইলেকট্রোমেকানিক্যাল সরঞ্জাম, যেমন লিফট, জেনারেটর ও বিদ্যুৎ সাবস্টেশনের দাম বাড়ছে বলে জানান তিনি। এসবের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ফ্ল্যাটের সার্বিক নির্মাণ ব্যয় আরও বেড়ে যাচ্ছে।
ড্যাপ সংশোধনের দাবি রিহ্যাবের
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ—রিহ্যাবের সহ-সভাপতি (অর্থ) আবদুর রাজ্জাক বলেন, 'ডলারের রেট একসময় ছিল ৯০ টাকা, সেটা এখন ১২৫ টাকা। আমদানি করা পণ্যর দাম বেড়েছে ৪৫ থেকে ৫৫ শতাংশ। দুই বছর আগে দক্ষ শ্রমিকের মজুরি ছিল প্রতিদিন ৬০০ টাকা, এখন হয়ে গেছে ১ হাজার টাকা। এর ফলে দুই বছর আগে যে ফ্ল্যাটের দাম ছিল ১ কোটি টাকা, সেটা হয়ে গেছে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা।'
এখন ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকার ফ্ল্যাট বিক্রি বেশি হচ্ছে বলে জানান তিনি।
'নির্মাণসামগ্রীর উচ্চমূল্য, বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) বিধিনিষেধ ও ব্যাংকঋণের সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় আবাসন খাতে সংকট চলছে,' রাজ্জাক বলেন।
তিনি আরও বলেন, 'ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালা ২০০৮ মেনে আমরা ভবন তৈরি করতাম। তখন সাড়ে তিন কাঠা জমিতে ৮-তলা ভবন করা যেত। এখন ড্যাপ হওয়াতে মাত্র ৫-তলা ভবন করা যাচ্ছে।
'এর ফলে ওই জমি ডেভেলপার নিতে পারছে না। কারণ মালিককে ফক্তাট বুঝিয়ে দিয়ে লাভ থাকছে না। আমরা মনে করি, ড্যাপ সংশোধন হলে ফ্ল্যাটের দাম কিছুটা কমবে।'
ঋণের সুদহারও আবাসন খাতের জন্য উদ্বেগের বিষয় উল্লেখ করে রাজ্জাক বলেন, 'দুই বছর আগেও ৯ শতাংশ সুদে ফ্ল্যাট কেনার ঋণ পাওয়া যেত, এখন সেটা ১৪ শতাংশ হয়েছে। অনেকে ৫০ শতাংশ ঋণ নিয়ে সম্পত্তি কিনত। এখন তার খরচ বেড়েছে, তাই সার্বিকভাবে এখন একটি স্থবির অবস্থা আবাসন শিল্পে।'
বিবেচনাধীন রিহ্যাবের প্রস্তাব
২৩ ডিসেম্বর পাঁচ দিনব্যাপী আবাসন মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাজউক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সিদ্দিকুর রহমান সরকার বলেন, 'রিহ্যাব যেসব প্রস্তাব দিয়েছে, সেগুলো সরকার অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করছে।'
তিনি বলেন, 'ফ্লোর এরিয়া রেশিও ও ড্যাপের অন্যান্য বিধিমালা নিয়ে রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারদের কিছু দাবি পর্যালোচনা করা হচ্ছে।'
দুই সপ্তাহের মধ্যে নতুন ইমারত নির্মাণ বিধিমালার পর্যালোচনা শেষ হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
রাজউক চেয়ারম্যান আরও বলেন, 'বর্তমানে ভবনের নকশা অনুমোদন ও নির্মাণকাজের জন্য আলাদা নকশা করা হয়। এতে বসবাসের সনদ পেতে সমস্যা হয়। এখন থেকে প্রতিটি পর্যায়েই রাজউকের কর্মকর্তারা যুক্ত থাকবেন।'
ক্রেতাদের আগ্রহ
মেলা ঘুরে দেখা গেছে, মেলায় আসা অধিকাংশ দর্শনার্থীই ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ বর্গফুটের মাঝারি আকারের অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাট খুঁজেছেন। প্রথম সারির কোম্পানিগুলো ১ কোটি টাকার নিচে ফ্ল্যাট দিতে পারছে না।
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে এসেছিলেন নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, '১ কোটি টাকার নিচে কোনো ফ্ল্যাট নেই। কীভাবে আমরা মধ্যবিত্তরা কিনব ফ্ল্যাট?'
আরেক দর্শনার্থী সৈয়দ ইফতে আলি বলেন, 'মেট্রোরেল দিয়ে সহজে যাতায়াত করা যায় মিরপুর ও উত্তরায়। এই এলাকাগুলোতে খুঁজছি ফ্ল্যাট। ১ হাজার ৩৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট মনে করেছিলাম এক কোটি টাকায় পাব। কিন্তু ১০টি প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখেছি, ১ কোটি ৩৫ লাখের নিচে কোনো ফ্ল্যাট নেই এই এলাকায়।'
২২০টি স্টল নিয়ে আয়োজিত রিহ্যাব মেলা চলবে শুক্রবার পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকবে মেলা।
প্রবেশের জন্য দুই ধরনের টিকিট রাখা হয়েছে—একক প্রবেশের টিকিটের দাম ৫০ টাকা এবং একাধিক প্রবেশের টিকিটের দাম ১০০ টাকা।
রিহ্যাবের তথ্য বলছে, দেশে বছরে প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার ফ্ল্যাট বিক্রি হয়।