ছয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম সময়ে জাহাজ ভিড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে
২০১৬ সালে একটি কন্টেইনার জাহাজের চট্টগ্রাম বন্দরের বার্থে ভিড়ে পণ্য আনলোড এবং জাহাজীকরণ করে ফিরে যেতে সময় (টার্ন এরাউন্ড টাইম) লেগেছিলো ২.৮৭ দিন বা ৬৮.৮৮ ঘণ্টা।
এবার ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন সময় লেগেছে ২.৪৬ দিন বা ৫৯.০৪ ঘণ্টা।
চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গর থেকে জেটিতে এসে পণ্য খালাসের সময় কমে যাওয়ায় আগের যেকোন সময় থেকে বেড়েছে বন্দরের গতিশীলতা। দেশের এই প্রধান সমুদ্র বন্দরের গতিশীলতা বাড়ায় সুবিধা পেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। অতিরিক্ত সময় জাহাজকে জেটিতে অপেক্ষা করতে হয় নি। ফলে অধিক কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের সুযোগ হয়েছে।
শুধু তাই নয়, লয়েডস লিস্টে ৬৭তম অবস্থানে থাকা দেশের প্রধান এই সমুদ্র বন্দর ২০২১ সালে ৩২ লাখ ১৪ হাজার ৫৫৮ বা ৩২ দশমিক ১৪ মিলিয়ন টিইইউস (টুয়েন্টি ফুট ইকুয়েভিলেন্ট ইউনিট) কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং করে। ১৮৮৮ সালের ২৫ এপ্রিল প্রথম অপারেশনে যাওয়া চট্টগ্রাম বন্দরের ১৩৩ বছরের ইতিহাসে এটি সর্বোচ্চ কন্টেইনার হ্যন্ডেলিংয়ের রেকর্ড।
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা আঙ্কটাড এর সর্বশেষ তথ্য মতে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশের বন্দরে যেমন চীনে ১.৮ দিন, ভারতে ১.৪২ দিন, মালয়েশিয়ায় ১ দিন, সিঙ্গাপুরে ০.৬৮ দিন সময় লাগে।
বন্দর সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে প্রতিবেশী দেশগুলোর মতো চট্টগ্রাম বন্দরের টার্ন এরাউন্ড টাইম কমে আসবে।
২০২১ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে মোট কার্গো হ্যান্ডেলিং হয় ১১ কোটি ৭৭ লাখ ২৪ হাজার ২৩৮ মেট্রিক টন। ২০২১ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ আসে ৪১৯৯টি।
কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের পাশাপাশি কার্গো হ্যান্ডেলিং, টার্ন এরাউন্ড টাইম সহ সব ক্ষেত্রে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে দেশের এই কন্টেইনার পোর্ট।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, করোনাকালীন সময়ে জীবন ও জীবিকার সমন্বয়ে বন্দরের কার্যক্রম সচল রাখায় এই অর্জন এসেছে। অবশ্য বন্দর সচল রাখতে গিয়ে করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন চট্টগ্রাম বন্দরের ৫৩ জন কর্মকর্তা কর্মচারী।
২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো দেশের প্রধান এই সমুদ্র বন্দর ৩ মিলিয়ন টিইইউস একক কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের রেকর্ড করে। পরবর্তী বছরে অর্থাৎ ২০২০ সালে করোনার প্রভাবে কম হ্যান্ডেলিং হওয়ার কারণে থ্রি মিলিয়ন ক্লাব থেকে ছিটকে পড়ে ওই বছর কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং হয়েছিলো ২.৮ মিলিয়ন টিইইউস।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম টিবিএসকে বলেন, "চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। বন্দরের অর্জন মানে দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাওয়া। তাই আমরা বন্দরের এই রেকর্ডকে ইতিবাচকভাবেই দেখছি। তবে এই সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা খুবই জরুরী।"
বন্দর সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, করোনার প্রভাবে বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইনে বিপর্যয় ঘটে। সিঙ্গাপুর, কলম্বো, পোর্ট কেলাং সহ ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলোতে সীমাহীন কন্টেইনার ও জাহাজ জট সৃষ্টি হয়। সে তুলনায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিভিন্ন সংগঠনের ধর্মঘট, ঈদের টানা ছুটিতেও চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার জটের সৃষ্টি হয়নি। ফলে পুরো বছর জুড়ে স্বাভাবিক ছিল চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম।
২০১৩ সালে লয়েডস লিস্টে বিশ্বের ১০০ ব্যস্ততম বন্দরের তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ছিলে ৮৬তম। এরপর ধারাবাহিকভাবে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থানের উন্নতি হতে থাকে। ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান পৌঁছায় ৫৮তম স্থানে। কিন্তু ২০২০ সালে কন্টেইনার পরিবহন কমে যাওয়ায় ৯ ধাপ পিছিয়ে ৬৭তম স্থানে পৌঁছায় বন্দরের অবস্থান। তবে ২০২১ সালে কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংয়ে রেকর্ড গড়ায় বন্দরের অবস্থান ৫০ এর মধ্যে আসবে বলে মনে করছেন বন্দর সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সিনিয়র সহ-সভাপতি তরফদার রুহুল আমিন বলেন, "সীমিত জায়গার সীমিত জনবল দিয়ে সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে করোনাকালীন এই সময়েও এমন অর্জন সত্যিই প্রশংসনীয়। এ অর্জনের ফলে আন্তর্জাতিক সমুদ্র বাণিজ্য সেক্টরে চট্টগ্রাম বন্দরের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।"
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, করোনার ধাক্কা কাটিয়ে দেশের রপ্তানির পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে বেড়েছে তৈরী পোষাক শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও। চট্টগ্রাম বন্দরের এই সফলতায় বিদেশী পোষাক ক্রেতাদের মধ্যেও বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হবে।"
চট্টগ্রাম বন্দরের মোট ১৮টি জেটি রয়েছে। এসব জেটির মধ্যে কন্টেইনার জাহাজের পাশাপাশি বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজগুলোও পণ্য খালাস করে। বন্দরের মূল জেটির বাইরে পাঁনগাও কন্টেইনার টার্মিনাল এবং কমলাপুর ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোতেও কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এই তিনস্থানের কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের পরিমাণ একত্র করে মোট কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের পরিসংখ্যান প্রকাশ করে বন্দর।
দেশের মোট আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ৯২ ভাগ সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। বাংলাদেশের সব সমুদ্র বন্দরগুলো দিয়ে যে পরিমাণ পণ্যবাহী কন্টেইনার পরিবহন হয় তার ৯৮ শতাংশ পরিবহন হয় চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করে। আবার চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয় তার ২৫ শতাংশ পরিবহন হয় কন্টেইনারের মাধ্যমে। বাকি ৭৫ শতাংশ হয় বাল্ক ক্যরিয়ার (খোলা জাহাজ) যোগে।