অর্থনীতির ধারা আশাব্যঞ্জক, তবে মূল্যস্ফীতির উদ্বেগ কাটেনি: ডিসিসিআই
করোনায় বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনে ধস ও চাহিদা কমে আসার মধ্যেই চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৮ শতাংশের বেশি। একই সময়ে আমদানি ৫৪ শতাংশ ও সরকারের রাজস্ব আদায় প্রায় ১৭ শতাংশ বেড়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতির এ ধারাকে 'আশাব্যঞ্জক' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রাহমান।
তবে রপ্তানি আয় বৃদ্ধির এ ধারার স্থায়িত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলছেন, আগের বছর করোনায় ক্রেতারা পোশাক কম কেনায় এবার বেশি কিনেছেন। ভবিষ্যতে তারা হয়ত অর্ডার কমিয়ে দেবেন। অন্যদিকে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণেই সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়ছে মন্তব্য করে তিনি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন।
ডিসিসিআই এর আয়োজনে 'বেসরকারি খাতের দৃষ্টিতে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে বাংলাদেশের অর্থনীতির সামগ্রিক পর্যালোচনা' শীর্ষক ওয়েবিনারে এসব বিষয় উঠে আসে। ভার্চুয়াল আলোচনায় দেশের অর্থনীতির সম্ভাবনার পাশাপাশি চলমান সমস্যাগুলো তুলে ধরা হয়।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি বলেন, আমদানি, রপ্তানি ও রাজস্ব আদায়ের মতো বিষয়গুলোতে ইতিবাচক ধারা থাকলেও প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের পরিমাণ কমে আসছে। করোনার কারণে ৩.২৪ কোটি মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যের শিকার হয়েছেন। ৫০ লাখের মতো মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। এ অবস্থায় খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ অসহায় হয়ে পড়ছেন।
রপ্তানি আয় ধরে রাখার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেখে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করার মাধ্যমে বেসরকারি বিনিয়োগ ও সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার সুপারিশ করেন অনুষ্ঠানের বক্তারা।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, জিডিপির তুলনায় বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ গত বছর ২১.২৫ শতাংশে নেমে এসেছে। ভিয়েতনামে জিডিপির ৬.২ শতাংশ এফডিআই আসলেও বাংলাদেশে এর পরিমাণ মাত্র ০.৬১%। এমনকি বাংলাদেশে এফডিআই আহরণের হার প্রতিবেশি ভারতের ২.২% এবং ইন্দোনেশিয়ার ১.৭৬% থেকেও অনেক কম।
এতে বলা হয়, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, ব্যবসার উচ্চ খরচ, বাড়তি মূল্যস্ফীতি, কার্যকর ওয়ান স্টপ সার্ভিসের অভাব আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না।
বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত করতে ব্যবসার খরচ কমানো, দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার অবসান, কর কাঠামোর পুনর্বিন্যাস, অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো দ্রুত চালু করার সুপারিশ করেন তিনি।
রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ, নীতি-সহায়তা, মানবসম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধি, লজিস্টিক অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং সর্বোপরি সাপ্লাই চেইনে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ারও তাগিদ দেন ডিসিসিআই সভাপতি।
তিনি বলেন, কোভিড পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইনের উপর বেশি মাত্রায় চাপ পড়ায় দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে ও কাঁচামাল আমদানিতে দাম বৃদ্ধি পাওয়ায়, স্থানীয় বাজারে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানিকারকদের ঋণ সহায়তা ও আমদানিকৃত পণ্যের শুল্কহার কমানোর সুপারিশ করেন তিনি।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, কোভিড মহামারি ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি সকল স্তরের জনগণের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কিছু নীতিসহায়তার পাশাপাশি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে।
তিনি বলেন, আমাদের রপ্তানি বেশি মাত্রায় তৈরি পোষাকের উপর নির্ভরশীল, তবে কৃষি, ঔষধ, পাট, সিরামিক, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং প্রভৃতি সম্ভাবনাময় খাতকে প্রয়োজনীয় নীতিসহায়তা প্রদানে এগিয়ে আসার পাশাপাশি মানবসম্পদের দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রধান আরো বলেন, রপ্তানি বহুমুখীকরণ তহবিলের সম্প্রসারণ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের সক্ষমতা বাড়বে। নেগোসিয়েশন দক্ষতা বাড়াতে আরো মনোযোগী হতে তিনি আহ্বান জানান।
এফবিসিসিআই সভাপতি মোঃ জসিম উদ্দিন অনুষ্ঠানে বলেন, করোনার কারণে গত বছর ক্রেতারা পোশাক কিনতে না পারায় তাদের স্টক একেবারেই খালি ছিল। এ কারণে এবার রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি হলেও তা হয়ত টেকসই হবে না।
তিনি আরও বলেন, সব পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকারের কর আদায় বেড়েছে। প্রকৃতপক্ষে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিমাণ খুব একটা বাড়েনি। এ অবস্থায় করোনা থেকে দেশের অর্থনীতির শতভাগ পুনরুদ্ধার হয়েছে বলে ধরে নিলে বড় ধরনের ভুল হতে পারে বলেও তিনি মত প্রকাশ করেন।
তিনি আরও বলেন, করোনার কারণে ইতোমধ্যেই সাপ্লাই চেইন ভেঙ্গে গেছে। এ অবস্থায় কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া না হলে আগামী রোজায় পণ্যমূল্য বাড়তে পারে বলেও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
ঢাকা চেম্বারের প্রবন্ধে বলা হয়েছে, দেশে সার্বিক বেকারত্বের হার ৫.৩% হলেও শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৪৭ শতাংশ। এ বিষয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে শিল্পখাতের সংযোগ না থাকায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
অদক্ষতার কারণেই বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ২৮-৩০ শতাংশ দক্ষতায় চলছে। এসব কেন্দ্রের বিএমআরই করে দক্ষতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি। প্রয়োজনে অদক্ষ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাতিল করে ক্যাপটিভ পাওয়ারকে উৎসাহ দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
এছাড়াও কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (সিএমএসএমই) জন্য ব্যাংকগুলোকে ঋণ সহায়তা প্রদানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি আরো বাড়ানো প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেন এবং এলডিসি উত্তরণের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি মোঃ সাইফুল ইসলাম রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের জন্য শিল্পখাতে গবেষণা ও উদ্ভাবনের উপর জোরারোপ করেন। তিনি বলেন, ট্যানারি শিল্প সাভারে স্থানান্তরিত হলেও সেখানে স্থাপিত কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) আন্তর্জাতিক মানের না হওয়ার কারণে চামড়া খাতের উদ্যোক্তারা বেশ প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছেন।
ফরেন ইনভেস্টর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি নাসের এজাজ বিজয় বলেন, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য "ইজ অব ডুইং বিজনেস"-এর উপর আরো অধিক হারে গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি বিদ্যমান কর হার যৌক্তিকভাবে কমানো দরকার।
তিনি বলেন, রপ্তানি পণ্যের বাজার সম্প্রসারণে আসিয়ান অঞ্চলে ইকো-সিস্টেমে বাংলাদেশের সম্পৃক্ত হওয়া এবং ক্রেডিট গ্যারান্টি স্টিম-এর আওতা আরো বাড়ানো প্রয়োজন।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. জায়েদি সাত্তার বলেন, দেশের তৈরি পোষাক খাত একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যা অন্যান্য সম্ভাবনাময় খাতের উদ্যোক্তারা অনুসরণ করতে পারে। রেমিট্যান্সকে আমাদের রপ্তানি পণ্য হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ রপ্তানিতে মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।