পাম অয়েল রপ্তানি কমালো ইন্দোনেশিয়া, অস্থির ভোজ্যতেলের বাজার
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে আন্তর্জাতিক ভোজ্যতেলের বাজারে অস্থিরতার আঁচে স্থানীয় বাজারেও চরম অস্থিরতা তৈরি হয়। এই অস্থিরতা দূর করতে সরকার আমদানির উপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার, সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখার জন্য যখন ব্যস্ত ঠিক তথনই পাম অয়েলের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ ইন্দোনেশিয়া তাদের রপ্তানি ৩০ শতাংশ কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
ইন্দোনেশিয়ার এই সিদ্ধান্তের প্রভাবে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পাম অয়েলের দাম টনপ্রতি ১৪০ ডলার বেড়েছে। সয়াবিন তেলের দামও ঠেকেছে দুই হাজার ডলারে।
আমদানিকারক ও পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো বলছে, বাংলাদেশে পাম অয়েলের ৮০ শতাংশ আসে ইন্দোনেশিয়া থেকে ও ২০ শতাংশ আসে মালয়শিয়া থেকে। এছাড়া, দেশের কুকিং অয়েলের ৪৫ শতাংশ চাহিদাই মেটায় ইন্দোনেশিয়া।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যখন খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে তখন ইন্দোনেশিয়া তাদের নিজেদের স্টক সমৃদ্ধ রাখতে পাম অয়েলের রপ্তানি ৩০ শতাংশ কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এই সিদ্ধান্তের পর থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ছে পাম অয়েল ও সয়াবিন তেলের দাম। দাম যতই বাড়ুক, পাম অয়েল আমদানির জন্য বাংলাদেশের সামনে আর কোন বিকল্প দেশ নেই। অর্থাৎ এই অবস্থা থাকলে নিশ্চতভাবেই সামনের দিনগুলোতে ভোজ্যতেলের ওপর বড় একটি ধাক্কা আসবে।
মেঘনা গ্রুপের সহকারি মহাব্যবস্থাপক (অ্যাকাউন্ট) মো. তসলিম শাহরিয়ার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ইন্দোনেশিয়ার রপ্তানি কমিয়ে দেওয়ার ঘোষণায় একদিনেই প্রায় দেড়শ ডলারের মতো দাম বেড়েছে। এটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে কেউ বলতে পারছে না। কিন্তু ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া ছাড়া পাম অয়েল আমদানির আর কোনো বিকল্প নেই।"
তিনি বলেন, "তাদের হাতে যে পরিমাণ তেল মজুদ রয়েছে তা দিয়ে রোজা পার হবে। এর পরে আসলে দাম কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বলা যাচ্ছে না।"
সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা টিবিএসকে বলেন, "আমাদের আর কোনো উপায় নেই। দাম বাড়বে। বেশি দাম দিয়েই কিনতে হবে।"
এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যখন আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধি পেতে থাকে তখন তেল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো সরকারের কাছে প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১০২ টাকা বাড়ানোর অনুমতি চায়।
সরকার দাম বাড়ানোর অনুমতি না দেওয়ায় পুরো সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। বাজারে লিটার প্রতি সয়াবিন তেল ১৬৮ টাকা থেকে বেড়ে ১৮০-১৯০ টাকায় তেল বিক্রি হয়।
এই অবস্থা দূর করতে এফবিসিসিআই ভোজ্যতেলের সকল স্তরের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিটিং করে। সেখান থেকে সরকারের কাছে দাবি জানানো হয় আমদানির উপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের। পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো তাদের সরবরাহ ঠিক রাখার ঘোষণা দেয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অবশ্য আরও আগেই জাতীয় রাজস্ব্ বোর্ডকে তেলের আমদানিতে ভ্যাট প্রত্যাহারের চিঠি দেয়। এই পরিস্থিতিতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর (ডিএনসিআরপি) ভোজ্যতেলের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের নিয়ে মতবিনিয়ম সভা করে।এই বৈঠক থেকে বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে অধিদপ্তর।
আইন অনুযায়ী সাপ্লাই অর্ডারের (এসও) ওপর তেলের সরকার নির্ধারিত দাম লিখে দিতে হবে। কোনোভাবেই ১৫ দিনের বেশি এসও এর বিপরীতে তেলের সরবরাহ আটকে রাখা যাবে না।
অর্থাৎ, ৯ মার্চ যে এসও দেওয়া হবে তার বিপরীতে তেলের সরবরাহ অবশ্যই আগামী ২৪ তারিখের মধ্যে দিতে হবে।
কিছু অভিযোগের ভিত্তিতে ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচাক (ডিজি) এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, "দেশের রাইরে তেল পাচার হচ্ছে কিনা সে বিষয়টি আমরা দেখবো। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বিজিবির কাছে চিঠি দেব বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য।"
এছাড়া, রূপগঞ্জে তেলের মিলগুলোতে ট্রাক ঢুকানোর জন্য লাইন দিতে ৫০ হাজার করে টাকা নেওয়া হয় বলে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন। এই বিষয়টির সত্যতা যাচাই ও প্রতিকারে ভোক্তা অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একসঙ্গে কাজ করবে বলে জানান মহাপরিচালক।
অবশ্য সভায় তেল পরিশোধনকারী মিলার তাদের সরবরাহ ঠিক রয়েছে বলে দাবি করেন। বিপরীতে সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে বেশি দামে তেল বিক্রির অভিযোগ করেন পাইকারী ব্যবসায়ীরা।
সরকার নির্ধারিত খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৪৩ টাকা এবং বোতলজাত সয়াবিনের দাম ১৬৮ টাকা। আলোচনার সময় উঠে আসে, পাইকারী বিক্রেতারা প্রতি লিটার খোলা তেলে অন্তত ১০-১১ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করেছেন।
এএইচএম শফিকুজ্জামান বলেন, তেলের বাজার স্থিতিশীল করতে অবশ্য সরকার ভোজ্যতেলের আমদানির উপর ভ্যাট প্রত্যাহার বা কমিয়ে আনার বিষয়ে দ্রুতই একটি সুখবর আসতে পারে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা ২০ লাখ টন। এর মধ্যে ২ লাখ টন স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়, বাকি ১৮ লাখ টনের মধ্যে পাম অয়েল ৫৩ শতাংশ এবং সয়াবিন ৪৭ শতাংশ আমদানি করা হয়।
চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত ৯ লাখ টন অপরিশোধিত সয়াবিন এবং ১১ লাখ টন অপরিশোধিত পাম তেল আমদানি করা হয়েছে।