দাম বৃদ্ধি ও ইউক্রেন থেকে সরবরাহ সংকটে উদ্বেগে দেশের সিরামিক উৎপাদকরা
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সাপ্লাই চেইন বাধাগ্রস্ত হয়ে বিশ্বব্যাপী বাড়ছে পণ্যের দাম। দাম বৃদ্ধি ও সরবরাহ সংকটে পড়েছে কনস্ট্রাকশনের অন্যতম উপাদান সিরামিকস টাইলসের উৎপাদনও।
মূল কাঁচামাল ক্লে ও গ্যাসের সরবরাহ সংকট এবং মূল্যবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের সিরামিকস শিল্প সংকটে পড়তে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা।
বাংলাদেশে সিরামিক উৎপাদকরা বলছেন, সিরামিকস ইন্ডাস্ট্রির মোট উৎপাদন ব্যয়ের ৪০-৪২ শতাংশ মাটির উপাদান (সয়েল ম্যাটারিয়ালস) এবং প্রাকৃতিক গ্যাস। কাঁচামাল হিসাবে সয়েল ম্যাটারিয়ালসের মধ্যে ইউক্রেনিয়ান ক্লে বৈশ্বিক চাহিদার শীর্ষে। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে গ্যাসের প্রধান যোগানদাতা রাশিয়া। দুটি দেশের যুদ্ধের কারণে ইউক্রেন থেকে ক্লে আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির রেকর্ডে দেশেও গ্যাসের দাম বাড়ার শঙ্কা রয়েছে।
এমতাবস্থায় কাঁচামালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের পদক্ষেপ ছাড়া এ শিল্পের উদ্যোক্তাদের টিকে থাকা সম্ভব হবে না বলেও জানিয়েছেন তারা। এ নিয়ে সোমবার একটি সংবাদ সম্মেলন করার কথা রয়েছে সিরামিকস উৎপাদনকারীদের।
বাংলাদেশ সিরামিক ওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোঃ সিরাজুল ইসলাম মোল্লা বলেন, দেশে সিরামিক শিল্পে ৭৮টি কোম্পানির ১৩ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। বছরে বিক্রি ৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। রপ্তানিও প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা।
তিনি বলেন, "কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ও সরবরাহ সংকটের কারণে আমরা প্রতিযোগী মার্কেটের তুলনায় পিছিয়ে পড়ছি। আমাদের দাবি নতুন করে যেন সিরামিকসের কাঁচামালের দাম না বাড়ে সে বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ নিতে হবে।"
কাঁচামাল হিসাবে ইউক্রেন থেকে ক্লে আমদানি করে আকিজ, আবুল খায়েরসহ বড় তিনটি কোম্পানি। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ওই দেশ থেকে আর কাঁচামাল পাচ্ছে না কোম্পানিগুলো। বিকল্প দেশ থেকে আমদানি করলেও দাম এবং মানে সমঝোতা করতে হচ্ছে তাদের।
আকিজ গ্রুপের পরিচালক (সেলস এন্ড মার্কেটিং, পার্টিকল বোর্ড এন্ড সিরামিকস) খোরশেদ আলম বলেন, "ইউক্রেনের ক্লে-এর মান ভালো। আবার ইউরোপিয়ান অন্যান্য দেশের তুলনায় দামও অন্তত ১০ শতাংশ কম। এখন আমরা মালয়েশিয়া থেকে আমদানি করছি। দাম বেশি দিয়ে অন্যান্য উৎস থেকেও আমদানির চেষ্টা করছি।"
তিনি বলেন, "এমনিতেই গত দুই বছরে কাঁচামালের দাম ৩৫-৪০ শতাংশ বেড়েছে। ১০০০ ডলারের ফ্রেইট চার্জ বেড়ে ৪ হাজার ডলার হয়েছে। এটা আমাদের খরচের ওপর বড় প্রভাব ফেলেছে। তবে খরচ বাড়ার তুলনায় দাম বাড়ানো যায়নি। ফলে যেসব প্রতিষ্ঠান মুনাফায় ছিল, তাদের মুনাফা কমেছে। আর যাদের লাভ-লোকসান সমান ছিল, তারা লোকসানে চলে গেছে।"
বাংলাদেশে সিরামিকস উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামালের ৯৫ শতাংশই আমদানি হয়। গত এক বছরে এসব পণ্যের ক্লে, কেমিক্যালসহ সব পণ্যের দামই ৩৫-৪০ শতাংশ বেড়েছে। এখন নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে গ্যাস ও ক্লে-এর দামবৃদ্ধির।
দেশে সিরামিকস ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবহৃত ক্লে এর বড় অংশই মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি থেকে আমদানি হয় জানিয়ে গ্যাসের দামকেই বড় সংকট মনে করছেন সিরাজুল ইসলাম মোল্লা।
তিনি বলেন, "সিরামিকস গ্যাসনির্ভর প্রসেস ইন্ডাস্ট্রি। ক্লিন বা চুল্লিতে ফায়ারিংয়ের কারণে ২৪ ঘণ্টাই গ্যাস চালু রাখতে হয়। গ্যাসের প্রবাহও উচ্চমাত্রায় রাখতে হয়। গ্যাস সংকটের কারণে এখনই অনেক কারখানা ঠিকমতো উৎপাদন অব্যাহত রাখতে না পেরে লোকসান গুনছে।"
বড় বিনিয়োগ নিয়ে ২০১৮ সালে দেশে সিরামিকস ইন্ডাস্ট্রিতে এসে এখনো ব্যবসা সম্প্রসারণে রয়েছে আবাসন খাতের বড় নাম শেলটেক গ্রুপ। কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি ও গ্যাস সংকটের কারণে বিপদের শঙ্কায় রয়েছে গ্রুপটি।
শেলটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ বলেন, "২০১৯ সালে গ্যাসের দাম ৩৮ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের উৎপাদন খরচ প্রায় ১৫ শতাংশ বেড়েছে। এখন গ্যাসের দাম ১১৬ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি হলে এ খাতের ইন্ডাস্ট্রিগুলোর টিকে থাকা সম্ভব হবে না। বিপুল বিনিয়োগ মুখ থুবড়ে পড়বে।"
তিনি বলেন, "সিরামিকসের কাঁচামাল ও উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ময়েশ্চার প্রসেস লস ৩৫% থেকে ৪০% পর্যন্ত। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এই ক্ষতি বিবেচনায় নিয়ে শুল্কায়ন করছে না। অন্যদিকে সিরামিক টাইলস ও স্যানিটারি পণ্য উৎপাদনে সম্পূরক শুল্ক (এসডি) যথাক্রমে ১৫% এবং ১০%। সিরামিকস এখন আবশ্যিক পণ্য হিসাবে এ শুল্ক প্রত্যাহার হওয়া উচিত।"
সিরামিক শিল্পের উত্থান
বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের মতে, ১৯৬০ এর দশকে উত্থান হওয়া সিরামিক খাত এখন বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প।
৬৬টি ব্র্যান্ড ছাড়াও ছোট ও মাঝারি মিলিয়ে দেশে ১০০টিরও বেশি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এ খাতে। বর্তমানে এ খাত ঘিরে প্রায় ৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে, যাদের মধ্যে ৫৫ হাজার প্রত্যক্ষ কর্মচারী এবং ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পের (সহযোগী শিল্প) কর্মীও রয়েছেন।
গড়ে প্রতি বছর খাতটি ২৫ কোটি টেবিলওয়্যার, ১৫ কোটি বর্গফুট টাইলস এবং ৫০ লাখ স্যানিটারিওয়্যার তৈরি করে। টেবিলওয়্যারের একটি বড় অংশ ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি হয়ে থাকে।
সমিতির সভাপতি মোঃ সিরাজুল ইসলাম মোল্লা বলেন, ১৯৮০'র দশকে স্থানীয়ভাবে সিরামিক পণ্যের চাহিদার ৯০ শতাংশ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হতো, কিন্তু এখন স্থানীয় কোম্পানিগুলোই মোট চাহিদার প্রায় ৮৫ শতাংশ পূরণ করে।
২০১৯ সালের শেষদিকে ইউএসএডিএ-এর বাজার গবেষণা অনুসারে, বাংলাদেশে সিরামিক শিল্পের বাজার ৭,৫৫০ কোটি টাকার, যেখানে ৫,৫০০ কোটি টাকা নিয়ে টাইলস শিল্পের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। টেবিলওয়্যার এবং স্যানিটারিওয়্যার শিল্পের বাজার ছিল যথাক্রমে ৮০০ কোটি এবং ১,২০০ কোটি টাকা।