হ্যান্ডমেড সিরামিকের ভুবন 'ক্লে ইমেজ': হাতের ছোঁয়ায় যেখানে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে প্লেট, বাসন!
মিরপুর ১১, ব্লক সি, এভিনিউ ৫, হাজী নান্নার বিরিয়ানির দোকানটা যেদিকে ঘুরে গেছে, সেই পাশে সামনে একটু এগিয়ে যেতেই বেশ সুনসান একটা সাদারঙা তিনতলা বাড়ি। ঢুকতেই দেখি পরিপাটি পরিবেশে মাটি নিয়ে কাজ করছেন তিন নারী। সবাই সাদা রংয়ের এপ্রোন পরে আছেন। এরপর গেলাম বাড়িটির দোতলায়।
কাচের গ্লাসের দরজা খুলতেই দেখা পেলাম 'ক্লে ইমেজ'-এর কর্ণধার রেহানা আক্তারের। সিরামিক আর দেশীয় ঐতিহ্যের বিষয়ে আগ্রহ থাকায় রাজধানীর মিরপুর ও মোহাম্মদপুরের ক্লে ইমেজের আউটলেটে যাওয়া হয়েছে বেশ কয়েকবার। সেই সুবাদেই বাংলাদেশের হ্যান্ডমেড সিরামিক ভুবনের এ পথিকৃৎকে চিনে নিতে দেরি হলো না। গল্পও জমে উঠলো বেশ।
চিলেকোঠায় শুরু
সিরামিকের প্লেট, গ্লাস, বাসনকে শৈল্পিক রূপ দেওয়া রেহানা জানাচ্ছিলেন তার জীবনের গল্প। সিরামিক নিয়ে পড়াশোনা করা রেহানার শুরুটা হয়েছিল সিঁড়ির নিচে ছোট্ট একটি ঘরে। সেখানেই প্রথমে মাটি দিয়ে টুকটাক বাসনপত্র তৈরি করতেন; কুমাররা যেভাবে মাটি দিয়ে চাকা ঘুরিয়ে কাজ করে, ঠিক সেইভাবে।
যেহেতু মাটি দিয়ে কাজ, ঘর তো ময়লা হবেই, আর বাসার বাদবাকি সদস্যরা কি আর তা মেনে নেবে! তাই ঠাঁই হলো বাড়ির চিলেকোঠায়। তিলে তিলে তার শখ, স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে থাকলেন। মাটির আসবাব পোড়ানোর মতো চুল্লিও সেসময় ছিল না তার। ফলে যাই বানাতেন তাই পোড়ানোর জন্য ছুটতেন রায়েরবাজার বা সেই নারায়ণগঞ্জ। কাদামাটির পাত্রগুলো নিয়ে এতদূরের যাত্রায় প্রায়ই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ত জল, তবে তাতে ভেঙে পড়েননি রেহানা।
যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে
গল্প শোনার ফাঁকেই সামনে হাজির 'ময়মনসিংহ ক্লে'তে তৈরি একটি ট্রে; তার ওপর দুই পেয়ালায় রাখা গরম শিঙাড়া আর বিস্কুট, সঙ্গে টি সেটের মগে এলাচ দেওয়া গরুর দুধের চা। বলাই বাহুল্য পুরো সেটটিই ক্লে ইমেজের তৈরি।
বাঙালি খাবারের বিষয়ে তেমন কোনো আগ্রহ নেই। তবে রান্নায় দারুণ পটু বলে নিজেই জানালেন রেহানা।
আপ্যায়নের ফাঁকেই জানালেন, ছয় ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ রেহানা। বাবা ছিলেন এয়ারক্রাফট ইঞ্জিনিয়ার, বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকতেন চাকরির সুবাদে, আর বাদবাকি ভাইবোনদের সবাইকে নিয়ে বেশ ব্যস্ত থাকতেন মা। ফলে স্কুলে ভর্তি কিছুটা দেরিতেই হন। অন্য সবার মতোই চিকিৎসাশাস্ত্র বা প্রকৌশলবিদ্যায় পড়ার বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন। ভর্তি হয়েছিলেন একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজেও। তবে যেহেতু ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকতে খুব ভালোবাসতেন। তাই ওইসময়টায় অনেকটা শখের বসেই চারুকলায় ভর্তি পরীক্ষা দেন, পড়ার সুযোগও পেয়ে যান। আর এ বিষয়টিই যে তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল, প্রায় তিনদশক পর সেই দাবি করতেই পারেন রেহানা।
কেন এ দাবি? এজন্য চলে যেতে হবে, ১৯৯৪ সালে। চারুকলা অনুষদে। তখন দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তিনি। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মবার্ষিকীতে অনুষ্ঠিত একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়রদের সঙ্গে হওয়া ওই প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে আত্মবিশ্বাস অনেকটাই বেড়ে যায় তার। পরপর তিনবার সেই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দখল করেন শীর্ষস্থান। যেন এলেন, দেখলেন আর জয় করলেন!
প্রচুর পড়ার অভ্যাস রেহানার। দেশে হ্যান্ডমেড সিরামিকের ধারণা প্রচলিত করে তুলতে তার এ অভ্যাস অবদান রেখেছে বেশ।
প্রথম প্রাপ্তির আনন্দ
পরিবারের কেউই ব্যবসায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন, সেখানে একটা মেয়ে হয়ে ব্যবসা করবেন তাও সিরামিক নিয়ে! স্বাভাবিকভাবেই সমর্থন মেলেনি কারো। তাতে মোটেও দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না রেহানা।
অফিসার্স ক্লাবের এক মেলায় অংশ নিয়ে বদলে গেল সে চিত্র। মিরপুর থেকে সোজা স্কুটারে চলে গেলেন বেইলি রোড, সাথে নিলেন নিজের নকশার সব পণ্য।
দেশি মাটি দিয়ে তৈরি সিরামিক পণ্য, তার ওপর আবার হাতে আঁকা। একদম ভিন্নধরনের উপস্থাপনার কারণে আলাদা কোনো চাকচিক্য না থাকার পরও মেলার প্রথমদিনেই রেহানার সব পণ্য বিক্রি হয়ে যায়।
সেবার মেলা থেকে আয়ও হয়েছিল প্রায় ৩৫ হাজার টাকার মতো। এটি দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন তার বাবা। এরপরই ব্যবসার জন্য প্রায় ১০ লাখ টাকা দেন তাকে। মিরপুরে নিজেদের একটি জমিও দেওয়া হয়। জলাভূমি ভরাট করে সেই জমি থেকে সম্পূর্ণ নিজের আয়ের টাকায় আজকের তিনতলা ভবন তৈরি তো চাট্টিখানি কথা নয়।
শুরু আর বর্তমান, পার্থক্য যখন আকাশপাতাল
শুরুর সেই সিঁড়িঘর,এরপর চিলেকোঠা থেকে এখন তৈরি করেছেন তিনতলা কারখানা। সে কারখানায় আছে রেহানার ৭০ জনেরও বেশি কর্মী, যাদের অধিকাংশই নারী। জানালেন, প্রথমদিকে কোনোমতে একটি টিনশেড ঘর তৈরি করেছিলেন, যেখানে দিনের বেশিরভাগ সময়ই কাটাতেন কাজ করে। নিজের বিলাসবহুল বাড়ি ছেড়ে ওই পরিবেশে কাজ করাটাই ছিল তার জন্য বিশাল বড় চ্যালেঞ্জ। তবে সফল উদ্যোক্তা হতে হলে যে আগে শ্রমিক হয়ে উঠতে হবে, এ বিষয়টি সেসময় বুঝতে পেরেছিলেন রেহানা।
সম্প্রতি বাংলাদেশ টেকনিক্যাল এডুকেশন বোর্ডের (বিটিইবি) আওতায় সিরামিকের কাজ নিয়ে ট্রেনিং দেওয়ার অনুমোদন পেয়েছেন রেহানা।
দামে কম, মানে ভালো
অন্যান্য সিরামিকের তুলনায় বেশ সাশ্রয়ী ক্লে ইমেজের বাসনকোসন। ১৮০ থেকে ২৫০ টাকায় ভেতর মিলবে নান্দনিক সব মগ। ১৫০০ থেকে ১৮০০ টাকায় মিলবে টি সেট। এছাড়া দেড়শ টাকার ভেতর সাধারণ বাটিগুলো পাওয়া যাবে। তবে কড়াই আকৃতির বাটিগুলোর দাম ৬০০ থেকে ৯০০ টাকার ভেতর। এছাড়া ডিশ আর প্লেটগুলো অনেকটাই তার আকৃতির ওপর নির্ভর করে। বড় আকৃতির ফুল প্লেটগুলোর দাম সাধারণত ৪৫০ থেকে শুরু করে ১২০০ টাকার ভেতর।
দেশীয় মাটির ব্যবহার এবং বিভিন্ন সিরামিক কারখানায় ব্যবহৃত মাটির পুনর্ব্যবহারের কারণে ক্লে ইমেজের পণ্যের দাম তুলনামূলক কম বলে জানালেন এর প্রতিষ্ঠাতা।
কারখানাটি ভেতরে
ক্লে ইমেজের ভেতরে প্রবেশের পরই এর কারখানাটি ঘুরে দেখার আগ্রহ হচ্ছিল।
একতলায় চলে কুমোরের কাজ, প্লেট কিংবা মগ বা যাইহোক মূল আকৃতি এখানেই দেওয়া হয়। এরপর পোড়ানোর জন্য এখান থেকে চুল্লিতে দেওয়া হয়।
দোতলায় মোট ৫টি ঘর। ক্লে ইমেজের অফিস রুমও এই ফ্লোরেই। দেখলাম একটি ঘরে ৬-৭ জন মেয়ে কাজ করছে, মাটির ওপর সূক্ষ্ম নকশা ফুটিয়ে তুলছে তারা। পাশের ঘরে আরও ৫ জনের মতো কাজ করছে। তাদের তুলির আঁচড়ে প্রাণ পাচ্ছে মাটির পাত্রগুলো। বাকি ঘরগুলোয় শেলফ আর মেঝেতে থরে থরে অসম্পূর্ণ পাত্রগুলো শুকোতে দেওয়া। এরপর গেলাম তিনতলায়, এটি মূলত স্টোরেজ।
বিক্রির জন্য প্রস্তুত পণ্যগুলোই শোভা পাচ্ছে এই ফ্লোরে। এছাড়া প্যাকিংয়ের কাজও এই ফ্লোরেই করা হয়।
কর্মীবান্ধব ক্লে ইমেজ
ক্লে ইমেজ যে আর ১০টি প্রতিষ্ঠান থেকে বেশ আলাদা, তা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল রেহানার সঙ্গে তার প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের ব্যবহারে। কারখানার কর্মীদের সন্তানদের সঙ্গে রেহানার খুনসুটি বলে দিচ্ছিল কর্মীদের প্রতি তার আন্তরিকতা কতখানি।
কর্মীদের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্কের রহস্য নিয়ে জানতে চাইলে রেহানা বলেন, তার প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করে তাদের কাজের পাশাপাশি পড়াশোনা, ধর্মশিক্ষার ব্যবস্থাও করে দেন তিনি। প্রতি এক ঘণ্টা পরপর পানির ব্যবস্থা রাখা, টাকা জমাতে সাহায্য করাসহ অনেক ধরনের উদ্যোগ তিনি নিয়েছেন এখন পর্যন্ত।
জানালেন, তার কারখানায় কাজ পেতে আলাদা কোনো দক্ষতারও প্রয়োজন নেই, কাজ করতে করতেই তারা দক্ষ হয়ে ওঠে।
অর্জনের ঝুলি
বর্তমানে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, মিরপুর, গুলশান ও বনানীতে ক্লে ইমেজের শোরুম রয়েছে। শূন্য হাতে শুরু করে বতর্মানে রেহানার উৎপাদন খরচ বাদেই লাভ প্রায় ৫ লাখ টাকার মতো।
২০২১ সালে প্রথম আলো ও আইএলডিসির পক্ষ থেকে একটি অ্যাওয়ার্ড জেতেন তিনি। সরকারি এসএমই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে জিতেছেন বর্ষসেরা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার পুরস্কার। এছাড়া ব্র্যাক ব্যাংকের পক্ষ থেকেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
করোনাভাইরাস মহামারির সময় সরকারের দেওয়া প্রণোদনায় ঋণ পেতে আবেদন করেছিলেন তিনি। কিন্তু আগে ঋণ নেওয়ার অভিজ্ঞতা না থাকায় কোনো ব্যাংকের কাছ থেকেই ঋণ পাননি তিনি। পরবর্তীতে ব্র্যাক ব্যাংকের যোগাযোগ করেন। মজার ব্যাপার হলো, শুধু ঋণ নয়, ব্যাংকের পক্ষ থেকে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ একটি অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয় তাকে।
এ পর্যন্ত বিশ্বের ৩০টি দেশে ক্লে ইমেজের পণ্য ছড়িয়ে গেছে বলে দাবি রেহানার।
শিল্পীসত্তা আর ব্যবসায়ের মেলবন্ধনে গড়ে ওঠা ক্লে ইমেজের মতো দেশীয় সিরামিকে তার প্রতিষ্ঠানের মতো আরও এমন অনেক প্রতিষ্ঠান তৈরি হোক, ২০ বছরের ক্যারিয়ারের দ্বারপ্রান্তে এটিই এখন তার প্রত্যাশা।