সরকারি কর্মচারীদের বেতন, প্রকল্পের খরচ- তাতে গরিবের জন্য কী?
দরিদ্রদের ওপর চড়া পণ্যমূল্যের যে আঘাত নামছে, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের মাসিক মূল্যস্ফীতির তথ্যে তার প্রকৃত দশা প্রকাশ পায় না। এমনকী নয় বছরেও জাতীয় গৃহস্থালি আয়ের তথ্যভাণ্ডার প্রস্তুত করতে পারেনি; যার মাধ্যমে সরকার প্রকৃত দরিদ্রদের চিহ্নিত করে তাদের সরাসরি সহায়তা দিতে পারত।
অথচ চলতি মাসে জাতীয় সংসদে উত্থাপিত ২০২২-২৩ অর্থবছর বাজেটের 'মধ্য-মেয়াদী বাজেট কাঠামো' (এমটিবিএফ) শীর্ষক প্রকাশনায় দাবি করা হয়, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে বরাদ্দ করা অর্থের ৯৪ শতাংশ দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখছে।
নতুন বাজেটে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে ৪১০ কোটি টাকা প্রস্তাবিত বরাদ্দের প্রায় অর্ধেক যাবে বেতন-ভাতায়। বেতন ছাড়াও প্রশাসনিক ব্যয়, বিদেশ ভ্রমণ ও প্রশিক্ষণ, জ্বালানি ও যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে বিভাগের ব্যয়ের খাত চিহ্নিত করা হয়েছে।
তবে জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থার কাজের সাথে দারিদ্র্য বিমোচনের কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাচ্ছেন না বিশ্লেষকরা। এর পরিবর্তে তারা বলছেন, সংস্থাটি তাদের মূল দায়িত্ব তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে, তারা এটি সঠিকভাবে করতে পারলে দারিদ্র্য বিমোচনে দরকারি তথ্য-উপাত্ত পেতে পারতেন নীতি-নির্ধারকরা।
তবে অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেটের ৩ লাখ ৮৮ হাজার ৫২৭ কোটি টাকাই ব্যয় হবে দারিদ্র বিমোচনে। এ হিসাবে দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যয় হচ্ছে ঘোষিত বাজেটের ৫৭%।
সরকারের ৬২টি মন্ত্রণালয় বিভাগ ও সংস্থার বরাদ্দ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সেতু বিভাগের ৯,২৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দের মধ্যে সর্বোচ্চ ৯৬.৯৩ শতাংশ বা দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যয় দেখানো হচ্ছে।
সেতু, টানেল, ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ে, সাবওয়ের মতো অবকাঠামো নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে সমন্বিত পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করে থাকে সেতু বিভাগ।
এ বিভাগের বিভাগের ৯,২৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দের ৮,৯৯৫.৪২ কোটি টাকাই ব্যয় হবে নয়টি প্রকল্প বাস্তবায়নে।
আগামী অর্থবছরেও পদ্মা সেতু প্রকল্পে বরাদ্দ থাকছে প্রায় ২,২০৩ কোটি টাকা। ২৫ জুন উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা পদ্মা সেতু চালু হলে পরোক্ষভাবে দারিদ্র্য হার এক শতাংশীয় পয়েন্ট কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এর বাইরে ঢাকায় দুইটি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পায়রা নদীর উপর সেতু, পঞ্চবটি হতে মুক্তারপুর সেতু পর্যন্ত দোতলা রাস্তা, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ ও মেঘনা নদীর উপর সেতু নির্মাণের সমীক্ষা প্রকল্পে ৬,৭৯৩ কোটি টাকার বরাদ্দ রয়েছে।
জানতে চাইলে অর্থনতিবিদ আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, "সেতু, টানেল, ফ্লাইওভারের মতো প্রকল্পের ব্যয় সরাসরি কীভাবে দারিদ্র্য বিমোচনে অবদান রাখে তা আমার বোধগম্য নয়।"
"সরকারি হিসাবে দেশের প্রায় ২০ শতাংশ আর বেসরকারি হিসাবে আরও কিছু বেশি মানুষ বর্তমানে দারিদ্র্য সীমার নিচে আছেন। এই দরিদ্র শ্রেণির বাইরে আর কেউ কি এসব অবকাঠামো ব্যবহার করবেন না?" প্রশ্ন রেখে বলেন তিনি।
আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, পরিবহন খাতে বড় ধরনের অবকাঠামো তৈরির মূল উদ্দেশ্যই ব্যবসা ও বাণিজ্যের পরিবেশ তৈরি করা। এর মাধ্যমে মূলত ব্যবসায়ীরাই উপকৃত হয়ে থাকেন। দীর্ঘমেয়াদে কিছু কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলে হয়ত দারিদ্র মানুষের আয় বাড়ে। দরিদ্র মানুষদের জন্য এ ধরনের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে, এমনটা দাবি করা কখনই ঠিক হবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে বরাদ্দের ৯৪ শতাংশের বেশি দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যয় হচ্ছে, এমন তথ্যে বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেন, "দরিদ্র ও বেকার মানুষের প্রকৃত তথ্যই দিতে পারছে না পরিসংখ্যান ব্যুরো। তাহলে কর্মকর্তাদের বেতন, ইলেকট্রনিক গ্যাজেট কেনার টাকা, গাড়ির তেলের ব্যয়ও কি দারিদ্র্য বিমোচনে অবদান রাখবে?"
দারিদ্র্য বিমোচনের ট্রেনে রেল রেলমন্ত্রণালয়ও সওয়ার
মধ্য-মেয়াদী বাজেট কাঠামো অনুসারে, রেল মন্ত্রণালয়ের জন্য প্রস্তাবিত ১৮, ৮৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের ৮৭.০৩ শতাংশই সরাসরি দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখবে বলে দাবি করা হয়েছে। পরোক্ষ অবদানসহ দারিদ্র্য বিমোচনে যাবে রেলের প্রায় ৯০% বরাদ্দ। সব মিলে মন্ত্রণালয়টির জন্য প্রস্তাবিত বরাদ্দের ১৭,০৬৫ কোটি টাকাই দেখানো হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচনে।
অথচ রেলের টিকেটে দরিদ্রদের জন্য আলাদা কোনও কোটা নেই। অনলাইনে আন্তঃনগর ট্রেনের অর্ধেক টিকেট বিক্রি হওয়ায় দরিদ্রদের টিকেট পাওয়ার সুযোগ কমেছে। রেলে পণ্যও পরিবহন করেন বড় ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় রেল খাতে বরাদ্দের বড় অংশ দারিদ্র্য বিমোচনে কীভাবে অবদান রাখবে, এমন প্রশ্ন উঠছে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, রেল মন্ত্রণালয়ের মোট বরাদ্দে পরিচালন খরচ ৪,৩২৬ কোটি টাকা। এরমধ্যে বেতন-ভাতাতেই রয়েছে ১,২৬১ কোটি টাকা। প্রশাসনিক ব্যয়ে ৩১৭ কোটি টাকা, ভ্রমণে ৬১ কোটি, সম্মানী খাতে ৬৬৭ কোটি, মেরামত খাতে ৪১০ কোটি, সুদ পরিশোধ বাবদ ৪০ কোটি, চাকুরি-সম্পর্কিত নগদ সহায়তা ৮৯০ কোটি এবং থোক বরাদ্দ ৮১ কোটি টাকা।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দের একটি বড় অংশই যাচ্ছে ২০টি মিটারগেজ লোকোমোটিভ এবং ১৫০টি মিটারগেজ যাত্রীবাহী ক্যারেজ সংগ্রহ, খুলনা হতে মংলা পোর্ট পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মাণ, দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ ও পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে।
এ বিষয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়ে থাকেন বিদেশি পরামর্শক, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ও দক্ষ কর্মীরা। কম মজুরির কিছু কাজে দেশীয় শ্রমিক নিয়োজিত থাকেন। "আর তাই এ ধরনের প্রকল্পের ব্যয় দারিদ্র্য বিমোচনে দেখানো অযৌক্তিক।"
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অর্থ বরাদ্দেও দারিদ্র্য বিমোচনের দাবি
উন্নয়ন প্রকল্পে নজরদাঁরি ও বাস্তবায়নের মান পরিবীক্ষণে নিয়োজিত- বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) এ ব্যয়ের প্রায় ৩১% দারিদ্র্য বিমোচনে দেখানো হয়েছে।
বিসিক, বিটাকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা শিল্প মন্ত্রণালয়ের ব্যয়ের অর্ধেক ধরা হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচনে। অন্যদিকে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের ৭২.২৪% দারিদ্র্য বিমোচনে যাবে বলে দাবি করা হচ্ছে।
আবার দেশের অভ্যন্তরে তেমন কোন কাজ না থাকলেও, বহির্বিশ্বে কাজ করা পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের ব্যয়ের ৪০ শতাংশই দারিদ্র্য বিমোচনে যাচ্ছে বলে দাবি করা হয়েছে।
তবে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশি ঋণ ও অনুদান আনায় কাজ করা অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) বরাদ্দে দারিদ্র্য বিমোচনে অবদান দেখানো হচ্ছে মাত্র ১.৮৫%।
দারিদ্র্য বিমোচনকে অর্থহীনভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সরকারের বরাদ্দে কোনো ধরনের পর্যালোচনা ছাড়াই দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যকে জুড়ে দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, "এক্অসর্থ বরাদ্দ দিয়ে বলা হচ্ছে, এটার এত শতাংশ দরিদ্রদের জন্য। আসলে এটা দরিদ্রদের কাছে যাচ্ছে কি না- সেটা কখনও বিশ্লেষণ করা হয় না। এ ধরনের কোন চেষ্টাও নেই।" এ ধরনের প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ অর্থহীন হিসেবে অভিহিত করেন তিনি।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, যেকোনো খাতে সরকারের ব্যয় বাড়লে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির মাধ্যমে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ে। এ হিসাবে সরকারি ব্যয়ের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে দারিদ্র্য বিমোচন হচ্ছে, তবে কতটা হচ্ছে সেটা হিসাব করা কঠিন।
তিনি বলেন, "সরকারি বরাদ্দের যে অংশটা সরাসরি দরিদ্রদের হাতে যাবে; ঠিক ততটুকুই দারিদ্র্য বিমোচনে অবদান রাখবে। সেটা সামাজিক নিরাপত্তার মাধ্যমে পণ্য সহায়তা বা নগদ হস্তান্তরের মাধ্যমে হতে পারে।"
মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, "পরিসংখ্যান ব্যুরো নগদ হস্তান্তরের কোন কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে না। বেতন-ভাতা পরিশোধের মাধ্যমে ঠিক কীভাবে দারিদ্র্য বিমোচন হচ্ছে এটা আমি অনুধাবন করতে পারছি না"।
বাজেটের কতটা দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখছে তার একটা সঠিক হিসাব দরকার। "গড়পড়তা প্রতিবেদন তৈরি না করে প্রকৃত হিসাব বের করতে পারলে ভবিষ্যতে সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন নীতিমালা আরও সুদৃঢ় হবে"- বলেও মন্তব্য করেন তিনি।