ইচ্ছে করেই কোভিড আক্রান্ত হতে চান যারা
আমাদের প্রায় সকলেই যেকোনো উপায়ে অতিমারির কারণ কোভিড-১৯ এড়িয়ে চলতে চাই। কিন্তু, পৃথিবীব্যাপী এমন একদল লোকের সংখ্যা দিন দিন ভারি হচ্ছে, যারা কিনা ইচ্ছে করেই রোগটি সৃষ্টিকারি সার্স কোভ-২ ভাইরাসে আক্রান্ত হতে চাইছেন।
অবশ্য নেহাত উদ্ভট শখ বা কৌতূহলের বশে নয়, তাদের উদ্দেশ্যটি অনেক মহৎ। একারণেই 'ওয়ান ডে সুনার' নামের একটি ক্যাম্পেইনের আওতায় করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন তৈরির অংশ হিসেবে জীবাণুটি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সংক্রমণের ঝুঁকি নিতে নাম লিখিয়েছেন হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবী।
অর্থাৎ, তারা পরীক্ষাধীন টিকা গ্রহণ করার পর ইচ্ছে করেই সংক্রমিত হবেন।
এদেরই, একজন হলেন ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল শহরের বাসিন্দা ইস্তেফানিয়া হিদেলগো। ৩২ বছরের এ তরুণী জীবিকা উপার্জনের জন্য স্থানীয় একটি গ্যাস স্টেশনে কাজ করেন।
নিজ বাড়ির কাছে উষ্ণ রৌদ্রজ্বল এক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, 'আমি সেখানে রাতের শিফটে কাজ করি। তাই কাজের পরিবেশে বেশিরভাগ সময় বেশ নিঃসঙ্গতা অনুভব করতাম।'
লকডাউনের দিনগুলো স্মরণ করে ইস্তেফানিয়া জানান, ''লকডাউন চলাকালে রাতের একাকী ঘণ্টাগুলো কাটাতে বসে বসে রেডিও পোডকাস্ট শুনতাম। সেই সূত্রেই ভ্যাকসিন গবেষণার প্রক্রিয়া, স্বেচ্ছাসেবী সংগ্রহ সম্পর্কে জানতে পারি। ওই ঘটনাগুলো আমাকে দারুণ আন্দোলিত করতো। দেখাতো আশার আলো। আর এভাবেই আমি স্বেচ্ছাসেবক হওয়ার জন্য নাম লিখিয়েছি।''
''কাউকেই বাদ দেওয়া যাবে না। বয়স্ক হোন বা দরিদ্র কাউকেই নয়। তিনি অশ্বেতাঙ্গ বা পিছিয়ে থাকা জাতিগোষ্ঠীর মানুষ যেই হোন না কেন- সবার সুস্থ থাকার অধিকার রয়েছে, এটা আমি উপলদ্ধি করতে পারি। ওই উপলদ্ধি থেকেই অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেই। তাই এ সিদ্ধান্ত আমার জন্য পরিস্থিতিকে পরিবর্তন করার চেষ্টা। এখন নিজে জড়িত থাকায় পৃথিবীর বাস্তবতা নিয়ে আগের মতো হতাশ হইনা। নিজেকে বোঝাই আমি এটা করতে পারব। উন্নতির জন্য ভয় পেলে চলবে না। তাই আমি এ ঝুঁকি নিচ্ছি,'' তিনি যোগ করেন।
বিতর্কিত হলেও, তথাকথিত এ 'হিউম্যান চ্যালেঞ্জ ট্রায়াল' অবশ্য নতুন কোনো উদ্যোগ নয়। এর আগে কলেরা, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া এবং এমনকি সাধারণ সর্দি-কাশি সৃষ্টিকারী ফ্লু'র জীবাণুর বিরুদ্ধে টিকা তৈরির সময়েও- এ উদ্যোগের সাহায্য নিয়েছে চিকিৎসা বিজ্ঞান।
তবে এসব রোগের মতো কোভিড-১৯ এর কোনো প্রচলিত চিকিৎসা নেই। তাই পরীক্ষামূলক টিকা ব্যর্থ হলে তাতে অনেক বেশি প্রাণসংশয়ের ঝুঁকি থাকছে।
ওয়ান ডে সুনার' চ্যালেঞ্জে অংশ নেওয়ারা সকলেই আয়োজকদের পক্ষ থেকে তাদের দেওয়া সময় এবং অংশগ্রহণের জন্য কিছু অর্থ পাবেন। তবে সেই অর্থের অংক যাতে কম হয়, এমন পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের আশঙ্কা বেশি অর্থ দেওয়া হলে, অনেকে সেকারণেই এতে অংশ নিতে পারেন।
এর সমালোচকরা বলছেন, চ্যালেঞ্জ ট্রায়ালে শুধুমাত্র তরুণ এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারীরা এতে অংশ নেওয়ায়, তা সকল জনসমষ্টির প্রতিনিধিত্ব করে না। তাই এর মাধ্যমে সকলের জন্য উপযোগী টিকা তৈরি করা সম্ভব নাও হতে পারে।
এর মধ্যে, গত মাসেই যুক্তরাজ্য সরকার জানায়, এধরনের উদ্যোগের সাহায্যে স্বেচ্ছাসেবী সংগ্রহে তারা আয়োজকদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। আলোচনা সফল হলে করোনাভাইরাস টিকা তৈরির ক্ষেত্রে এটি পৃথিবীর প্রথম এমন ট্রায়ালের ঘটনা হবে।
টিকা গবেষণায় জড়িত ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলো অবশ্য চ্যালেঞ্জ ট্রায়াল নিয়ে উৎসাহী নয়। ইতোমধ্যেই, অ্যাস্ট্রাজেনেকা, সানোফি এবং বায়োএনটেক-সহ বেশ কিছু বৃহৎ কোম্পানি এতে অংশ না নেওয়ার কথা জানিয়েছে।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ১১টি করোনা ভ্যাকসিন তৃতীয় বা শেষ ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর্যায়ে রয়েছে। প্রচলিত এ ব্যবস্থার আওতায় হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবীর দেহে প্রার্থী টিকা প্রয়োগ করার পর তাদের দৈনন্দিন জীবন-যাপনের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়। ওই অবস্থায় তাদের অনেকই কোভিড-১৯ আক্রান্ত হবেন, এমন আশা করেন বিজ্ঞানীরা। এবং তার ভিত্তিতে পরীক্ষাধীন টিকা তাদের দেহে সংক্রমণের বিরুদ্ধে কেমন প্রতিরোধ গড়ে তুলছে, সেটা তারা জানার চেষ্টা করেন।
লন্ডন স্কুল অব হাউজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ পিটার স্মিথ বলেন, ''প্রথমদিকে যেসব টিকা পরীক্ষা করা হবে, সেগুলো যে সবচেয়ে সেরা হবে না তা বলাই বাহুল্য। একারণেই, আমি চ্যালেঞ্জ ট্রায়ালের দরকার আছে বলে মনে করি। এর মাধ্যমে অনেকগুলো প্রার্থী টিকার গবেষণা একযোগে চালানো যাবে।''
চ্যালেঞ্জ ট্রায়াল নিয়ে ব্রিটিশ সরকার অনেকদূর এগিয়েছে। এই অগ্রগতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় দেশটির জাতীয় স্বাস্থ্য গবেষণা কর্তৃপক্ষের (এইচআরএ) সুবাদে। তারা এবিষয়টি নিয়ে ভাবা শুরু করেছে।
মানবদেহে যেকোনো টিকা পরীক্ষার আগে সংস্থাটির অনুমোদন দরকার। আর এজন্য তারা চ্যালেঞ্জ ট্রায়ালের চিকিৎসা বিজ্ঞান সংক্রান্ত নৈতিকতা পর্যালোচনায় একটি বিশেষ প্যানেলও গঠন করেছে।
'সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত গবেষণার সংখ্যা অনেক কম। সব ধরনের টিকা তৈরির সময়েই বেশকিছু ঝুঁকি থেকে যায়,' বলছিলেন সংস্থাটির প্রধান টেরেন্স স্টিফেনসন।
''প্রতিদিন আমাদের দেশে এবং বিশ্বের সকল দেশে, স্বাস্থ্য কর্মীরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আক্রান্তের সেবা করে যাচ্ছেন। এটা তারা নিজ দায়িত্ববোধ থেকেই করছেন। তাই যেসব ব্যক্তি নিজ বিবেচনায় এবং সমাজের সকলের কথা চিন্তা করে ট্রায়াল চ্যালেঞ্জে অংশ নিতে চান, তাদের সে সুযোগ দেওয়া উচিৎ। ব্যক্তিগতভাবে আমি একে আশ্চর্য ঘটনা বলেও মনে করিনা,'' তিনি যোগ করেন।
তার সঙ্গে একমত চ্যালেঞ্জ ট্রায়ালের অংশ হতে নাম লেখানো ১৮ বছরের তরুণ অ্যালেস্টার ফ্রেজার- উরকুহার্ট। তিনি নিজের সিদ্ধান্তকে নেহাত মামুলি ঘটনা বলেই উল্লেখ করেন।
''সাধারণ জ্ঞান আমাকে এটা করার তাৎক্ষনিক তাগিদ দেয়। আমি তাই করেছি, যা অন্য অনেকেই করেছেন বা সুযোগ পেলে করতেন। এখানে আমার জন্য ঝুঁকি খুবই কম। কিন্তু, আমি নিজে কম ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন নিজেদের অজ্ঞাতেই কোভিড-১৯ আক্রান্ত হচ্ছেন, এমন হাজারো মানুষকে রক্ষায় সাহায্য করতে পারব।''
গত জুনে এসব নিয়ে ভেবেছিলেন ফ্রেজার। ওই মাসেই তিনি ওয়ান ডে সুনার' ক্যাম্পেইনে নাম লেখান। এটি এখন চ্যালেঞ্জ ট্রায়াল অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ সরকারের সবচেয়ে বড় সহযোগী হিসেবেও কাজ করছে।
ফ্রেজার শুধু নাম লিখিয়েই ক্ষান্ত হননি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি এক বছর পিছিয়ে তিনি এ ট্রায়ালে সেই সময়টা ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নেন।
আর সবকিছু ঠিকঠাক চললে, এবং সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার অনুমোদন পাওয়া গেলে, ফ্রেজারকে বাইরের জীবাণু থেকে সুরক্ষিত এক স্থাপনায় নিয়ে গিয়ে পরীক্ষামূলক টিকা দেওয়া হবে। এরপর সেখানেই তাকে সীমিত মাত্রায় সংক্রমিত করা হবে। তখন তাকে টানা কয়েক সপ্তাহ ওই পরিবেশে কঠোর নজরদারিতে রাখবেন বিজ্ঞানীরা। পুরো সময়টা অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একাকী এক ঘরে থাকতে হবে ফ্রেজারকে।
পুরো বিষয়টা শুনতে যতটা কঠিন শোনায়, বাস্তবে এর স্নায়বিক ও মানসিক চাপ অনেক বেশি।
তাছাড়া, সাধারণ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের তৃতীয় পর্যায়ে অনেকেই বিকল্প একটি ওষুধের নির্যাস পান। তাদের প্রার্থী টিকা নিতে হয় না। ভ্যাকসিন না পাওয়া এ ব্যক্তিরা সংক্রমিত হলে, কী ঘটে তা দেখার জন্যেই এ ব্যবস্থা। সেই তুলনায় চ্যালেঞ্জ ট্রায়ালে অংশ নেওয়াদের শুধু পরীক্ষামূলক বা অপ্রমাণিত একটি টিকা নিতে হবে তাই না, বরং প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় জীবাণুর সংস্পর্শে আসতে হবে। চিকিৎসার সুযোগ এবং বিজ্ঞানীদের উপস্থিতি সত্ত্বেও যা নিঃসন্দেহে প্রবল সাহসীকতার কাজ।
- সূত্র: সিএনএন
- অনুবাদ: নূর মাজিদ