এখনও তালেবানদের সমর্থন করে যে গ্রাম্য আফগান পরিবার
মাটির দেয়ালে তৈরি পরিচ্ছন্ন-ঠান্ডা একটি ঘর। শামসুল্লাহ নামক জনৈক ব্যক্তি তার অতিথিদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন, বসালেন সেই ঘরে। মেঝেতে কার্পেট বিছানো, তার উপরে পাতা ম্যাট্রেস অন্তত দুই ফুট উঁচু, দেয়ালে হেলান দেওয়া রয়েছে কিছু কুশন।
ঘরের ভেতরে অন্য আসবাব বলতে একটা ছোট ক্যাবিনেট, তার উপর ছয়টি ছোট, রঙিন কাঁচের বোতল সাজানো। ঘরের অবস্থা দেখেই বোঝা যায় পরিবারটি দরিদ্র। কারণ তাদের সহায়-সম্পত্তি যা ছিল, গত ২০ বছরের যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে গেছে কিংবা লুট হয়েছে। কিন্তু তবুও এই পরিবারটি তালেবান শাসনকেই সমর্থন করে...
বলা হচ্ছে আফগানিস্তানের হেলমান্দ প্রদেশের মারজাহ অঞ্চলের একটি বাড়ির কথা, একটি পরিবারের কথা। মারজাহ'র অন্যান্য বাড়ির মতো এটিও হয়ে উঠেছিল এক যুদ্ধক্ষেত্র।
শামসুল্লাহ তার মা গোলজুমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন সংবাদমাধ্যম বিবিসির সাংবাদিকদের। গোলজুমার বয়স ৬৫ বছর। আপাদমস্তক শালে জড়িয়ে তিনি হাজির হন। শুধু চোখ দিয়ে দেখার জায়গাটুকু বাদে তার পুরো শরীরই ছিল ঢাকা। কাপড়ের ফাঁক দিয়ে কখনো কখনো তার চোখ বা নাকের ডগা সামান্য দেখা যাচ্ছিলো।
কিন্তু যখন তিনি নিজের দুঃখ-দুর্দশায় ভরা জীবন এবং যুদ্ধের গল্প শুরু করলেন, তখন গোলজুমার কন্ঠস্বর ছিল তীব্র ও স্পষ্ট। এই যুদ্ধেই তিনি হারিয়েছেন জীবনের সমস্ত সুখ, হারিয়েছেন তার চার বড় ছেলেকে।
গোলজুমার সর্বকনিষ্ঠ ছেলে, শামসুল্লাহই এখন শুধু বেঁচে আছেন। শামসুল্লাহর বয়স ২৪ বছর। কিন্তু মুখ দেখলে মনে হবে, তার বয়স আরও দশ বছর বেশি।
১১ বছর আগে গোলজুমার বড় ছেলে জিয়া উল হক মারা যান। জিয়া ছিলেন একজন তালেবান যোদ্ধা। গোলজুমা বলেন, "আমার ছেলে তালেবানদের সাথে যোগ দিয়েছিল, কারণ সে বুঝেছিল যে আমেরিকানরা ইসলাম ও আফগানিস্তানকে ধ্বংস করতে চায়।"
২০১৪ সালে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে আরও তিন ছেলেকে হারান গোলজুমা। ছেলেদের একজন, কুদরাতাল্লাহ বিমান হামলায় মারা যান। বাকি দুই ভাই হায়াতুল্লাহ এবং আমিনুল্লাহ নিজ বাড়ি থেকে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। শামসুল্লাহর ভাষ্যে, তার দুই ভাইকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করা হয় এবং তাদেরকে সেখানেই হত্যা করা হয়। শামসুল্লাহ মনে করেন, পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ার জন্যই আল্লাহ এখনও পর্যন্ত তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।
"আপনি কখনো এক হাতে পাঁচটা তরমুজ নিয়ে হাঁটতে পেরেছেন? আমার জন্য ব্যাপারটা তেমনই।" শামসুল্লাহকে তার মা এবং বিধবা ভাবির দেখাশোনা করতে হয়।
"আমার ভাইদের কথা মনে পড়ে আমার। আমার বড় ভাই মারা যাওয়ার পর, পরের ভাইটি বড় ভাইয়ের স্ত্রীকে বিয়ে করে। সেও মারা যাওয়ার পর, তার পরেরজন ভাবিকে বিয়ে করে। সে মারা যাওয়ার পর চতুর্থ ভাইটি তাকে বিয়ে করে। সর্বশেষে, এই ভাইও মারা গেলে, আমি তাকে বিয়ে করি", বলেন শামসুল্লাহ।
২০১০ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নির্দেশে মার্কিন সেনাবাহিনীর অপারেশন ক্ষেত্র হিসেবে মারজাহকে বেছে নেওয়া হয়। সেই বছর মার্কিন সেনাবাহিনী বলেছিল, "আমরা তালেবানদের উৎখাত করতে পারলেই, আগামীতে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যত তৈরি হবে। ভালো স্কুল, ভালো হেলথ ক্লিনিক, মুক্ত বাজার তৈরি হবে।"
কিন্তু মারজাহ'র তুলা এবং আফিমের ক্ষেতগুলো মার্কিন সেনাদের জন্য এক বিভীষিকা হয়ে দাঁড়ায়। দীর্ঘ তিন মাস যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়ার পর ইউএস কমান্ডার জেনারেল স্ট্যানলি ম্যাকক্রিস্টাল মারজাহকে 'একটি রক্তক্ষয়ী আলসার' হিসেবে আখ্যা দেন। পরবর্তী দশ বছরে আরও অসংখ্যবার রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে মারজাহ।
গোলজুমা পশ্চিমা নেতাদের ঘৃণা করেন; যারা কিনা বলেছিল, আফগানিস্তানকে একটি সুন্দর দেশে পরিণত করতে চায়। কিন্তু বিনিময়ে যা পেয়েছেন, তা গোলজুমা চাননি, "আমি তাদের মিশন সম্পর্কে কিছুই জানিনা। কিন্তু তারা এই দেশকে ধ্বংস করেছে।"
তালেবানরা ক্ষমতায় আসার আগে নারীরা যেসব সুযোগ-সুবিধা পেত, এখন তারা সেসব সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে, এমন কথার প্রেক্ষিতে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি। "আমেরিকানরা সৈন্যরা থাকতে আমাদের এখানকার মানুষ অনেক ভোগান্তির শিকার হয়েছে। তারা আমাদের স্বামী, ভাই ও ছেলেদের হত্যা করেছে। আমি তালেবানদের পছন্দ করি, কারণ তারা ইসলামকে সম্মান করে। আমার মতো নারীরা আর কাবুলের নারীরা এক নয়", বলেন গোলজুমা।
গোলজুমা আরও জানান, এতদিন যাবত সবাই তালেবানদের ভয় পেত। কিন্তু এবার তারা ক্ষমতায় আসার পর এ অঞ্চলের সবাই স্বস্তি পেয়েছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, গোলজুমা কি আসলেই স্বাধীনভাবে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করেছেন? নাকি তালেবানের ভয়ে ভীত হয়ে কথাগুলো বলেছেন?
বিবিসির টিমকে একজন তালেবান বডিগার্ড এবং দোভাষী সাথে দিয়ে হেলমান্দে যাওয়ার অনুমতি দেয় তালেবান কর্তৃপক্ষ। সাথে তালেবান যোদ্ধারা না থাকলে হয়তো গোলজুমার মুখ থেকে ভিন্ন কথা শোনা যেত!
কিন্তু হেলমান্দ প্রদেশের ঐতিহ্যবাহী কৃষি কাজে বাধা দেওয়ায় এবং নিজের চার সন্তানের মৃত্যুর জন্য যখন গোলজুমা মার্কিন সেনাদের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানালেন, তখন বোঝা গেল, তিনি সত্যিই তালেবানদের উপর ভরসা করেন।
৯/১১ এর হামলার কিছুদিন পরেই আমেরিকা, যুক্তরাজ্য ও তাদের মিত্ররা মিলে আফগানিস্তানে হানা দেয়। উদ্দেশ্য ছিল, আল-কায়েদাকে ধ্বংস করা এবং তাদেরকে আশ্রয় দেওয়ায় তালেবানদেরও সাজা দেওয়া।
পরবর্তী ২০ বছরে মার্কিন সেনাদের কার্যক্রম ও যুদ্ধকে পুরোপুরি বোঝা কিংবা এর পক্ষে যুক্তি দেওয়া কঠিন। আফগানিস্তানের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে আমেরিকার প্রচেষ্টার বুক চিরেই বয়ে গেছে এমন এক যুদ্ধ, যা মার্কিন সেনারা জিততে পারেনি।
পশ্চিমা প্রভাবে এসে শহুরে আফগান প্রজন্ম উন্নয়নের সুবিধা পেয়েছে, শিক্ষিত হয়ে আধুনিক জীবনে প্রবেশ করেছে, তা সত্যি। কিন্তু গোলজুমার পরিবারের মতো, বহু গ্রামীণ মানুষের কাছে সেই উন্নয়ন পৌঁছায়নি।
১৯৯৬ সালে যখন তালেবানরা ক্ষমতা দখল করে, তখন তারা নিজস্ব ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নিয়মকানুন চাপিয়ে দিতে সহিংসতার পথ অবলম্বন করেছিল। কিন্তু এখন অধিকাংশ আফগানই অল্পবয়স্ক এবং ৯/১১ এর আগের যুগের কথা তাদের মনে নেই।
লশকর গাহ'তে তরুণ তালেবান যোদ্ধারা গণমাধ্যম কর্মীদের দেখে নিজেদের ক্যামেরা বের করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে, সেলফি নেয়, ভিডিও করে। মোবাইল ডেটা এখানে সস্তায়ই কেনা যায়। তালেবানরা এখন আর বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, তারা এখন আধুনিক জগতের খোঁজখবর রাখে।
তাই প্রশ্ন হচ্ছে, তালেবানরা সমগ্র দেশ তো দূরে থাক, নিজেদের যোদ্ধাদেরই কি মোবাইল ফোন ব্যবহার বাদ দেওয়ার জন্য জোর করতে পারবে? এবার হয়তো আফগানিস্তানে নিজেদের নিয়মকানুন চাপিয়ে দেওয়াটা কঠিনই হবে তাদের পক্ষে!
- সূত্র: বিবিসি