করোনাভাইরাস উপসর্গ বুঝবেন ছয় শ্রেণিতে, গবেষণা
কোভিড-১৯ রোগের উপসর্গগুলোকে ছয়টি স্বতন্ত্র শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, জানিয়েছেন গবেষকরা। আলোচ্য গবেষণার মধ্য দিয়ে একজন রোগীর ভেন্টিলেটর বা শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার অন্যান্য সাহায্য দরকার কিনা, তা আগেভাগেই অনুমান করা সম্ভব।
গবেষকরা জানান, অনুসন্ধানের ফলাফল বেশকিছু বিষয় নির্ধারণে যথেষ্ট সময় থাকতেই সতর্ক করতে পারে স্বাস্থ্য কর্মীদের। এর মধ্যে রয়েছে; নির্দিস্ট উপসর্গগুচ্ছ শ্রেণির রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজনীয়তা এবং এ ধরনের রোগীদের শ্বাসকষ্টের সমস্যা হলে কী ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন সে সম্পর্কে অগ্রিম প্রস্তুতি নেওয়ার সক্ষমতা।
এছাড়া কোন উপসর্গের রোগীদের শারীরিক অবস্থার অবনতি কত দ্রুত হতে পারে, তাও জানতে পারবেন চিকিৎসকরা। এমন রোগীরা বাড়িতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে, তাদের জরুরি ভিত্তিতে অক্সিজেন সরবরাহ করা যাবে। নার্সরাও বাড়ি গিয়ে প্রয়োজনের সময় সেবা দিতে পারবেন। আবার জরুরিভাবে হাসপাতালে নেওয়ার দরকার হলে,সেক্ষেত্রে দ্রুত অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থাও করা যাবে।
গবেষক দলটি জানায়, বর্তমানে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার পর গুরুতর অসুস্থদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া পর্যন্ত ১৩ দিন সময় লাগে। কিন্তু, এখন আক্রান্তদের শারীরিক চিহ্নগুলোর ভিত্তিতে প্রস্তুতির সময় পাবেন স্বাস্থ্য কর্মীরা।
রোগীর দেহে উপসর্গগুলো দেখা দেওয়ার পাঁচদিন পর, তাদের লিঙ্গ,বয়স এবং পূর্বের শারীরিক অবস্থা অনুসারে ৭৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই পরবর্তীতে এসব রোগীর শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দেবে কিনা, তা সঠিকভাবে অনুমান করতে পেরেছেন গবেষকরা। চিকিৎসকরাও এমন আগেভাগে অনুমানের অবকাশ পাবেন এরফলে।
গবেষণার সহ-লেখক লন্ডনের কিংস কলেজের অধ্যাপক টিম স্পেকটর বলেন, ''হাসপাতালে অর্ধ-মৃত অবস্থায় রোগীদের আসা ঠেকাতে আগেভাগেই কিছু করা গেলে, তাতে রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বহুগুণে বেড়ে যায়। এতে হাসপাতালে রোগীর চাপও কমতে পারে অনেকাংশে।''
সাম্প্রতিক গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে মেডআরজিভ (medRxiv) জার্নালে, যা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের পর্যালোচনার আওতাধীন রয়েছে। ইতোপূর্বে কোভিড-১৯ এর উপসর্গ শনাক্তে গবেষক দলটি একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করে। যুক্তরাজ্যের ৪০ লাখ মানুষ অ্যাপটি ব্যবহার করছেন। এদের মধ্যে ১৬৫৩ জন কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী ছিলেন, যারা নিয়মিত তাদের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানিয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে ৩৮৩ জন পরবর্তীতে হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হন। আর শ্বাসকষ্টের তীব্র সমস্যায় অক্সিজেন বা ভেন্টিলেটরের সাহায্য নেন ১০৭ জন।
এসকল তথ্য গবেষণায় ব্যবহার করা হয়। বিজ্ঞানীদের দলটি, ১৪ ধরনের সংক্রমণ উপসর্গ শনাক্ত করেন। মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম বা এক ধরনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে, এর মধ্যে কোন কোনটি একত্রে দেখা দিতে পারে, এমন সম্ভাবনা খতিয়ে দেখেন। গবেষণায় দেখা যায়, প্রায় ছয়টি উপসর্গ শ্রেণিগুচ্ছ এক্ষেত্রে রোগীদের মধ্যে দেখা যায়। আক্রান্ত হওয়ার প্রথম ১৪ দিনের মধ্যেই এসব উপসর্গ ধীরে ধীরে রোগীদের দেহে দেখা যায়।
কিংস কলেজের আরেক বিশেষজ্ঞ এবং গবেষণাপত্রের জ্যেষ্ঠ ক্লিনিক্যাল লেখক ডা. ক্লেইরে স্টিভস জানান, ''ছয়টি উপসর্গগুচ্ছের মধ্যে আমরা সুনির্দিষ্ট পার্থক্য লক্ষ্য করেছি। বিশেষ করে, পরবর্তীতে যেসব রোগীর শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দেয় তাদের উপসর্গ গুচ্ছগুলো ছিল একে-অপর থেকে পৃথক ধরনের।''
শনাক্ত করা ছয়টি উপসর্গ গুচ্ছ বা শ্রেণি হচ্ছে;
শ্রেণি ১: ফুসফুসের উপরিভাগ আক্রান্ত হওয়ার লক্ষ্মণ দেখা যায়। এক্ষেত্রে ঘন ঘন কাশি এবং মাংসপেশি ব্যথা থাকে। এই গ্রুপের মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশ রোগীকে শ্বাসকষ্টের কারণে বাড়তি অক্সিজেন সহায়তা নিতে হয়। ১৬ শতাংশকে এক বা একাধিকবার হাসপাতালেও যেতে হয় এ কারণে। গবেষণার আওতায় থাকা আক্রান্তদের বেশিরভাগ বা ৪৬২ জনের দেহে এমন উপসর্গগুচ্ছ লক্ষ্য করা গেছে।
শ্রেণি ২: এক্ষেত্রেও ফুসফুসের উপরিভাগ আক্রান্ত হওয়ার উপসর্গগুলো দেখা যায়। সঙ্গে থাকে খাদ্য গ্রহণে অনীহা এবং জ্বর। এই গ্রুপের ৪ দশমিক ৪ শতাংশ রোগীকে শ্বাসকষ্টজনিত কারণে কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রের সহায়তা নিতে হয়েছে। আর হাসপাতালে এক বা একাধিকবার গেছেন এদের মধ্যে ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ।
শ্রেণি ৩: এ উপসর্গগুচ্ছের রোগীদের পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা যেমন ডায়রিয়া লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া অন্যকিছু উপসর্গও থাকে। এই গ্রুপের ৩ দশমিক ৭ শতাংশ রোগীকে পরবর্তীতে শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য বাড়তি সহায়তা নিতে হয়েছে। আর হাসপাতালে এক বা একাধিক বার ভর্তি হয়েছিলেন এদের ২৪ শতাংশ।
শ্রেণি ৪: শরীর অবসন্ন ভাব এবং ক্লান্তির প্রবণতা এক্ষেত্রে প্রথমে দেখা দেয়। সঙ্গে থাকে বুক ব্যথা এবং কাশি। এ গ্রুপের ৮ দশমিক ৬ শতাংশ রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাসের সহায়তা দরকার হয়। আর হাসপাতালে এক বা একাধিকবার ভর্তি হয়েছেন ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ।
শ্রেণি ৫: মানসিক বিষাদ, খাদ্য গ্রহণে অনীহা এবং তীব্র ক্লান্তিভাব একসঙ্গে দেখা দেয়। এ গ্রুপের ৯ দশমিক ৯ শতাংশ রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাসের সহায়তা দরকার হয়। হাসপাতালে এক বা একাধিকবার ভর্তি হয়েছেন এদের ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ।
শ্রেণি ৬: প্রথম থেকেই শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা যায়। বিশেষ করে, বুক ব্যথা এবং নিঃশ্বাস না নিতে পারার মতো অনুভূতি হয়। মানসিক বিভ্রান্তি, ক্লান্তি এবং পাকস্থলীর সমস্যা এর সঙ্গে সঙ্গে দেখা দেয়। এই গ্রুপের ২০ শতাংশ রোগীর যান্ত্রিক শ্বাসপ্রশ্বাস যন্ত্রের সহায়তা দরকার হয়। এদের মধ্যে ৪৫ দশমিক ৫ শতাংশকে এক বা একাধিকবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে।
গবেষকরা জানান, প্রথম দুই উপসর্গগুচ্ছ কোভিড-১৯ এর গুরুতর সংক্রমণ পরিস্থিতি নয়। কিন্তু তারপরের গুলো ধীরে ধীরে সংক্রমণের জটিলতা ও রোগীর শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপের দিকে যাওয়ার ঝুঁকি তুলে ধরছে।