কেন ভারতে এই কৃষক আন্দোলন?
গত সেপ্টেম্বরে ভারতের কৃষিখাত সংস্কারের লক্ষ্যে তিনটি কৃষি আইন পাস হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানিয়েছেন নতুন আইনের মাধ্যমের মধ্যসত্ত্বভোগীদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাবে কৃষকরা।
তবে কৃষকরা মনে করছেন নতুন এই আইনের ফলে তাদের লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি। এই আইনের কারণে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোই লাভবান হবে এমন আশঙ্কা থেকেই রাস্তায় নেমে এসেছেন তারা।
এরফলে শুরু হয়েছে বিগত বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় কৃষক বিদ্রোহ। গত সপ্তাহে ভারতের উত্তরাঞ্চলের পাঞ্জাব ও হরিয়ানা প্রদেশের হাজার হাজার কৃষক জড়ো হয়েছেন রাজধানী দিল্লিতে। দিল্লিতে প্রবেশের আগেই শহরের সীমান্তে পুলিশি বাঁধার মুখে পড়েন তারা। গত দশদিন ধরে দিল্লির সাথে পাঞ্জাব ও হারিয়ানার সংযোগ অচল করে রেখেছেন তারা।
বিতর্কিত আইন
নতুন এ আইনে কৃষিপণ্য বিক্রি, গুদামজাতকরণ ও মূল্য নির্ধারণ নীতিতে পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে সরকার নির্ধারিত বাজার (মান্দিস) ছাড়াও বেসরকারি ক্রেতাদের কাছে পণ্য বিক্রি করতে পারবেন কৃষকরা। ভারতে এ পদ্ধতি 'কন্টাক্ট ফার্মিং' হিসেবে পরিচিত। এছাড়া নতুনে আইনে ব্যবসায়ীদের পণ্য মজুদের অনুমতিও দেয়া হয়েছে। এরফলে মহামারির সময় ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে পণ্য মজুদ করে লাভবান হবেন ব্যবসায়ীরাই। ইতোপূর্বে ভারতের কৃষি আইনে পণ্য মজুদ করা অপরাধ হিসেবে গণ্য হতো।
নতুন আইনের সমস্যা
নতুন আইনের ব্যাপারে কৃষকদের অভিযোগের মধ্যে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো এ আইনের মাধ্যমে তাদের রক্ষাকবচ কেড়ে নেয়া হয়েছে। ভারতের মোট কৃষিজমির ৮৬ শতাংশই ক্ষুদ্র কৃষকদের। তাদের জমির পরিমাণ ২ হেক্টরেরও কম। বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে দরদাম করে ন্যায্য মূল্য পাবেন না তারা এমনটাই আশঙ্কা তাদের। পাঞ্জাবের কৃষক রাশপিন্দর সিং আল-জাজিরাকে জানান, "সরকার আমাদের বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে জিম্মি করে করুণার পাত্র বানিয়েছে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলর সাথে দরদাম করে কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পাবে এ চিন্তা একেবারেই অমূলক।"
আইনের সহায়তাও থাকবে না
নতুন এ আইনের ফলে সমস্যা সমাধানে কৃষকরা সমঝোতা বোর্ড গঠনের দাবী জানাতে পারবেন মাত্র। এ আইনের কারণে সমস্যা নিয়ে আদালতে যাওয়ার সুযোগও থাকছে না।
এছাড়াও নতুন আইনের অধীনে কৃষকদের সাথে চুক্তির ক্ষেত্রে এমনকি লিখিত চুক্তিও বাধ্যতামূলক নয়। ফলে চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন হলেও আদালতে প্রমাণ করার সুযোগও থাকবে না এক্ষেত্রে। বড় প্রতিষ্ঠানের সাথে ব্যবসা করার অন্যান্য সমস্যা তো আছেই। সার ও বীজের মতো কৃষিপণ্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিক্রি করায় প্রতিবছর বর্ধিত দাম পরিশোধ করতে হয় কৃষকদের।
নির্ধারিত মূল্য
নতুন এ আইনের আওতায় কৃষিপণ্যের মূল্যও নির্ধারিত থাকবে না। কৃষিপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যও (এমএসপি) বিলুপ্ত হয়ে যাবে এমন আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। ফলে নির্দিষ্ট যেসব কৃষিপণ্যে এমএসপি আছে সেসব কৃষকদের জন্য বিরাট ক্ষতি বয়ে আনবে এ আইন।
ভারত সরকারের অবস্থান
নতুন আইনের কারণে কৃষকদের ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই বলে গুজব ছড়িয়ে কৃষকদের উত্তেজিত করার জন্য বিরোধী দলকে দায়ী করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। "কৃষকদের কথা চিন্তা করেই নতুন কৃষি আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। সামনের দিনগুলোতেই আমরা এর সুফল দেখতে পাবো।"
আন্দোলনের বর্তমান অবস্থা
গত বৃহস্পতিবার সরকারের সাথে বৈঠকে কৃষক নেতারা তাদের দাবী-দাওয়া তুলে ধরেন। তবে ব্যর্থ হয়েছে দীর্ঘ এ আলোচনাও। শনিবার কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিং-এর সাথে আলোচনায় বসেন ৩৫ জন কৃষক নেতা।
নতুন আইনের মূল্য নির্ধারণ সংক্রান্ত নীতি সংশোধনের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন তারা। সম্পূর্ন আইন বাতিলের পক্ষেই তাদের দাবী জানিয়ে এসেছেন কৃষক নেতারা।
কৃষক ইউনিয়নের এক নেতা ডিপিএ নিউজ এজেন্সি-কে বলেন, "তারা আমাদের কিছু ধারা সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে। তবে আমরা সম্পূর্ন আইন বাতিল চাই। নতুন আইন প্রণয়ন করতে হলে কৃষকদের সংগঠনগুলোর সাথে আলোচনা করেই করতে হবে।"
শনিবার আলোচনার পর কৃষক নেতারা জানিয়েছেন দিল্লির চারপাশের সীমান্ত অবরুদ্ধ করে আন্দোলন আরও জোরদার করতে প্রস্তুত তারা। সেইসাথে ৮ ডিসেম্বর পুরো ভারত জুড়ে বিক্ষোভের ঘোষণা দেন । সরকার এ 'কালো আইন' বাতিল না করলে ভারতের সব মহাসড়কের সবগুলো টোল গেট দখল করার কথা জানিয়েছেন তারা।
আন্দোলনের সাথে জড়িত একজন কৃষক গত শনিবার এনডিটিভি-কে জানিয়েছেন, ভারতের আগামী প্রজাতন্ত্র দিবস (২৬ জানুয়ারি) পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যেতে প্রস্তুত তারা। প্রয়োজন হলে এরপরও আন্দোলন চালিয়ে যাবার প্রস্তুতি নেবেন তারা।
- সূত্র: আল জাজিরা