খাশোগি হত্যাকাণ্ড তাঁর পর্যবেক্ষণেই ঘটেছে, বললেন সৌদি যুবরাজ
সাংবাদিক জামাল খাশোগির নৃশংস হত্যার দায় তাঁর ওপরেই বর্তায় এমনটা বললেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। আগামী সপ্তাহে প্রচারিতব্য একটি পিবিএস (পাবলিক ব্রডকাস্টিং সার্ভিস) ডকুমেন্টারিতে এ কথা বলেছেন তিনি।
নিজের দায়ের কারণ হিসেবে তিনি ‘তাঁর পর্যবেক্ষণের মধ্যেই ঘটনাটি ঘটেছে’ বলে জানান।
সালমানই এখন মূলত সৌদি আরবের প্রকৃত শাসক। গত বছর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনসুলেট অফিসে জামাল খাশোগির নির্মম হত্যাকাণ্ড গোটা বিশ্বে আলোড়ন তোলে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো (সিআইএ) এবং বেশ কিছু পশ্চিমা সরকার এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সালমানকে বরাবর দায়ী করে এসেছেন। কিন্তু সৌদি কর্মকর্তারা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
খাশোগি হত্যার তথ্যগুলো পত্রপত্রিকায় আসার পর যুবরাজ সালমানের ভাবমূর্তি সমালোচনার মুখে পড়ে। এর রোমহর্ষক বিবরণ পড়ে শিউরে ওঠেন সংবেদনশীল মানুষ।
অথচ সম্প্রতি নানাভাবে সৌদি সমাজে পরিবর্তনের হাওয়া আনতে তাঁরই বড় ভূমিকা দেখা যাচ্ছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল-রপ্তানিকারক দেশ সৌদি আরব। সালমান এমন কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছেন যা অর্থনীতিকে বহুমুখী করবে। এমনকি সৌদি সমাজের সনাতন ধারায় কিছু পরিবর্তন আনার পেছনেও প্রণোদনা রয়েছে যুবরাজের।
তবে খাশোগি হত্যার পর সমালোচনার তীর তাঁর দিকে ছুঁড়ে উড়তে থাকায় তিনি এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের কোনো দেশে যাননি।
এমন পরিস্থিতিতেই সালমান পিবিএসের ওই ডকুমেন্টারিতে বললেন, “আমার পর্যবেক্ষণের মধ্যেই ঘটনাটা ঘটেছে... সব দায় আমার... কারণ আমার পর্যবেক্ষণের মধ্যেই ঘটেছে এটা।”
পিবিএস-এর মার্টিন স্মিথকে এ কথা বলেছেন তিনি। ডকুমেন্টারির নাম ‘দ্য ক্রাউন প্রিন্স অফ সৌদি আরাবিয়া’। পিবিএস একটি মার্কিন পাবলিক ব্রডকাস্টার ও টেলিভিশন প্রোগ্রাম ডিস্ট্রিবিউটর। ১ অক্টোবর তারা যুবরাজকে নিয়ে অনুষ্ঠানটি প্রচার করবে। ডকুমেন্টারির রিভিউটি এর মধ্যে প্রচার হয়েছে। তাতেই প্রিন্সকে এ উক্তি করতে দেখা যায়।
এদিকে,খাশোগি হত্যার এক বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে ২ অক্টোবর। সৌদি যুবরাজের সমালোচক হিসেবে পরিচিত সাংবাদিক জামাল খাশোগি ২০১৮ সালের ২ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে প্রবেশ করার পর নিখোঁজ হন। সৌদি সরকারের হাতে আটক ও খুন হওয়ার আশঙ্কায় স্বেচ্ছায় দেশত্যাগ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছিলেন তিনি।
প্রথমদিকে খাশোগি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নিজেদের সব ধরনের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছিলেন সৌদি কর্তৃপক্ষ। খাশোগি সেদিন কাজ সেরে সৌদি দূতাবাস থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন বলে তারা দাবি করতে থাকেন। তবে তুরস্ক কর্তৃপক্ষ এর প্রমাণ দিতে বললে সৌদি কর্তৃপক্ষ সেটা পারেননি।
এরপর অক্টোবরের (২০১৮) শেষ সপ্তাহে গোয়েন্দা সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে রয়টার্স জানায়, খাশোগিকে হত্যার জন্য স্কাইপে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের অতি ঘনিষ্ঠ সৌদ আল-কাহতানি স্কাইপে খাশোগির সঙ্গে বাদানুবাদে জড়ানোর পর খাশোগিকে হত্যার নির্দেশ দেন।
কাহতানির পরিচয় দিয়ে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে গত তিন বছরে তার ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। তিনিই যুবরাজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একাউন্ট পরিচালনা করতেন। যুবরাজের অভিষেকের পর দেশটির বেশ কয়েকজন ধনী ব্যক্তিকে আটক করার পেছনেও তার পরিকল্পনা ছিল। এর আগের বছর লেবাননের সাবেক প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরিকেও তিনিই গ্রেপ্তার করতে বলেছিলেন। সর্বশেষ খাশোগি হত্যার সঙ্গেও তার নাম জড়িয়ে পড়ে।
২ অক্টোবর (২০১৮) খাশোগি ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেট ভবনে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে সেখানে আটক করা হয় বলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সূত্রে জানতে পারে রয়টার্স। আটকের পর কাহতানি স্কাইপের মাধ্যমে সরাসরি ইস্তাম্বুলে কনস্যুলেটের সঙ্গে যুক্ত হন। সেখানে খাশোগির সঙ্গে তার উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। এর পরই তিনি খাশোগিকে হত্যার নির্দেশ দেন।
সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম অবশ্য এরপর জানায় যে, খাশোগি হত্যায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠার পর কাহতানিসহ চার কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করেছেন সৌদি বাদশাহ সালমান।
এ বছরের মার্চের সর্বশেষ খবর অনুযায়ী কাহতানি গৃহবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। ১২ সেপ্টেম্বর ব্লুমবার্গ নিউজ কাহতানিকে বিষপ্রয়োগে হত্যার গুজব নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। সেখানে তার দুজন ঘনিষ্ঠজনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে যে, তিনি এখনও জীবিত।
ডকুমেন্টারিতে স্মিথ যুবরাজের কাছে জানতে চান কীভাবে তাঁর একজন কর্মকর্তা তাঁকে না জানিয়ে এ কাজ করতে পারেন। যুবরাজ এর উত্তর এভাবে দিয়েছেন, “আমাদের জনসংখ্যা ২ কোটি। আর সরকারি কর্তা রয়েছেন ৩০ লাখ।”
হত্যাকারীরা এরপর ব্যক্তিগত সরকারি জেট ব্যবহার করেছিল কি না সে বিষয়ে স্মিথ সালমানের কাছে জানতে চান। যুবরাজ এর উত্তরে বলেন, “সরকারি কর্মকর্তা আর মন্ত্রীরা রয়েছেন এসব দেখার জন্য। তারা এর জন্য দায়ী। তাদের এ ধরনের জেট ব্যবহারের ক্ষমতা রয়েছে।”
শেষ পর্যন্ত জানা গিয়েছে, ১১ জন সন্দেহভাজন সৌদি নাগরিককে গোপন প্রক্রিয়ায় বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল। কিন্তু তাদের শুনানি হয়েছে মাত্র অল্প কয়েকটি।
ওদিকে, জাতিসংঘের একটি রিপোর্ট যুবরাজ সালমান ও ঊর্ধ্বতন কযেকজন সৌদি কর্তাকেও তদন্তের অধীনে আনতে বলেছে।
গত জুনে রয়টার্সকে একজন ঊর্ধ্বতন মার্কিন সরকারি কর্মকর্তা জানান, ট্রাম্প প্রশাসন খাশোগি হত্যা তদন্তের ‘দৃশ্যমান অগ্রগতি’র জন্য রিয়াদকে চাপ দিচ্ছে।