চাকরির জালিয়াতি বাণিজ্যে জর্জরিত ভারত
গত বছরের জুলাইয়ের প্রথম দিন। নিজের জীবনবৃত্তান্ত (সিভি) আপলোড করার মাধ্যমে চাকরি খোঁজার ওয়েবসাইট 'নকরি ডট কম'-এ এক নারী তার নিবন্ধন সম্পন্ন করেন। এরপরেই নিয়োগকর্তার পরিচয়ে একজন তাকে ফোন করে জানায়, শীর্ষস্থানীয় এক রিয়েল-এস্টেট কোম্পানি সিনিয়র একটি পদের জন্য চাকরিপ্রার্থী খুঁজছে; এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে তাকে আবার ফোন করা হবে।
এমন একটি ফোন পাবার পর পেশায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এই নারী তার সব ব্যক্তিগত বিবরণী সাইটে উল্লেখ করেন। যখনকার কথা হচ্ছে ভারতে তখন ঘোর করোনাকাল।
সুদীর্ঘ লকডাউনের ফলে ভারতের ব্যবসাবাণিজ্যের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। অজস্র লোক চাকরি হারায়। পরিসংখ্যানে দেখা গেলো, ভারতের অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে ২৩.৯ শতাংশ। আর চাকরীপ্রার্থী নারীটি রাজধানী দিল্লির অধিবাসী, করোনার প্রভাব সামলাতে তিনি তখন হিমশিম খাচ্ছেন।
এক সপ্তাহ পর সেই রিয়েল-এস্টেট কোম্পানির মানব সম্পদ ম্যানেজার (এইচআর) তাকে ফোন করলেন এবং জানালেন তিনি পদটির জন্য নির্বাচিত হয়েছেন; চাইলে পরের মাস থেকেই চাকরিতে যোগদানও করতে পারবেন।
কিন্তু...তিনি যে চাকরির এই প্রস্তাবটি গ্রহণ করলেন তার নিশ্চয়তাস্বরূপ তাকে নিরাপত্তা ফী-সমেত একটি 'কমিটমেন্ট ফর্ম' পূরণ করতে হবে। চাকরিতে যোগদানের পর সে ফী তাকে ফিরিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হলো।
ফী হিসেবে চাকরীপ্রার্থী নারীর কাছে যে পরিমাণ টাকা চাওয়া হলো, প্রাথমিকভাবে তার অংক দাঁড়ায় ৬ লাখ ৮০ হাজার রূপি, যা প্রায় ৯,২০০ ডলারের সমতুল্য। ভারতের মত দেশে এভাবে এই বিপুল পরিমাণ টাকার দাবি সাধারণ দৃশ্যপটের ইংগিত দেয় না কিন্তু সে নারী চাকরিটি পাওয়ার জন্য এতে সায় দিলেন। তার ভাবনায় তখন কাজ করছিল চারপাশে যে হারে লোকজন ছাটাই হচ্ছে, তারও আশঙ্কা হচ্ছিল যে কোনো সময় তিনি তার বর্তমান কর্মস্থল থেকে বিতাড়িত হতে পারেন। যে কারণে তিনি নতুন চাকরির শর্তে রাজি হয়ে গেলেন, এবং কোম্পানিটির ফান্ডে টাকা ট্রান্সফার করার মনস্থির করলেন।
রিয়েল এস্টেট কোম্পানিটি এতেই থেমে থাকল না, তার শংসাপত্রগুলো (ক্রিডেনশিয়ালস) যাচাই এবং বিশ্বমানের কাজের সুবিধা নিশ্চিতের লক্ষ্যে আর কিছু খাতে নতুন ওজর তুলে আরো কিছু টাকা জমা দিতে বলল। তার জমা দাঁড়াল সব মিলিয়ে ২২ লাখ রূপি যা প্রায় ৩০হাজার ডলারের সমান। আর লেনদেনের এই পুরো সময়টাতেই কোম্পানিটি তাকে বারবার আশ্বস্ত করল যে, তিনি কাজে যোগ দেওয়ার পর পরই সব টাকা ফেরত পাবেন।
দিন যায়। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার নারীটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানির কাছ থেকে চাকরিতে যোগদানের জন্য চূড়ান্ত ডাকের অপেক্ষা করেন।
কিন্তু আর কোনো ফোন আসে না। তার সঙ্গে যোগাযোগকারী সেই এইচআর ম্যানেজারকেও আর পাওয়া গেল না। আগস্টে তার কাজে যোগ দেয়ার কথা ছিল; আগস্ট পেরোল, সেপ্টেম্বরও চলে গেল। বুঝতে বাকি রইল না, তিনি বুঝলেন, প্রতারণার শিকার হয়েছেন তিনি।
শেষে অক্টোবরের ৬ তারিখ, তিনি নিকটস্থ পুলিশ স্টেশনে গেলেন।
নাম -পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক সে নারী জানান, থানার কর্মকর্তা তার প্রতি সদয় হলেও তাদের হাতে খুব কম সূত্রই ছিল। প্রকৃত উৎস গোপন রেখে একটি ভার্চুয়াল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইন্টারনেট থেকে কল করা হয়েছিল বলে তাকে জানানো হয়। প্রতারকেরা নকরি ডট কম নামক ওয়েবসাইটটির কর্মী সাজার অভিনয় করে; আর বাস্তবে ওই রিয়েল-এস্টেট কোম্পানিটিরও মেলেনি কোনো হদিস।
ব্যাংক একাউন্ট ট্রান্সফারের সূত্র ধরে যে একাউন্টে টাকা পাঠানো হয়েছিল পুলিশ সেই পথে খানিকটা এগোয়। কিন্তু তাতে খুব যে ধোঁয়াশা কাটেনি তা নয়।
দিল্লি পুলিশ সাইবার ক্রাইম ইউনিটের কর্মকর্তা অজিত কুমার জানান, চাকরীপ্রার্থী মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার নারীটি যে একাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করেছিলেন তা আসলে একজন নিরাপত্তারক্ষীর; তিনি দিল্লির একটি হাউজিং কমপ্লেক্সে কাজ করেন।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সেই নিরাপত্তারক্ষী স্বীকার করে যে, দুই বছর আগে একজন লোক তার কাছে অদ্ভূত কিন্তু আকর্ষণীয় একটি প্রস্তাব নিয়ে আসে। তিনি তাকে কিছুদিনের জন্য সেই লোককে তার নিজের পরিচয় 'ধার' দিতে বলেন। তেমন কিছু না তার পরিচয়ে খোলা হবে একাধিক ব্যাংক একাউন্ট। প্রতিবার সে একাউন্টে যে কয়টি লেনদেন সম্পন্ন হবে সেখান থেকে নিরাপত্তারক্ষীটি পাবে ১০% কমিশন। নিরাপত্তারক্ষীকে পুলিশি জিম্মায় নেয়া হল; কিন্তু তার পরিচয় ধার নেওয়া বা পেছন থেকে কারা কলকাঠি নেড়েছে তা এক বিরাট রহস্য হয়েই রইল!
চাকরির আশায় ভারতে এভাবে প্রতারণার শিকার হওয়ার ঘটনা এটাই একমাত্র নয়। ভারতের বহু শিক্ষিত এবং যোগ্য নারী-পুরুষ কর্মস্থলের খোঁজে প্রতিনিয়ত এসব জব সাইটগুলোতে ঢুঁ মারেন এবং প্রতারণা চক্রের শিকার হন। বিপরীতে তাদের রক্ষার বা সেবা দেওয়ার জন্য রয়েছে একটি কাজের চাপে চিরেচ্যাপ্টা হওয়া এবং সীমিত লোকবলসম্পন্ন পুলিশ বাহিনী।
তবে এ ঘটনা আরেকটি দিকের প্রতিও নির্দেশ করে। করোনায় ভারতের অর্থনীতি বড় ধাক্কা খেয়েছে।
ভারতে বসবাসকারী মানুষের এখনো বড় একটা অংশের দিন আনে দিন খায় অবস্থা; মধ্যবিত্তদের জন্যও বাড়ন্ত জীবনযাত্রার মানের সাথে নিত্যকার লড়াইও প্রতিদিন যেন কঠিনতর হয়ে উঠছে। মহামারীতে সবার অর্থনৈতিক অবস্থাকে একেবারে টালমাটাল অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। এতদিনকার উন্নয়নের রথের গতি করোনার থাবায় যেন উলটোপথে ছুটছে!
মহামারীর আক্রমণে টিকে থাকতেই যেন দাঁড়িয়ে গেল- এই জালিয়াত চক্রের অর্থনীতি। ভুয়া কাজের প্রস্তাব দিয়ে যারা ফোন করেছে, যারা পরিচয় লুকিয়েছে, যাদের এতদিনের তিলে তিলে জমানো সঞ্চয়ের টাকার সাথে প্রতারণা করা হয়েছে- প্রতারিত সবার গল্পই আলাদা, অভিনব; প্রতিটি একেকটি কষ্টের উপাখ্যান।
ভারতে চাকরি পাওয়া, কর্পোরেট জীবনে প্রবেশ করা কোনটিই সহজ নয়। এখানে জাত, পারিবারিক পটভূমি, লিঙ্গ, ভাষা এবং ধর্ম-সবকিছুর সাথে মানুষকে সংগ্রাম করে এগিয়ে যেতে হয়। দেশের শিক্ষাব্যবস্থাতেও তীব্র প্রতিযোগিতা; এখনো শিক্ষার ব্যয় বহন করার সামর্থ নেই দেশের বড় একটা অংশের জনগোষ্ঠীর। আবার পাস করে বের হবার পরেও ভাল চাকরির নিশ্চয়তা নেই। পোড় খাওয়া মানুষের দল তাই বাধ্য হয় ভিন্ন পথ বেছে নিচ্ছে।
ভারতের অর্থনীতিতে তরুণ এবং প্রসারিত জনগোষ্ঠীর জন্য প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে। কোন লাভজনক পদে নিযুক্ত হয়েও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার অবকাশ নেই। কারণ তার চাকরি নিশ্চিত নয়, নতুন নতুন চাকরি প্রার্থীর আগমন তার চাকরি টিকিয়ে রাখার পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে!
১৯৯১ সালে ভারতে অর্থনৈতিক উদারকরণের পর থেকে লাখো মানুষ কর্মক্ষেত্রে সফলতা দেখিয়েছে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে বিক্রয় কর্মকর্তা, হোটেলের সুপারভাইজার এমনকি বিমানের পাইলট হয়ে দেখিয়েছে দেশটির তরুণেরা। এ থেকেই গত ৩০ বছরে ভারতের আর্থিক সম্প্রসারণের চিত্র ফুটে ওঠে।
করোনাভাইরাস এসে সে সম্প্রসারণের অর্থনীতিতে তীব্র ধাক্কা দিল। প্রথম লকডাউন ঘোষণার পরেই শহর ছেড়ে অজস্র কর্মী গ্রামে, নিজের গৃহে যেতে বাধ্য হলো। তাদের না আছে জমানো টাকা, না জমি-জিরাত।
এখন যদিও আবার আস্তে আস্তে বিধস্ত সে অর্থনীতি মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। দোকান, ফ্যাক্টরি এবং রেস্তোরাঁর মত অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভারতীয়রা কাজে ফিরে আসছে।
মুম্বাই ভিত্তিক গবেষণা ফার্ম, সেন্টার ফর মনিটরিং ইণ্ডিয়ান ইকোনমির মতে, এপ্রিল থেকে আগস্টের মধ্যে ভারতে ২১ মিলিয়ন কর্মী চাকরিচ্যুত হয়েছে।
অনেককেই তাদের যোগ্যতার চাইতে অনেক নিচু্মানের কাজ নিতে বাধ্য হয়েছে। প্রতিবেদন হয়েছে এসব 'হোয়াইট কলার মজুদ'দের নিয়েও।
কত যে বিচিত্রভাবে চলে এসব প্রতারক চক্রগুলোর কার্যক্রম তা জানলে নিশ্চিত চমকে উঠবেন! কোন চক্র পাঁচজনে মিলে চালায় তো কোনটি চলে পাঁচটি শহরব্যাপী; ৫০ ডলার খোয়ানো অশিক্ষিত কর্মী থেকে শুরু করে উচ্চশ্রেণির শতগুণ খোয়ানো পেশাজীবিরাও আছেন প্রতারণার তালিকায়; অখ্যাত কল সেন্টারে চাকরি দেয়া থেকে শুরু করে ভারতের সবচেয়ে বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোতে চাকরির প্রতিশ্রুতিও মিলেবে এসব জালিয়াতদের কাছ থেকে।
গত কয়েক বছর ধরে চাকরি নিয়ে জালিয়াতি এমন একটি ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে যা শুধু খবরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। প্রতারণার পদ্ধতিগুলো নিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। বিষয়টি এমন প্রকৃত কাজ খুঁজে পাওয়া যত কঠিন, জাল চাকরির জন্য প্রস্তাব পাওয়া যেন ততই সহজ।
এই মুহূর্তে ভুয়া (এক কথায় 'অস্তিত্বহীন') কাজের বিজ্ঞাপনে ভারতের ওয়েবসাইট, মেসেজিং অ্যাপস, সামাজিক মাধ্যম, এমনকি ই-কমার্স পোর্টালগুলোও ছেয়ে আছে। ম্যানেজার থেকে কেরানি সব রকমের সবার জন্য এখানে পদ আছে। তবে একটু মাথা খাটালে এসব ভুয়া চাকরি সনাক্ত করা কঠিন কিছু না; বিজ্ঞাপনের ভেতরেই সূত্র থাকে এদের।
কোথাও গণ উদ্বোধনের (মাস ওপেনিং) আহবান পাবেন, আবার কোথাও 'জরুরি ভিত্তিতে' নিয়োগ আবশ্যক উল্লেখের মাধ্যমে অঢেল বেতন সাধবে কিছু প্রতিষ্ঠান! যোগাযোগের জন্য ঘোলাটে ঠিকানা বা নাম্বার দেয়া থাকবে!
জালিয়াত চক্র সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় একটিমাত্র ফোনকলের ধরন দেখেও - যখন চাকরিপ্রার্থীকে চাকরিটি ধরে রাখার নিশ্চয়তাস্বরূপ টাকা হস্তান্তরের জন্য বলা হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে কেউ এক ডিগ্রি উপরেও থাকে- প্রার্থীকে সত্যি সত্যিই কোনো অফিসে ডেকে নেয়।
এরপর গম্ভীর মুখে ইন্টারভিউয়ের নাটক সাজিয়ে তাকে বলে একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে। তবে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার অংক জমা না হওয়া অব্দি তাদের কাজে যোগ দিতে দেয়া হয় না। বলাই বাহুল্য একবার সে টাকা জমা হবার পর বাকি সব হাওয়ায় মিলিয়ে যায়-মানুষ, ফোন নাম্বার, অফিস বেমালুম গায়েব!
২০২০ সালে ভারতে কী মাত্রায় মানুষ চাকরির জন্য প্রতারিত হয়েছে, তার সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও অনেক পুলিশ বিভাগই রেকর্ড প্রকাশ করতে শুরু করছে।
দক্ষিণ ভারতের কেরালা রাজ্যের রাজধানী তিরুবনন্তপুরমে, পুলিশ জুলাই মাসে ২৭টি মামলা রেজিস্টার্ড করেছে বলে জানায়। পুলিশ কমিশনার বলরাম কুমার উপাধ্যায় সাংবাদিকদের বলেন, প্রতারকেরা মূলত তাদেরকেই টার্গেট করে যারা মহামারীতে চাকরি হারিয়েছেন। ভুক্তভোগীদের মধ্যে এমন একজনও ছিলেন যিনি কানাডাতে ব্যবস্থাপক পদে একটি চাকরির জন্য এক হাজার ৩০০ ডলার পরিশোধ করেন।
ভারতের কেন্দ্রস্থল হায়দরাবাদে পুলিশ বাহিনীর সহকারী পুলিশ কমিশনার জি. শেখরের মতে, শুধু সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই ৬৯ টি মামলা রেকর্ড করেছেন তারা, পুরো ২০১৯ সালে যা ছিল সংখ্যায় ৫৯! একজন নারীর কথা উল্লেখ করেন শেখর-'ক্যারিয়ারসাইট' নামক ভুয়া চাকরি ওয়েবসাইট দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে এক বহুজাতিক সংস্থায় কাজের উদ্দেশ্যে পাঁচ হাজার ডলার পরিশোধ করেন তিনি।
দিল্লিতে এখন পুলিশ অফিসাররা এসব ভুয়া জব পোর্টালের কেন্দ্রগুলো খুঁজতে গিয়ে রীতিমত বিস্ময়কর সব তথ্যের মুখোমুখি হচ্ছেন। দক্ষিণ দিল্লিতে জুনের পর থেকে কয়েক ডজন মামলা হয়েছে। রাজধানীর পুলিশ বাহিনী জুলাইতে কয়েকটি ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিয়েছে । এসব ওয়েবসাইট সরকারি কর্মসূচীর নাটক সাজিয়ে সদ্য চাকরি হারানো লোকদের অনুদান প্রদানের কথা বলেও প্রতারিত করছিল।
তবে এসব পরিসংখ্যান খানিকটা অনুমিত। সম্পূর্ণ অংশ কখনোই গণমাধ্যমে উঠে আসেনা । আবার যতজন প্রতারিত হন তাদের অনেকেই থানায় অভিযোগ দায়েরে আগ্রহী হন না। ভারতের পুলিশ বাহিনীর গায়ে আগেই দুর্নীতির আঁচড় লেগেছে । ফলে অনেকেই ভাবেন মামলা দায়ের করতে গিয়ে থানায় ঘন্টার পর ঘন্টার বসে থাকতে হবে; কিংবা হারানো টাকা ফিরে পেতে পুলিশকে আরও বড় অংকের টাকা ঘুষ দিতে হবে! অন্যদিকে, পুলিশ বাহিনীর অভিযোগ প্রয়োজনীয় তথ্য এবং জনবলের অভাবে বেশিরভাগ সময় তারা কেবল চুনোপুঁটি পর্যন্তই পৌঁছাতে পারেন। জালিয়াত চক্রের গোড়ায় আর পৌঁছানো হয় না। ফলে রাঘব বোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যান।
মুদ্রার আরও দিক আছে। জুলাইতে ইউটিউবে পোস্ট করা একটি ভিডিওতে স্নাতক শিক্ষার্থী সোহেল খান জানান কীভাবে তিনি দুই মাস জালিয়াত চক্রের হয়ে কাজ করেছেন। ভারতের ওএলএক্স ওয়েবসাইট থেকে প্রতিদিন ডজন ডজন ভুয়া চাকরির বিজ্ঞাপন প্রচার করতেন তিনি, বিনিময়ে মাস শেষে আয় করতেন ১০০ ডলারের বেশি।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে বিভিন্ন কক্ষে তিনি এবং তার সহযোগীরা মিলে উচ্চপদস্থ বিভিন্ন কোম্পানীর কর্মকর্তাদের ভেক ধরে মানুষকে ফাঁদে ফেলতেন! ফ্লিপকার্ট, টাটা মোটরসের মত জানাশোনা কোম্পানিগুলোর এইচ আর ম্যানেজার সেজে তারা একের পর গ্রাহকের সাথে ফোনে যোগাযোগ করতেন।
"এসব চাকরির সাক্ষাতকারে কেউ অকৃতকার্য হতো না। প্রত্যেকে চাকরি পেত", জানান সোহেল।
"সাক্ষাতকার পর্ব শেষে চাকরি নিশ্চিতের পরবর্তী পর্বে থাকত টাকা লেনদেনের বিষয়। জাল লেটারহেড, কোম্পানির নিজস্ব স্ট্যাম্প প্রভৃতি ব্যবহারের মাধ্যমে বিষয়টিকে যতটা সম্ভব বাস্তব করে তুলে ধরা হতো।"
প্রতারণার মাত্রা উপলব্দি করার পর সোহেল এই গর্হিত কাজে ইস্তফা দেন। তিনি ভিডিওতে দর্শকদেরও অনুরোধ করেন তারা যেন তার বলা প্রতিটি কথা গুরুত্বের সাথে আমলে নেয়।
কিন্তু জালিয়াত চক্র প্রতিনিয়ত কৌশল পরিবর্তন করছেন। সন্দেহ এড়াতে প্রতারকেরা একেবারে বৈধ নিয়োগ পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমেও জালিয়াতি করছে। নকরি ডট কমের মত সুপরিচিত ওয়েবসাইটগুলি থেকে চাকরি প্রত্যাশীদের সিভি সংকলন করা হয় প্রথমে। এরপর কোনরকমে মাথা গোঁজার মত অবস্থা আছে এমন একটি ভবনে কল সেন্টার স্থাপন করা হয়, অতঃপর সদ্য স্নাতক সম্পন্ন করা কিছু শিক্ষার্থীকে আনিয়ে জাল চাকরির প্রস্তাবে ফোন করার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
ফোনের ওপাশে থাকা মানুষটি যদি আগ্রহী হন, তাহলে কলসেন্টারের কর্মীরা তাদের আলাদা আরেকটি ওয়েবসাইটের দিকে পরিচালিত করেন; সেখানে একটি নতুন প্রোফাইল নিবন্ধন করানোর মাধ্যমে চাকরি সুরক্ষিত করার কথা বলে নিজেদের একাউন্টে অর্থ প্রাপ্তির পথ সুগম করা হয়।
এসব কলসেন্টারে কাজ করে আসা একজন নারী জানান, তাকে এক সপ্তাহের একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচীর ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে প্রথমে। সেখানে তাকে স্ক্রিপ্ট মুখস্ত করতে বলা হয় এবং সাজানো (ডামি) ফোনকলের মাধ্যমে সে স্ক্রিপ্টে লেখা সংলাপগুলো অনুশীলন করেন।
প্রথম লাই্নটির মাধ্যমেই চাকরিপ্রার্থীর মনোযোগ ধরে রাখার প্রয়াস ছিল- "আপনি কি চাকরি খুঁজছেন?"
কিছু কিছু প্রতারণামূলক চাকরির প্রস্তাবগুলো সত্যিকারের নিয়োগ- এজেন্সির ছদ্মবেশের আড়ালেই ডাকা হয়। পশ্চিম দিল্লির অন্তর্ভুক্ত মোতি নগরের আশেপাশে একটি প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন ৫০ জনের মত স্নাতককে ডাকা হতো। প্রত্যেককে একটি 'প্লেসমেন্ট ফী' প্রদান করতে হতো। কিছু প্রার্থীকে পরদিনই নতুন চাকরিতে পাঠানো হয় আবার কেউ কেউ দ্বিতীয়বার কখনো ওই এজেন্সি থেকে ডাক পান না।
মোতি নগরের বাইরে সে এজেন্সির একজন কর্মী, সুমিত জানান, ভারতীয়রা এই মুহুর্তে একটা কোনো চাকরির জন্য প্রচন্ড হতাশ জীবনযাপন করছে।
"তাদের যে কোন একটা চাকরি হলেই চলবে।"
সুমিতকে আরও জিজ্ঞাসা করা হয়, তার এজেন্সিটি যে জাল চাকরি দেওয়ার কথা বলে মানুষকে প্রতারিত তা কি তিনি জানেন? তিনি স্বীকার করে নিয়ে বলেন, "আমাদের কাছে প্রতিদিন অজস্র কোম্পানি আসে চাকরিপ্রার্থীর খোঁজে...প্রত্যেকের ক্রিডেনশিয়াল আমাদের পক্ষে যাচাই করা সম্ভব নয়।"
তিনি আরও জানান, চাকরিপ্রার্থীরা অভিযোগ করলে তার কোম্পানি তাদের নতুন কাজ খুঁজে দেয়ার ব্যবস্থা করে নতুবা সেই প্লেসমেন্ট ফি ফিরিয়ে দেয়।
নভেম্বর মাসে, দিল্লি প্লেসমেন্ট এজেন্সির বিতরণকৃত অর্থ প্রদানের রশিদে তালিকাভুক্ত একটি নম্বরে ফোন করলে লাইনের অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তিকে চাকরিক্ষেত্রে জালিয়াতি প্রকল্পগুলোর সাথে সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়। নিজেকে মাধব সিং পরিচয় দেয়া সে ব্যক্তি জানায়, তিনি ইতিমধ্যে কোম্পানিটি ছেড়ে চলে এসেছেন।
"আপনি যা বলছেন তার খবর আমার কাছেও এসেছে।"
তিনি আরও জানান যে, তিনি সেখানে মাত্র কয়েকমাস কাজ করেছিলেন। তিনি নিজে একাধিকবার চাকরিক্ষেত্রে প্রতারণার শিকার হয়েছিলেন এবং মহামারীর সময়টাতে হাজার হাজার টাকা লোকসান হয় তার।
"আমার সত্যিই টাকার দরকার ছিল।"
এই লোকটির সাথে কথা বলার সময় আরেকবার ভারতীয় অর্থনীতির দুর্বল দিকগুলো সামনে আসে। তার কন্ঠে প্রবল হতাশা ফুটে উঠছিল- এক পর্যায়ে তিনি পালটা প্রতিবেদককে ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, 'আমার যদি এতই এ বিষয় নিয়ে গরজ থাকে তাহলে নিবন্ধ লেখার পরিবর্তে আমি কেন সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে নিজেই একটি এনজিও খুলে বসছি না!'
আলাপ শেষে তিনি জানতে চান, তাকে কোন চাকরির খোঁজ দিতে পারব কিনা!
হায়!
(ঈষৎ সংক্ষেপিত)
লেখকঃ দিল্লির সাংবাদিক। পেঙ্গুইন র্যান্ডম হাউস ইন্ডিয়া হতে এ বছর 'দ্য স্ক্যামারস' নামে তার বই প্রকাশিত হবে। তার এ লেখাটি 'দ্য আটলান্টিক'এ প্রকাশিত হয়।