চীনকে মোকাবিলায় পশ্চিমাদের সঙ্গেই হাঁটবে ভারত?
বছরের পর বছর ধরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা চীনকে মোকাবিলার ক্ষেত্রে ভারতকে ঘনিষ্ট সামরিক ও অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে পাশে পাওয়ার জন্য চেষ্টা করেছে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতকে দিয়ে বৃহত্তম স্বৈরতন্ত্র চীনকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছে তারা।
তবে চলতি সপ্তাহের এক ঘটনায় চীনকে মোকাবিলার এই ধারণাটি আরও বাস্তব হয়ে ওঠে পশ্চিমাদের চোখে। চীন-ভারত সীমান্তে দু'পক্ষের মধ্যে গত সোমবার যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে তাতে ২০ ভারতীয় সৈন্যের মৃত্যু হয়েছে। চীনের কতোজন সৈন্য হতাহত হয়েছে সেটি না জানা গেলেও এশিয়ার বিশাল এই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে নতুন করে যে বৈরিতার সূচনা হয়েছে তার সুযোগ নেবে বিশ্বরাজনীতির মোড়লদের অনেকেই।
এশীয় অঞ্চলে ও বিশ্বে নিজেদের পেশীশক্তি আরও বৃদ্ধির বিষয়ে সম্প্রতি প্রকাশ্যেই কথা বলেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, যে চীনের সঙ্গে তৈরি হওয়া নতুন উত্তেজনা ভারতের জন্য একটি কঠিন পরীক্ষাই হবে, যদি দেশটির চীনের সাথে সরাসরি টক্করে তারা জড়িয়ে পড়ে।
করোনাভাইরাস মহামারী নিয়ে পশ্চিমাদের দ্বারা চীন বারবার সমালোচিত হওয়ার মধ্যেই সম্প্রতি ভারতীয় কূটনীতিকরা পশ্চিমা কূটনীতিকদের নানাভাবে বার্তা দিয়েছেন, এশীয় অঞ্চলের অন্যতম এই পারমানবিক শক্তিধর দেশের সঙ্গে পশ্চিমের বিশ্ব আরও ঘনিষ্ট হতে পারে। অনেক বিশ্লেষকই মনে করছেন, চীনের সঙ্গে সীমান্তে এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ভারতকে সেই দিকে আরও ঠেলে দেবে।
চলতি মাসে ভারত প্রশান্ত মহাসাগরের দেশ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি করে যার ফলে এখন থেকে এই দুই দেশ একে অন্যের সামরিক ঘাঁটিগুলো ব্যবহার করতে পারবে। এটা অনুমিতই যে, এর মধ্যদিয়ে জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিজেদের চালানো নৌ মহড়াগুলোতে অস্ট্রেলিয়াকেও আমন্ত্রণ জানাবে ভারত। স্বাভবিকভাবেই এই চার শক্তিধর চাইবে এ অঞ্চলের সমুদ্র এলাকায় একযোগে মহড়া চালিয়ে চীনকে নতুন বার্তা দিতে।
বহুজাতিক সংস্থাগুলোতেও ভারতের নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করার ক্যাম্পেইন বেশ দ্রুত তালেই এগোচ্ছে। গত বুধবার কোনো ধরণের বিরোধীতা ছাড়াই জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের অস্থায়ী সদস্য হয়েছে ভারত। গত মে মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয় তারা। সেখানে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পেছনে চীনকে দায়ী করে তদন্তের বিষয়ে ভারতও সমর্থন দেয়। অথচ চীন বহুভাবে চেষ্টা করছে এই তদন্তের পথ আটকে দেওয়ার।
কিন্তু যখন দুই দেশের দ্বৈরথে প্রশ্ন আসে সামরিক আর অর্থনৈতিক সক্ষমতার, তখন দেখা যায় চীনের চেয়ে যোজন যোজন পিছিয়ে আছে ভারত। সেকারণেই মনে করা হয়, চলতি সপ্তাহের সীমান্তের ওই সংঘর্ষ নিয়ে ফের চীনের সঙ্গে সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি নেবেন না ভারতীয় নেতারা।
এ বিষয়ে নয়াদিল্লি ভিত্তিক অবসার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সভাপতি সামির সারান বলেন, "ভারতকে তাদের সামরিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক তিনটি বিকল্পই ব্যবহার করতে হবে। চীন একটি বিশাল আর ক্ষমতাধর দেশ। তাদের বিষয়ে দীর্ঘস্থায়ী পদক্ষেপ নিতে হলে এই তিনটি বিষয়কেই কাজে লাগাতে হবে।"
তিনি বলেন, "উদারতাবাদ, গণতন্ত্রের প্রতিরক্ষা এবং একটি আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত ব্যবস্থা চীন ভারতের মধ্যকার এই দ্বৈরথে কার্যকরী হবে।"
চীন এবং ভারতের সেনা কর্মকর্তারা সামরিক উত্তেজনা কমিয়ে আনতে সীমান্তে বৈঠকে বসেছেন। ভারতীয় কর্মকর্তারা বলেছে, বৃহস্পতিবার রাতে চীন তাদের ১০ সেনা সদস্যকে ফিরিয়ে দিয়েছে যাদেরকে সংঘর্ষের রাতে ধরে নিয়ে যায় চীনারা। যদিও চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, চীন ধরে নিয়ে গেছে, এমন কোনো বন্দির বিষয়ে তিনি জানেন না।
তবে দুই পক্ষই সীমান্তে তাদের সৈন্য-সামন্ত বৃদ্ধি করেছে বলে স্থানীয় গ্রামবাসী এবং স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবির মাধ্যমে জানা গেছে। ভারতের এই মুহুর্তে কী করা উচিত সে বিষয়ে আলোচনা করতে শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দেশের বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেছেন।
সৈন্য সংখ্যার দিক থেকে ভারতের সামরিক বাহিনী বিশ্বের অন্যতম বড় একটি প্রতিরক্ষা বাহিনী হলেও আধুনিকতা এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে তারা বেশ পিছিয়ে। এ বছর তাদের প্রতিপক্ষ চীন যেখানে সামরিক বাহিনীর জন্য ১৭৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজেট বরাদ্ধ করেছে সেখানে ভারত করেছে অর্ধেকেরও কম ৭৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আবার ভারতের এই বরাদ্ধের অনেক অংশই চলে যায় সাবেক সেনাসদস্যদের পেনশনের পেছনে।
অর্থনৈতিকভাবে চীনকে চেপে ধরতে নিজেদের দেশের বিশাল বাজারকে কাজে লাগিয়েছে ভারত। গত এপ্রিলেই তারা একটি আইন প্রণয়ন করে, যার ফলে চীনা কোনো কোম্পানির ক্ষেত্রে ভারতে যেকোনো বিনিয়োগের বিষয়ে সরকারের অনুমতি লাগবে বলে জানানো হয়। চীনা কোম্পানিগুলো যখন বিভিন্ন দেশের বাজারে ছড়িয়ে পড়তে যাচ্ছিলো তখন ভারতের এই আইন তাদের জন্য নতুন বিপত্তি বাঁধিয়েছে। এরমধ্যে বৃহস্পতিবার রয়টার্স তাদের একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে ভারত।
কূটনীতিকরাও আশা করছেন, চীনের অন্যতম বড় টেলিযোগাযোগ কোম্পানি হুয়াওয়েকে তাদের দেশে ফাইভ-জি ওয়্যারলেসের বাজার তৈরি করতে দেবে না ভারত। হুয়াওয়েই এর বিরুদ্ধে সাইবার গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ এনে যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্র দেশগুলোকে এই কোম্পানিকে তাদের দেশে নিষিদ্ধের অনুরোধ করেছে।
যদিও নিজেদের দেশে ব্যবসার ক্ষেত্রের চীনের বাজার সংকুচিত করার মাধ্যমে চীনকে একটি ধাক্কা দিতে পেরেছে ভারত কিন্তু চীনের মতো অন্যদেশকে ঋণ দিয়ে বা ওই সব দেশের উন্নয়ন সহযোগী হয়ে বৈশ্বিক পরিসরে নিজেদের প্রভাব বাড়ানোর সক্ষমতা ভারতের নেই।
করোনার এই বিপর্যয়ের মধ্যে অন্যান্য দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে নিজ দেশের ঔষধ শিল্পকে কাজে লাগিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। আক্রান্ত দেশগুলোতে ঔষধ দিয়ে সহায়তা করেছে তারা।
পশ্চিমা একজন কূটনৈতিক বলেছেন, এর মাধ্যমে অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরও জোরদার হয়েছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে তিনি বলেন, "করোনা পরবর্তী বিশ্ব চীনের বিষয়ে কী করবে তা নিয়ে প্রত্যেকেই চেষ্টা করছে নিজেদের মধ্যে কথা বলার। চীন যেভাবে বিশ্বব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেছে তাই এখন নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার বিষয়ে কথা বলা আরও সহজ হবে। ভারত এখানে একটা পথ দেখাবে এবং চীন অন্যটা দেখাবে।"
চীন-ভারত সীমান্ত নিয়ে যখন সংঘাত দানা বাঁধছিল সেসময়ে ভারতের অন্যতম প্রতিবেশি দেশ নেপাল সীমান্তের একটি এলাকাতে নিজেদের মানচিত্রে যোগ করে সংসদে পাশ করিয়ে নেয়। ভারত দাবি করেছে, চীন এই ঘটনায় নেপালকে সমর্থন দিয়ে পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছে। অন্যদিকে ভারতের প্রতিবেশী শত্রুরাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গেও চীনের সম্পর্ক তুঙ্গে। আবার ভারতের দক্ষিণের প্রতিবেশী শ্রীলঙ্গকার একটি বন্দরের নিয়ন্ত্রণ করছে চীন। ভারত অভিযোগ করেছে চীন সেখানে সামরিক ঘাটি তৈরির চেষ্টা করছে যদিও চীন তা অস্বীকার করে আসছে। অন্যদিকে ভারতের অন্যতম বন্ধুরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক সম্পর্কও বেশ ভালো। ভারতের সঙ্গে সীমান্ত ভাগাভাগি করা আরেক দেশ মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের সম্পর্কও বেশ পুরনো।
সব মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় চীন-ভারত ইস্যুতে ভারতকে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে যাবে এরকম কোনো দেশ এই মুহুর্তে নেই বলাটাই সমীচীন। সেকারণে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে নতুন করে শক্তিশালী সম্পর্ক তৈরির দিকটিকে গুরুত্ব দিচ্ছে ভারত।
গত মঙ্গলবার একটি মতামত আর্টিকেলে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব বিজয় কেশব গোখালে লেখেন, চীনের এই সীমা লঙ্ঘনগুলোকে কোনো দেশেরই আর এড়িয়ে যাওয়া উচিত না। তাদেরকে অবশ্যই চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে কাউকে বেছে নিতে হবে।
তিনি লেখেন, "করোনা পরবর্তী বিশ্বে একইসঙ্গে এই দুই দেশের কাছ থেকেই সুবিধা পাওয়ার আর কোনো সুযোগ নাও থাকতে পারে।"
নিউইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদন থেকে অনূদিত।