তালেবানে বিভাজন কতটা গভীর?
সাম্প্রতিক সময়ে তালেবানের শীর্ষ নেতাদের বিরোধ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সংবাদের বিষয়বস্তু হয়েছে। গেল মাসে আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া গোষ্ঠীটির ঐক্যও এবার প্রশ্নের মুখে।
চলতি মাসের শুরুতেই, হঠাৎ করে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান, তালেবান অন্তর্বর্তী সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী মোল্লা আব্দুল গনি বারাদার। তার এ রহস্যময় অন্তর্ধানে জনমনে সন্দেহের ছায়া পড়ে। তারপরই কিছু গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, বারাদার নিহত হয়েছেন।
তবে আগে থেকে রেকর্ড করা একটি বিবৃতিমূলক ভিডিও নিয়ে কিছুদিন পর বারাদার পুনরায় আবির্ভূত হন। সেখানে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছিল, লিখিত একটি ভাষ্য অনুসারেই তিনি বিবৃতি দিচ্ছেন। এসময় বারাদার বলেন, কান্দাহারে জরুরি কাজে ভ্রমণে থাকায় কিছুদিন জনসম্মুখে আসতে পারিনি এবং তালেবান নেতাদের ভেতর পরিবারের চাইতেও বেশি সৌহার্দ্য রয়েছে।
এরপর তাঁর মৃত্যু বা আহত হওয়ার সন্দেহ দূর করার সর্বশেষ চেষ্টা হিসেবে গত সোমবার জাতিসংঘের সফররত কর্মকর্তাদের সাথে বারাদারের সাক্ষাতের ছবিও প্রকাশ করেছে তালেবান।
এভাবে আশ্বস্ত করার প্রয়াস চালানো হলেও, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সূত্রগুলো আল-জাজিরাকে জানায় যে, তালেবান নেতৃত্বের মধ্যে বিরোধের ঘটনা একেবারেই সত্যি। এ বিভাজন বেড়ে গেলে, তা ভবিষ্যতে আফগান জনগণের দুর্ভোগের কারণ হবে বলেও জানান তারা।
২০ বছর ধরে তালেবান বিষয়ক সংবাদ প্রতিবেদন ও গ্রন্থ রচনাকারী স্থানীয় একজন লেখক ও সাংবাদিক বলেছেন, রাজনৈতিক ও সামরিক শাখার মতভেদ থেকেই বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে।
তার মতে, 'উভয় পক্ষই মনে করছে ২০ বছর ধরে সংগ্রাম করার পর তাদের প্রাপ্তিই বেশি হওয়া উচিত।'
যুদ্ধজয়ের সম্পদ ভাগাভাগি:
এব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন, দীর্ঘদিন ধরে তালেবানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখা এক রাজনৈতিক সূত্র। তিনি বলেন, শীর্ষ নেতাদের এই বিরোধ তৃনমূল পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত, উভয় দলের সমর্থকরাই সাবেক সরকারের কর্মকর্তা ও তাদের আত্মীয়দের বাড়িতে হানা দিয়ে করে মূল্যবান জিনিসপত্র কেড়ে নিচ্ছে।
"এখন প্রতিযোগিতা করে মানুষের গাড়ি ও বাড়ি কেড়ে নেওয়াই তাদের একমাত্র লক্ষ্য।"
সাবেক সরকারি কর্মকর্তাদের কয়েকজন আত্মীয় আল জাজিরাকে জানান, তালেবান যোদ্ধারা তাদের ব্যক্তিগত গাড়ি, মূল্যবান সম্পদ এবং এমনকি ভাড়া বাড়িও জব্দ করার চেষ্টা করেছে।
যুদ্ধজয়ের ফসল হিসেবে সাবেক সরকারের কর্মকর্তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা ঘিরে রাজনৈতিক ও সামরিক শাখার বিভাজন, মাঠ পর্যায় থেকে শীর্ষ পর্যায়েও ছড়িয়ে পড়ে।
অথচ, আফগানিস্তান দখলের দুই দিন পরই প্রথম আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করেন তালেবানের প্রধান মুখপাত্র। বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী জাবিহউল্লাহ মুজাহিদ সে সময় প্রতিশ্রুতি দেন যে, "সামরিক হোক বা বেসামরিক কর্মকর্তা, কারো বাড়িতে তালেবান সদস্যদের বিনা-অনুমতিতে প্রবেশ না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।"
১৭ আগস্টের ওই সংবাদ সম্মেলনে মুজাহিদ আরও দাবি করেন, "পূর্ববর্তী সরকারের সঙ্গে আমাদের ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে।"
তবে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অবিহিতরা জানাচ্ছেন, পূর্ববর্তী আশরাফ ঘানি সরকারের মতোই তালেবান শীর্ষ নেতৃত্বও গোত্র ও গোষ্ঠী-ভিত্তিক দলাদলি মোকাবিলাসহ অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
আল জাজিরাকে কয়েকটি সূত্র বলেছে, আফগানিস্তানের আগের সকল সরকারের মতো তালেবানের ভেতরেও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি-কেন্দ্রীক বিভাজন আছে। তবে আগের প্রশাসনগুলোর মতো অতি-উচ্চাকাঙ্খী ও বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের সদস্য তালেবান সরকারে নেই। বরং বিভাজনটা অনেকাংশেই মৌলিক।
সূত্রগুলি আরও জানায়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দুর্নাম কুড়ানোর ভয়ে এখনও যুদ্ধজয়ের মালামাল ভাগ-বণ্টনের অপেক্ষা করছে তালেবান যোদ্ধারা। এব্যাপারে শীর্ষ নেতাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রাজনৈতিক ও সামরিক শাখার মধ্যে বিভক্তির এটাও প্রধান কারণ।
কূটনৈতিক দিক:
কিছু প্রভাবশালী রাষ্ট্র এর মধ্যেই জানিয়েছে, তারা তালেবান নেতৃত্বাধীন আফগান সরকারকে স্বীকৃতি দেবে না। গত বুধবার জাতিসংঘের পাঁচ স্থায়ী সদস্য দেশও যৌথভাবে তালেবানের প্রতি আরও সার্বজনীন সরকার গঠনের আহবান জানিয়েছে।
আন্তর্জাতিক দাতা গোষ্ঠীগুলোর সহায়তা স্থগিতের পর, আফগানিস্তান চরম অর্থ সংকটে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভের ৯০০ কোটি ডলারের বেশি তহবিল ফ্রিজ করেছে।
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই অভিজ্ঞ সাংবাদিক বলেন, তালেবানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের ছেলে মোল্লা মোহাম্মদ ইয়াকুবের মতো নেতারা তালেবানের কট্টর ও সামরিক দিক-নির্ভর গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছেন।
অন্যদিকে, মোল্লা বারাদার ও শের মোহাম্মদ স্তানিকজাই এর মতো নেতারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নির্ভর গোষ্ঠীর প্রতিনিধি। তারা আরও সার্বজনীন সরকার গঠনেরও পক্ষে, যা নিয়ে কট্টর নেতাদের সাথে তাদের মতভেদ দেখা দিচ্ছে।
দ্বিপাক্ষিক বিরোধের আরেকটি উৎস- আঞ্চলিক প্রতিবেশী পাকিস্তান ও ইরান। পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে ২০ বছরের যুদ্ধ চলাকালে এ দুই দেশের বিরুদ্ধে তালেবানকে সহায়তার অভিযোগ রয়েছে।
এর আগে পাকিস্তানের হাতে আটক হওয়া অনেক শীর্ষ নেতা ইসলামাবাদের অভিসন্ধি নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন। এদের অনেকেই তাঁর পরিবর্তে ইরানি প্রভাবকে সমর্থন করছেন।
তালেবানের অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা ঘোষণার দিনকয়েক আগেই কাবুল সফর করেন পাকিস্তানী গুপ্তচর সংস্থা- আইএসআই এর প্রধান জেনারেল ফাইজ হামিদ। তিনি শিয়া মুসলমানসহ সকল জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ সরকার গঠনেরও আহবান জানান। কিন্তু, পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ ভূমিকা নিয়ে দৃঢ় সংশয়বাদীরা এমন প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
- সূত্র: আল জাজিরা