নিজেই সম্মেলনের আয়োজন করলেন, অনুপস্থিত থাকবেন নিজেই
আমাজানের বৃষ্টিবনের আগুনের উত্তাপ গোটা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়েছে। ব্রাজিলের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর রিসার্চের হিসাবে, জানুয়ারি থেকে আগস্টে ব্রাজিলে প্রায় ৮৯ হাজার আগুন লেগেছে। তার ৫১.৯ শতাংশ লেগেছে আমাজনে। ব্রাজিলের কৃষকদের বনে আগুন দেওয়ার সরাসরি ফল এটি, এটা মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সে কারণেই সমালোচনার যত তীর ব্রাজিলের চরম ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট জায়ের বোলসোনারোর দিকেই। পশ্চিমা দেশগুলো বিশেষ করে ফ্রান্স ও জার্মানি এখানে নাক গলিয়েছে বলে খেপেছিলেন তিনি। সে প্রেক্ষিতেই গত ৩০ আগস্ট ঘোষণা দিলেন যে, আমাজনের বনের অংশ যেসব দেশে আছে তাদের নিয়ে তিনি এই বৃষ্টিবনের সুরক্ষা ও উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করবেন।
চিলির প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিয়ান পিনেরা তার বিশেষ বন্ধু। দুজনে মিলে আলোচনা করেছেন ব্রাসিলিয়ায় বসে। তারপরই এল এই ঘোষণা। ৬ সেপ্টেম্বর শুক্রবারে কলম্বিয়ার লেটিসিয়ায় দক্ষিণ আমেরিকান দেশগুলোর মধ্যে ‘আমাজন ফায়ারস সামিট’ হবার কথা। অংশগ্রহণকারীদের তালিকা থেকে একমাত্র বাদ যাচ্ছে ভেনেজুয়েলা।
বোলসোনারোর ভাষ্যে, সামিটের লক্ষ্য হবে, পরিবেশের সুরক্ষার জন্য আমাদের নিজেদের যৌথ কৌশল নির্ধারণ’। তার মতে, পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টির সঙ্গে প্রতিটি ‘জাতি—রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব’ ইস্যুটি জড়িত।
চিলিয়ান প্রেসিডেন্ট পিনেরাও বন্ধুর সঙ্গে এ বিষয়ে ঐকমত্যের কথা জানালেন। দুজনের যৌথ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “প্রত্যেক রাষ্ট্র তার জনগণের (আদিবাসীসহ) প্রয়োজন ও পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধতার চিন্তা মাথায় রেখে নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ও যথাযথ ব্যবহার করবে।”
বোলসোনারোর অসুস্থতা ও সামিটে সম্ভাব্য অনুপস্থিতি
২ সেপ্টেম্বর সোমবার প্রেসিডেন্ট বোলসোনারোর কার্যালয় জানাল, তিনি সামিটে থাকতে পারবেন না। কারণ ঠিক একই সময়ে তাঁর একটি সার্জারি হতে যাচ্ছে। সরকারের মুখপাত্র জানিয়েছেন ব্রাজিল হয়তো কোনো প্রতিনিধি পাঠাবে সেখানে অথবা সামিট স্থগিত রাখতে বলবে।
২০১৮ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশনে নির্বাচিত হন তিনি। তার এক মাস আগে প্রচারাভিযান চালানোর সময় তাঁর পেটে ছুরিকাঘাত করা হয়েছিল। এরপর তিন বার সার্জারি করাতে হয়েছে তাকে।
এবারের সার্জারির কারণ তার হার্নিয়ার চিকিৎসা করানো। সেটা হবে মুলত ৮ সেপ্টেম্বর রোববারে। কিন্তু শুক্রবারে, যেদিন সামিট হবে, সেদিন থেকে তাকে তরল খাবার শুরু করতে হবে। তাছাড়া কমপক্ষে দশ দিন বিশ্রামে থাকতে হবে তাকে।
পশ্চিমা নেতাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব
ফ্রান্সের সমুদ্রতীরের এক শহরে ২৬ থেকে ২৮ আগস্ট বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতিগুলোর সামিট জি-সেভেনের জন্য দেশগুলোর শীর্ষনেতারা একত্রিত হয়েছিলেন। জি-সেভেনের শুরুতে টেলিভিশন ভাষণে মাঁখো বলেছিলেন, আমাজনের আগুন গোটা বিশ্বের ইস্যু। বোলসোনারোকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, “আপনাকে এই আমাজন ধ্বংস করতে দিতে পারি না আমরা।”
সম্মেলনে মাঁখো জি-সেভেনভুক্ত দেশগুলোর পক্ষ থেকে আমাজনের আগুন নেভাতে ব্রাজিলকে ২০ মিলিয়ন ডলার দেবার প্রস্তাবও দেন।
বোলসোনারো প্রথমে সাহায্য নেবার আহ্বানটাই প্রত্যাখ্যান করলেন। তার মনে হয়েছিল, ওরা এই ২০ মিলিয়ন ডলার (১৮ মিলিয়ন ইউরো) দিয়ে তাদের সার্বভৌমত্ব কিনে নিতে চাইছেন। তাদের ফরাসী উপনিবেশ মনে করছেন।
পরে বললেন, ওই ২০ মিলিয়ন ডলার তিনি নেবেন এক শর্তে, মাঁখো তাকে নিয়ে যা বলেছেন সেটা প্রত্যাহার করলে। পরে তার সুর আরও চড়ে গেল। তিনি বললেন, “মাঁখো এমন ভাব করেন যে, তিনিই ‘একমাত্র লোক’ যে পরিবেশ নিয়ে ভাবেন।”
এ নিয়ে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট স্বয়ং এবং দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা মাঁখোকে বারবার আক্রমণ করেছেন। এমনকি ব্রিজিত মাঁখোকে নিয়ে তীর্যক মন্তব্য করা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। যার প্রতিক্রিয়ায় মাঁখো বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, এটা তার স্ত্রীর প্রতি ‘চরম অসৌজন্যমূলক’ এক আচরণ। ব্রাজিলের নারীদের লজ্জিত হওয়ার কথা যে তাদের দেশের প্রেসিডেন্ট এমন, সে কথাও বলেন মাঁখো।এর আগে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মেরকেলের সঙ্গে কথার লড়াইতে মেতেছিলেন বোলসোনারো।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরনেস্টো আরাওজো প্রেসিডেন্টকে সমর্থন দিয়ে বললেন, “ব্রাজিলকে আমাজনের ইতিহাসের ভয়াবহতম আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে। যারা সত্যিকারভাবে পরিবেশ নিয়ে ভাবেন তারা অবশ্যই এটা মেনে নেবেন যে, বোলসোনারো একজন ‘হিরো’, ‘ভিলেন’ নন।”
জনপ্রিয়তা কমেছে বোলসোনারোর
২ সেপ্টেম্বরের এক জরিপে জানা গেছে, আমাজান প্রসঙ্গে সরকারের কার্যক্রমের বিষয়ে অসন্তুষ্ট জনগণের ৩৮ শতাংশ। ১ জানুয়ারি তিনি ক্ষমতায় আসার পর থেকে এটা হচ্ছে সর্বনিম্ন। মাত্র ২৯ শতাংশ তাকে অনুমোদন দিচ্ছেন।
ওদিকে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ব্রাজিল কর্তৃপক্ষকে বলছে আমাজনের আগুনের পেছনে যারা দায়ী তাদের বিষয়ে তদন্ত করে তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে। নাহলে বোলসোনারোর শাসনামলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে বলে মনে করছে ওরা।
জাতিসংঘে যাবেন তিনি ‘হুইলচেয়ারে চড়ে হলেও’
ব্রাসিলিয়ায় নিজের অফিসের সামনে সাংবাদিকদের এ কথাও বললেন যে, যত অসুস্থই হোন, এ মাসের শেষে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তিনি যাবেনই। ‘যদি হুইলচেয়ারে চড়তে হয় বা স্ট্রেচারে, তবুও”, বোলেসোনারোর ভাষ্য।
সেপ্টেম্বরের ২৪ তারিখে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন বসবে। সেখানে আমাজান নিয়ে তিনি কথা বলতে চান তিনি, বিশ্ববাসীকে জানাতে চান বৃষ্টিবনের সুরক্ষার বিষয়ে তার সরকারের অঙ্গীকোরের কথা।