ভারতীয় টিকা উৎপাদকেরা কি নিজ দেশ ও বিশ্বের চাহিদা পূরণ করতে পারবে?
উদ্ভাবক বিদেশি সংস্থার লাইসেন্স নিয়ে বিশ্বের ৬০ শতাংশ টিকা উৎপাদনে এগিয়ে আছে ভারত। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ জনসংখ্যার দেশটি করোনাভাইরাস সংক্রমিতের সংখ্যাতেও দ্বিতীয়। তবে শুধু নিজের নয়, বিশ্বের চাহিদা পূরণেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম প্রতিবেশীটি। এ অঙ্গীকার পূরণের উপর নির্ভর করবে দেশটির ভাবমুর্তি।
ভারতীয় উৎপাদকেরা কী এসব চাহিদা পূরণে সক্ষম হবে- সঙ্গতকারণে তাই এমন প্রশ্ন উঠছে।
ভারতের টিকা উৎপাদন সক্ষমতা?
এই মুহূর্তে ভারতে অনুমোদন পেয়েছে দুটি সংস্থার টিকা। এর একটি হচ্ছে অক্সফোর্ড/অ্যাস্ট্রাজেনেকার আবিষ্কৃত। উৎপাদক সংস্থা সেরাম ইনস্টিটিউড এটি কোভিশিল্ড নামে বাজারজাত করছে। অন্যটি হচ্ছে, স্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারক ভারত বায়োটেকের কোভাক্সিন। তবে অনুমোদন পেলেও তা দেওয়া হয়েছে তৃতীয় ট্রায়ালের লক্ষ্যে। কারণ, এটি সবগুলো ধাপের পরীক্ষা শেষ করতে পারেনি।
ভারতে আরও বেশকিছু টিকার ট্রায়াল চলছে, আর রয়েছে সেগুলো স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদনের লক্ষ্য।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত নানা সংবাদ সূত্রে জানা যায়, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে টিকা উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে ভারতীয় ওষুধ প্রস্তুতকারকেরা যুক্ত করেছে নতুন নতুন অবকাঠামো। অনেকক্ষেত্রে, জরুরি নয় এমন ওষুধের কারখানাকে টিকা উৎপাদনের লক্ষ্যে রূপান্তর করাও হচ্ছে।
দেশটির সবচেয়ে বড় উৎপাদক সেরাম ইনস্টিটিউড অব ইন্ডিয়া ব্জানিয়েছে, তারা এখন প্রতিমাসে ৬ থেকে ৭ কোটি ডোজ উৎপাদন করতে পারবে।
অনুমোদন পাওয়া আরেক সংস্থা ভারত বায়োটেকের দাবি, তারা বার্ষিক ২০ কোটি ডোজ উৎপাদনের লক্ষ্যস্থির করেছে। যদিও, বর্তমানে সংস্থাটির কাছে কেবল ২ কোটি ডোজ কোভাক্সিন আছে, এবং তৃতীয় ট্রায়াল শেষ হওয়ার আগে নিয়ম অনুযায়ী বিদ্যমান চালানেরও ব্যাপক প্রয়োগ সম্ভব নয়।
অন্য যেসব কোম্পানির প্রার্থী টিকার ট্রায়াল চলমান রয়েছে, সেসব সংস্থা ভারতীয় ওষুধ প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। উৎপাদনের জন্য তৈরি হলে সেগুলো অন্যদেশে রপ্তানির চেষ্টাও করছে সংস্থাগুলো।
তবে এসব সংস্থার উৎপাদন সক্ষমতা কতটুকু তার বিস্তারিত বিবরণ তেমন একটা পাওয়া যায় না।
ভারতের নিজস্ব ভ্যাকসিন চাহিদা কতটুকু?
ভারতে জীবাণুর বিস্তার নিয়ন্ত্রণে দেশটির সরকার চলতি বছর জুলাই নাগাদ অগ্রাধিকার তালিকায় থাকা ৩০ কোটি লোককে টিকা দিতে চায়।
ভারত সরকার বলেছে যে, তারা জুলাইয়ের শেষদিকে অগ্রাধিকার তালিকায় থাকা ৩০ কোটি নাগরিককে টিকা দেবে। আগামী ১৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হচ্ছে জরুরি ভিত্তিতে এই টিকাদান কর্মসূচি; বৈশ্বিক প্রবণতার অনুকরণে প্রাধান্য পাচ্ছেন স্বাস্থ্য কর্মীসহ সম্মুখভাগে থাকা অন্যান্য জরুরি সেবাদাতারা।
সাত মাসের মধ্যে অন্তত ৬০ কোটি নাগরিককে টিকা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েছে ভারত। সেই অনুসারে প্রতিমাসে টিকা পাবেন সাড়ে ৮ কোটি নাগরিক।
এঅবস্থায় ভারতের বৃহত্তম প্রস্তুতকারক সেরাম বলছে, তারা ৫ কোটি ডোজের মান পরীক্ষা সম্পন্ন করে সরবরাহের জন্য প্রস্তুত রেখেছে। অর্থাৎ, টিকাদানের মাসিক লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সংস্থাটির এযাবৎ উৎপাদিত সংখ্যায় একটি বড় অসামঞ্জস্য রয়েছে। আর সেরাম ভারতের অন্যান্য টিকা উদ্যোগের চাইতে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও সফল প্রতিষেধক সরবরাহ করার ক্ষমতা রাখে।
পুনেভিত্তিক কোম্পানিটি বিবিসি'কে জানায়, উৎপাদিত ডোজের কী পরিমাণ স্থানীয় ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত হবে এবং কতটুকু রপ্তানির জন্য ছাড় দেওয়া হবে, সেটি এখনও নির্ণয়ের কাজ চলছে।
বৈশ্বিক ভূমিকা কী?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বল্প ও মধ্য আয়ের দেশে সমতার ভিত্তিতে টিকা সরবরাহের লক্ষ্যে নিয়েছে কোভ্যাক্স কার্যক্রম। এই উদ্যোগের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউড। উন্নত ও ধনী দেশগুলো যখন টিকার ডোজের বড় চালান কিনে ফেলেছে তার মধ্যে কোভ্যাক্স দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিতের চেষ্টা চালাবে।
গতবছরের সেপ্টেম্বরে সেরাম চলতি বছর কোভ্যাক্সে ২০ কোটি ডোজ সরবরাহের অঙ্গীকার করে। সেরাম দুটি টিকা উৎপাদনের লাইসেন্স নিয়েছে। এর একটি হলো; অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার, অন্যটি যুক্তরাষ্ট্রে আবিষ্কৃত নোভাভ্যাক্স।
সেরাম মুখ্য নির্বাহী আদর পুনেওয়াল্লা বিবিসি'কে জানান, কোভ্যাক্সের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির পরিধি বেড়ে আরও ৯০ কোটি ডোজে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে শত কোটির বেশি ডোজ সরবরাহে সংস্থাটির অঙ্গীকারের উপর নির্ভর করবে কোভ্যাক্স।
কোম্পানিটি আরও জানায়, চলতি বছরের মার্চ নাগাদ তারা বিদ্যমান উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়ে মাসে একশ' কোটি ডোজে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়েছে।
ভারতীয় সংস্থাগুলোর অন্যান্য অঙ্গীকার কী?
কোভ্যাক্স ছাড়াও অন্য কয়েকটি দেশের সঙ্গে সরাসরি অক্সফোর্ড টিকা সরবরাহের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক চুক্তি করেছে সেরাম।
তবে সংস্থাটির মুখ্য নির্বাহীর সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে এনিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। চলতি মাসের শুরুর দিকে তিনি বলেছিলেন যে, ভারত সরকার রপ্তানি করা যাবে না এই শর্তে তাদের উৎপাদিত এবং অক্সফোর্ড আবিষ্কৃত টিকাকে অনুমোদন দিয়েছে।
এনিয়ে বাংলাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার প্রেক্ষিতে ভারত সরকার এক বিবৃতিতে টিকা রপ্তানির ব্যাপারে আশ্বস্ত করে। বাংলাদেশ সেরাম থেকে প্রথম ধাপে তিন কোটি ডোজ কেনার চুক্তি করেছে। এবং ইতোমধ্যেই পরিশোধ করেছে ১২০ মিলিয়ন ডলার।
এব্যাপারে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বিবিসি'কে বলেন, "বিশ্বের বৃহৎ টিকা উৎপাদক হিসেবে প্রতিবেশী দেশ এবং সমগ্র বিশ্বের চাহিদা পূরণে দেওয়া অঙ্গীকারের বিষয়ে ভারত সম্পূর্ণ সচেতন।"
বর্তমানে, সৌদি আরব, মিয়ানমার এবং মরক্কোর সঙ্গেও চুক্তি রয়েছে সেরামের। তবে সেই অনুসারে কি পরিমাণ ডোজ তারা সরবরাহ করবে এবং কখন দেশগুলো ডোজ পাবে তা স্পষ্ট নয়।
নেপাল, ব্রাজিল এবং শ্রীলঙ্কাও ভারতে উৎপাদিত অক্সফোর্ড- অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা বা ভারত বায়োটেকের কোভাক্সিন পেতে আগ্রহী। অবশ্য ভারত বায়োটেকের টিকাটি অন্য কোনো দেশ অনুমোদন দেয়নি।
তবে পুনেওয়াল্লা এও জানান যে, আপাতত স্থানীয় চাহিদা পূরণকেই প্রাধান্য দিচ্ছে তার সংস্থা।
"ভারতের প্রাথমিক চাহিদা পূরণের পর শিগগির আমরা অন্যদেশে রপ্তানি শুরু করব," তিনি জানিয়েছেন।
কোভ্যাক্স উদ্যোগের অন্যতম অংশীদার বৈশ্বিক ভ্যাকসিন জোট গ্যাভির এক মুখপাত্র বিবিসি'কে জানান, তারা সেরাম ও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ উভয়ের সঙ্গেই নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করছেন।
তিনি আশা প্রকাশ করেন, আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস কোনো প্রকার কালক্ষেপণ না করে দেশটি কোভ্যাক্সকে দেওয়া তার অঙ্গীকার পূরণ করবে।
জীবাণু বিশেষজ্ঞ ড. শহিদ জামিল উল্লেখ করেন যে, কোভ্যাক্স একটি আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার, তাই ভারতীয় কোম্পানিগুলো স্থানীয় চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের প্রতিশ্রুতি পালনে দেরি করলে তা তাদের এবং ভারতের সার্বিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করবে। তাছাড়া, অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি মানার দায়বদ্ধতাও দেশটির রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, "বর্তমান সরবরাহ সক্ষমতায় ভারতে টিকার সঙ্কট দেখা দেবে বলে আমি মনে করি না। তবে কত দ্রুত মানুষকে টিকার আওতায় আনা যাবে মূল প্রতিবন্ধকতা দেখা যাবে সেটা ঘিরে।
আরেকটি বাঁধা আসতে পারে, টিকা উৎপাদোনে ব্যবহৃত কাঁচের ভাইল নিয়ে সঙ্কট। অবশ্য, এমন ঘাটতি নিয়ে বিশ্বজুড়েই দুশ্চিন্তা রয়েছে। তবে সেরাম বিবিসি'কে জানিয়েছে, এপর্যন্ত তারা প্রয়োজনীয় কোনো উপাদানের সঙ্কট লক্ষ্য করেনি।
- সূত্র: বিবিসি