মহামারির পাঁচ মাসে আন্তর্জাতিক পর্যটন শিল্পের ক্ষতি ৩২ হাজার কোটি ডলার
করোনাভাইরাসের পৃথিবীব্যাপী বিস্তার প্রথমেই আঘাত হানে বিমান চলাচল এবং পর্যটন শিল্পে। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে এতে বৈশ্বিক পর্যটন শিল্প ৩২ হাজার কোটি ডলার হারিয়েছে। একারণে সাড়ে ১৪ কোটি মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে, বলে জানান জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতারেজ।
গত মঙ্গলবার সংশ্লিষ্ট শিল্পের নীতিমালা পর্যালোচনাপত্র প্রকাশ উপলক্ষ্যে দেওয়া এক ভার্চুয়াল ব্রিফিং- এর বার্তায় এসব কথা বলেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব।
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বাংলাদেশের পর্যটন খাতে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৪০ লাখ জনবল বেকার হয়ে পড়েছে। তাদের ওপর নির্ভরশীল কমপক্ষে দেড় কোটি মানুষ আছেন কঠিন বিপদের মধ্যে।
২০১৯ সালে পর্যটন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৭ শতাংশ ছিল, বলে বিশ্ব অর্থনীতির তৃতীয় বৃহৎ খাত হিসেবে পর্যটনের গুরুত্ব এবং অপরিসীম অবদানের কথা তুলে ধরেন মহাসচিব।
''পৃথিবীর প্রতি ১০ জনে একজন ব্যাক্তির কর্মসংস্থান হয়েছে পর্যটন বা এর সহায়ক শিল্পে। এভাবে লাখ লাখ মানুষের জীবিকার উৎস হয়ে উঠেছে এ খাত'' গুতারেজ জানিয়েছেন।
অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা পাশাপাশি ''এ শিল্প, নানা দেশের সংস্কৃতি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ দেয়। মানুষে মানুষে সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার বন্ধন জুড়তেও যার অবদান অপরিসীম। এভাবে আমাদের ঐক্যবদ্ধ মানবিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখে পর্যটন'' তিনি যোগ করেন।
মহামারির প্রথম পাঁচ মাসে আন্তর্জাতিক পর্যটকদের যাতায়াত অর্ধেকের বেশি কমেছে। ফলে একদিকে যেমন বড় প্রতিষ্ঠানের আয় কমেছে, অন্যদিকে আয়শূন্য হয়ে পড়ায় বন্ধ হয়ে গেছে সংশ্লিষ্ট অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ।
গুতারেজ বলেন, ''ধনী এবং উন্নত দেশের জন্য এ ধস একটি বড় ধাক্কা হলেও, উন্নয়নশীল দেশের জন্য তা জরুরি পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছে কিছু পর্যটন নির্ভর দ্বীপরাষ্ট্র এবং আফ্রিকার দেশসমূহ।''
এসব দেশের কোনো কোনটির মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২০ শতাংশের বেশি আসে পর্যটন থেকে, তিনি ব্যাখ্যা করেন।
এদিকে জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থার- বাজার তথ্য এবং প্রতিযোগী সক্ষমতা শাখার প্রধান সান্ড্রা কারভাও বলেন, ''চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে নাগাদ ৩২ হাজার কোটি ডলারের যে ক্ষতি হয়েছে; ২০০৯ সালের বিশ্ব মন্দার চরম পর্যায়েও এত বড় বিপর্যয় হয়নি। ওই সময়ের তুলনায় বর্তমান ক্ষতির অংক তিনগুণ বেশি।''
জাতিসংঘের পর্যটন নীতি বিষয়ক বিবৃতিতে, ২০২০ সালে এ খাতের রপ্তানি আয় ৯১ হাজার কোটি মার্কিন ডলার থেকে এক লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার কমার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। এর ফলে বৈশ্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১.৫ থেকে ২.৮ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে।
বিশ্ব সংস্থাটির নীতিমালা পর্যালোচনা পত্রে বলা হয়েছে, খাদ্য পরিবেশন-সহ পর্যটন সহায়ক শিল্পে জড়িত ১৪ কোটি ৪০ লাখ কর্মী রয়েছে। কোভিড-১৯ তাদের ভবিষ্যতে আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা অনিশ্চিত করে তুলেছে। কর্মসংস্থান হারানোর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন এসব ব্যক্তি। বিশেষ করে, ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলোর অস্তিত্ব সবচেয়ে বড় হুমকির মুখে।
এ অবস্থায় গুতারেজ বলেন, বিশ্বের প্রাকৃতিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে পর্যটন অন্যতম স্তম্ভ। এখাতের সুরক্ষা এবং জরুরি পুঁজি সরবরাহে সকল দেশের সরকার এবং দাতা সংস্থাগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
তাছাড়া, প্রাকৃতিক বনভূমি এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণেও পর্যটন অবদান রাখে। প্রতিবছর বন্যজীবন পর্যটন থেকে বিশ্বের মোট পর্যটন আয়ের ৭ শতাংশ আসে, বলে জানানো হয় জাতিসংঘের ব্রিফিংয়ে। পর্যটনের এ খাতটি বছরে ৩ শতাংশ হারে বাড়ছে বলেও সেখানে উল্লেখ করা হয়।
জাতিসংঘ মহাসচিব জানান, ''বন্যপ্রাণি পর্যটন থেকে রপ্তানি কমলে- সংরক্ষিত বনভূমিতে চোরা শিকারিদের উৎপাত বাড়ে এবং প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া, সংক্রমণ প্রতিরোধের চেষ্টায় অনেক সংরক্ষিত এলাকায় পর্যটন নিষিদ্ধ করার ফলে, স্থানীয় বাসিন্দারা আয়ের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হয়েছেন।''
সার্বজনীন কল্যাণের কথা মাথায় রেখে, স্থানীয় অধিবাসী, পর্যটক এবং সংশ্লিষ্ট খাতের কর্মীদের সহায়ক করে পর্যটন খাত পুনঃনির্মাণের আহ্বান জানিয়েছেন গুতারেজ। এর সঙ্গে টেকসই এবং জলবায়ু সহযোগী ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
বিশ্ব পর্যটন সংস্থা'র বিশেষজ্ঞ কারভাও বলেন, ''কিছু কিছু ক্ষেত্রে চলাচল নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হলেও, বেশিরভাগ নিষেধাজ্ঞা আগামীদিনেও বহাল থাকবে। সবকিছুই নির্ভর করছে চলমান মহামারির পালা-বদলের উপর। তাছাড়া, অর্থনৈতিক পরিবেশও নেপথ্যে বড় ভূমিকা রাখতে চলেছে।''
''পৃথিবীর কোনো দেশই পর্যটনখাতে কোভিড সৃষ্ট ক্ষতি এড়াতে পারেনি'' তিনি যোগ করেন।