যুক্তরাষ্ট্রের সাড়া না পেয়ে রাশিয়ার দিকে ঝুঁকছে তুরস্ক
জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন চলাকালে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের আমন্ত্রণ স্বীকার করেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ক্ষুদ্ধ এবং হতাশ এরদোগান তুর্কি সাংবাদিকদের জানান, পূর্ববর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্টদের সঙ্গে তিনি কাজ করতে সমর্থ হলেও বাইডেনের সঙ্গে এখন অবধি আগাতে পারেননি।
ইস্তানবুলে নামাজ আদায় শেষে সাংবাদিকদের এই কথা বলার পর ২৪ ঘণ্টা যেতে না যেতেই দ্বিতীয়বারের মতো বাইডেনের সমালোচনা করেন এরদোগান। তিনি বলেন, নিউ ইয়র্কে যাওয়া সত্ত্বেও বাইডেনের সঙ্গে তিনি দূরত্ব ঘোচাতে ব্যর্থ হয়েছেন। এছাড়া, মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার সাম্প্রতিক আলাপ হতাশাজনক প্রমাণিত হয়ে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
'জঙ্গি সংগঠনে'র সঙ্গে লড়াই করার পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সহায়তা করছে বলেও অভিযোগ করেন এরদোগান। উত্তর সিরিয়ার নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) সঙ্গে সম্পৃক্ত পিপলস প্রটেকশন ইউনিটসের (ওয়াইপিজি) সাথে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারত্বের কথা উল্লেখ করে একথা বলেন তিনি।
এছাড়া, তুরস্ক রাশিয়ার কাছ থেকে দ্বিতীয় দফায় এস-৪০০ মিসাইল কেনার কথা ভাবছে বলেও জানান তুর্কি প্রেসিডেন্ট।
এরদোগানের বিবৃতির পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র বিষয়ক সিনেট কমিটি হুঁশিয়ারি জানিয়েছে যে, তুরস্কের যেকোনো নতুন কেনাকাটার অর্থ তুরস্কের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ। নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে মার্কিন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই আইনের (সিএএটইসিএ) অধীনে তা আরোপিত হবে বলে সতর্ক করে তারা।
ন্যাটোর এই দুই মিত্রের সম্পর্কে যখন ভাঙন ধরেছে, তখন বুধবার কৃষ্ণ সাগরের সোচি রিসোর্টে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে বসতে চলেছেন এরদোগান। এরই মধ্য দিয়ে মস্কোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির পরিকল্পনা করছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট।
যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্ক সম্পর্কে উত্তেজনা
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক গালিপ দালায় আল-জাজিরাকে বলেন, "তুরস্কের এস-৪০০ ক্ষেপনাস্ত্র ক্রয়ের বিষয়কে ওয়াশিংটন স্রেফ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে দেখছে না। বিষয়টি তারা তুরস্কের ভূ-রাজনৈতিক পরিচিতি হিসেবেও দেখছে যা পশ্চিম থেকে ক্রমশ রাশিয়া ও চীনের নিকটবর্তী হচ্ছে।"
১৯৫২ সালে তুরস্ক তৎকালীন সোভিয়েত বিরোধী জোটে যোগদানের পর তুরস্ক ও আমেরিকার সম্পর্ক নতুন করে সংজ্ঞায়িত হয়।
আমেরিকান দৃষ্টিকোণ থেকে তুরস্ক ন্যাটোর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ন্যাটোর জরুরি সামরিক ঘাঁটির দায়িত্বেও রয়েছে তারা। একইসঙ্গে মধপ্রাচ্যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারকরণ ও তথাকথিত 'জঙ্গিবাদ বিরোধী যুদ্ধে' তুরস্ক আমেরিকার সহযোগী রাষ্ট্র।
তবে এই সম্পর্কের পুরোটাই নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে। এর বাইরে দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক বা ঐতিহাসিক সম্পর্ক, অর্থনৈতিক নির্ভরতা কিংবা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনের কোনোটিই এখানে নেই।
নিরাপত্তা হুমকি চিহ্নিতকরণের প্রশ্নে আঙ্কারা ও ওয়াশিংটনের মধ্যকার ভাবনায় বাড়তে থাকা এই দূরত্ব এই সম্পর্ককে সহজেই সংকটে ফেলতে পারে। এমনকি দুপক্ষকে মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারে এই দ্বন্দ্ব।
২০১৯ সালের অক্টোবরের তুর্কির অপারেশন পিস স্প্রিং চলাকালে মার্কিন নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের সম্ভাবনা দেখা দেয়। ৬ অক্টোবর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অপ্রত্যাশিতভাবে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণায় এই সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব হয়েছিল।
তুরস্ক-রাশিয়া সম্পর্ক
তবে, পুতিনের সম্পর্কে এরদোগানের মন্তব্য বাইডেন সম্পর্কে তার মন্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। পুতিনের সঙ্গে মহৎ এবং কাজ সংশ্লিষ্ট ভালো সম্পর্ক থাকার কথা বারবার বলেছেন এরদোগান।
"ব্যক্তিগতভাবে এরদোগান বুঝতে পেরেছেন যে, তাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের চূড়ান্ত লক্ষ্য নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে চলছে যুক্তরাষ্ট্র। এই হতাশা ও হুমকিই প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমকক্ষীয় রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী করে তুলেছে," আল-জাজিরার কাছে মন্তব্য করেন জার্মান মারশাল ফান্ড অব দ্য ইউনাইতেড স্টেটসের আঙ্কারা দপ্তরের পরিচালক ওজগুর আনলুহিসারিকলি।
"তবে, বিষয়টি তুরস্ককে রাশিয়ার সঙ্গে দুর্বল অবস্থানে ফেলে দিবে। ঐকমত্যের চেয়ে রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের প্রতিযোগিতামূলক স্বার্থই বেশি," বলেন তিনি।
তুরস্ক ও রাশিয়া সহযোগী হয়েও পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। সিরিয়া, লিবিয়া, ককেশাস এবং বলকানে তারা পরস্পর বিরোধী পক্ষ সমর্থন করে।
তবে, যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীর। আর তাই ভূ-রাজনৈতিক মতপার্থক্য যেন বাণিজ্য ব্যবস্থাকে বিঘ্নিত না করে তা নিয়ে মস্কো ও আঙ্কারা দুপক্ষই সচেষ্ট।
তবে, তুরস্ক বহুলভাবে রাশিয়ার আমদানিকৃত গ্যাস এবং লাখ লাখ রাশিয়ান পর্যটকের ওপর নির্ভরশীল বলে অর্থনৈতিক ক্ষমতার পাল্লা মস্কোর ভারী। এদিকে, রাশিয়ার কৃষি ও টেক্সটাইল পণ্যের প্রধান রপ্তানিকারক তুরস্ক।
আর তাই দুপক্ষের মধ্যে বৈরিতা থাকলে উভয় দেশই পরস্পরের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
এছাড়া, মস্কো অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা ছাড়াই আঙ্কারার প্রতিরক্ষা খাতকেও সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করবে বলে মন্তব্য করেন রাশিয়ান ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেউয়ার্স কাউন্সিলের সদস্য ম্যাক্সিম সুচকভ।
"রাশিয়ার প্রাচুর্য্য ব্যবহার করে তুরস্ক যেমন নিজেদের কৌশলগত সার্বভৌমত্ব জোরদার করতে চাইছে, তেমনি রাশিয়াও তুরস্ককে ব্যবহার করে পরাশক্তি হিসেবে নিজেদের কর্তৃত্ব বাড়াতে চাইছে, বলেন তিনি।
তবে, ওয়াশিংটনের সঙ্গে বিরোধের কারণে তুরস্ক ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন প্রাপ্তির সম্ভাবনা বিসর্জন দিচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন আনলুহিসারিকলি। রাশিয়ার সঙ্গে মতৈক্যের চেয়ে তুরস্কের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক স্বার্থই বেশি। আর তাই রাশিয়ার সঙ্গে যেকোনো বিরোধে তুরস্ক একা হয়ে পড়বে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
- সূত্র: আল-জাজিরা