১৯৯৬ সালে কাবুল দখলের পর যেভাবে সাবেক প্রেসিডেন্টকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করে তালেবান
সোভিয়েত আগ্রাসন কালে দখলদার বাহিনীর সহযোগী ছিলেন মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহ আহমাদজাই। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শুধু নাজিবুল্লাহ বা ড. নাজিব নামেই পরিচিত হলেও নিজ দেশবাসী আফগানরা তাঁকে নাম দিয়েছিল 'কাবুলের কসাই'।
সোভিয়েতরা বাবরাক কারমালকে প্রেসিডেন্ট করার পর- কেজিবির অনুকরণে গড়ে তোলা আফগান গোয়েন্দা সংস্থা- খাদ'কে নেতৃত্ব দেন নাজিবুল্লাহ। এই সংস্থাটি সেসময়ে পাশবিক নির্যাতনের জন্য দুনিয়াজুড়ে কুখ্যাতি লাভ করেছিল। সোভিয়েত দখলদারির শেষ সময়ে ১৯৮৭ সালে তিনিই হন নতুন প্রেসিডেন্ট। তাই নাজিবও ছিলেন সোভিয়েত বিরোধী মুজাহেদিনদের প্রাণের শত্রু।
ইতঃপূর্বে ভারতে পালানোর এক চেষ্টায় ব্যর্থ হওয়ার পর ১৯৯২ সালের ২৫ এপ্রিল মুজাহেদিন গেরিলারা কাবুল দখল করে নিলে সোভিয়েত সমর্থিত এই এক নায়ক শহরে অবস্থিত জাতিসংঘের স্থানীয় কার্যালয়ে আশ্রয় নেন। কার্যত সেখানে স্বেচ্ছাবন্দী ছিলেন কেবল প্রাণ বাঁচাতে। খোদ মুজাহেদিনরাও জাতিসংঘ কার্যালয়ে ঢুকে তাঁকে হত্যার কথা ভাবেনি।
কিন্তু, নাজিবের সময় ফুরিয়ে আসছিল। মুজাহেদিন গোষ্ঠীগুলো ক্ষমতা দখল নিয়ে গৃহযুদ্ধ শুরু করলে নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় তালেবান। তারা ১৯৯৬ সালের আরেক এপ্রিল মাসে কাবুলে প্রবেশ করে। দীর্ঘ এই সাড়ে চার বছর জাতিসংঘ কার্যালয়ে অন্তরীণ ছিলেন নাজিব। কিন্তু, সাবেক প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও তালেবান তাঁকে রেহাই দেয়নি। হত্যা করেছিল নৃশংস কায়দায়।
কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া পর ইসলামী রাষ্ট্র ঘোষণা করে তালেবান, এবং তারপরই সহিংসতার চূড়ান্ত নজির স্থাপন করে নাজিবুল্লাহকে হত্যা করে, এটি প্রথম হলেও পরবর্তীতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি তারা অসংখ্যবার করেছে।
নাজিবুল্লাহ ও তাঁর ভাই শাহপুর আহমদজাইকে জাতিসংঘ দপ্তর থেকে বের করে এনে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের সামনে অবস্থিত কংক্রিটের তৈরি ট্র্যাফিক কন্ট্রোল পোস্টে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয় তালেবান যোদ্ধারা। হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়ে সেদিন এ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিল।
কাবুল দখলকারী তালেবান কমান্ডার নূর হাঁকমাল বলেন, "সে আমাদের জনগণের হত্যাকারী ছিল, তাই তাঁকেও আমরা হত্যা করেছি।"
সে সময় জাতিসংঘের আফগানিস্তান বিষয়ক শান্তিদূত নরবার্ট হল তীব্র আতঙ্ক প্রকাশ করে বলেছিলেন, তালেবান শহরে ঢোকার পর দুপুর ৩টার দিকে নাজিবুল্লাহ জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের ফোন করে জানান কম্পাউডের প্রহরীরা পালিয়ে গেছে এবং তাদের কাছে নিরাপত্তা প্রদানের অনুরোধ করেন। তবে কোন সাহায্য এসে পৌঁছানোর আগেই তাঁকে কম্পাউন্ড থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে যায় তালেবান।
যদিও তালেবানের রহস্যময় আধ্যাত্মিক নেতা মোল্লা মোহাম্মদ ওমর শহর দখলে নেওয়ার পর সকল নাগরিককে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, তালেবান সকলের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। ওমর যারা পালিয়ে গেছে তাদেরকেও ফিরে আসার আহবান জানান। তারপরই ঘটে নাজিবের হত্যাকাণ্ড।
মোল্লা ওমর সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়, এক চোখে অন্ধ ওমরের তখন বয়স ছিল মাত্র ৩০। কিন্তু, ধর্মীয় শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করে তালেবান গঠনে ওমরই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কাবুল দখলের মাত্র দুই বছর আগে ১৯৯৪ সালে তালেবান গঠন করেন ওমর। তবে একাজে পাকিস্তানী সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা- আইএসআই সক্রিয় সহযোগিতা দিয়েছিল।
পাকিস্তান ভিত্তিক আফগান ইসলামিক প্রেস (এআইপি) কাবুল দখলের পর তালেবানদের বিবৃতি প্রকাশ করে। এ ঘোষণায় ছয় সদস্যের একটি সর্বোচ্চ পর্ষদ ইসলামী রাষ্ট্রকে এখন থেকে শাসন করবে বলে জানায় তালেবান। মোল্লা ওমরের ডেপুটি মোল্লা মোহাম্মদ রব্বানি এ পর্ষদের প্রধান পদে থাকবেন বলে জানায় সশস্ত্র গোষ্ঠীটি।
তালেবানের শাসন ও বিচার ব্যবস্থা কেমন হবে মোল্লা ওমর অবশ্য আগেই তাঁর ইঙ্গিত স্পষ্ট করেই দিয়েছিলেন। এআইপি'কে পাঠানো এর আগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তিনি বলেছিলেন, সম্পূর্ণ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই তালেবানের লক্ষ্য, আর সেখানে পুরোপুরি ইসলামী আইন কার্যকর করা হবে।
তালেবানের একজন কমান্ডার হাকমাল জানান, তাদের যোদ্ধারা মুজাহেদিন সরকারের প্রেসিডেন্ট বুরহানউদ্দিন রব্বানি, প্রধানমন্ত্রী গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার এবং সামরিক বাহিনী প্রধান আহমেদ শাহ মাসুদকে পুরো শহরজুড়ে খুঁজছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, তারা তালেবানদের ট্যাংক ও কামানসহ ট্রাকে করে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে মাসুদের শক্ত ঘাঁটি পানশির উপত্যকার প্রবেশপথ জাবাল উস-শরীফের দিকে যেতে দেখেছে।
ওই সময় আফগানিস্তানে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত জানান, রব্বানি ও তাঁর সরকারের অন্যান্য সদস্য কাবুল থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে পালিয়ে গেছেন। তালেবান প্রচণ্ড প্রতিহিংসাকামী বুঝেই তারা পালিয়ে যান।
অথচ, মুসা নামের এক তালেবান কমান্ডার বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি তাদের বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা প্রদান এবং সাবেক সরকারের কর্মকর্তাদের প্রতি প্রতিহিংসামূলক আচরণ না করার অনুরোধ জানিয়েছে।
ওই কমান্ডার বলেন, তালেবান প্রতিহিংসায় বিশ্বাস করে না এবং আত্মসমর্পণকারী সকল সেনা ও কর্মকর্তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে।
"তালেবান প্রতিহিংসা নেবে না। আমাদের কোন ব্যক্তিগত আক্রোশ নেই। তবে অতীত অপরাধের জন্য জনগণ যদি কাউকে দোষী বলে মনে করে, আমরা তাঁর বিরুদ্ধে ইসলামী আইন অনুসারে বিচার করব।"
কিন্তু, ইচ্ছেমতো শাস্তি দিতে তালেবান কতোটা নির্মম ছিল নাজিবুল্লাহ'র ঘটনা তা প্রমাণ করে।
এর আগে কান্দাহার দখলের পরেই বর্তমান আফগান সরকারের প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগ করার আহবান জানিয়েছিল তালেবান; কিন্তু তিনি সে প্রস্তাব মেনে নেননি। এখন তালেবান কাবুলের ভেতরে, আর শহরের উপকণ্ঠেও জমায়েত হয়েছে তাদের সামরিক শক্তি। ঘানি তালেবানদের বারবার সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ক্ষুদ্ধ করেছেন তালেবান নেতৃত্বকে।
এর আগে তালেবানের প্রধান মুখপাত্র সুহাইল শাহিন গেল সপ্তাহেই বলেছিলেন, আশরাফ ঘানির সময় ফুরিয়ে আসছে, তিনি মিথ্যাচার করে ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। তাই নতুন বাস্তবতায় প্রশ্ন জাগে এবার ঘানির ভাগ্যে কী পরিণতি অপেক্ষা করছে?
- সূত্র: আইরিশ টাইমস