হার্ভার্ডে চাকরির প্রলোভন দেখানো প্রতারণা চক্রের টার্গেট ভারতীয় নারী সাংবাদিকরা
সাংবাদিকদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন, হামলা-মামলা যেন সবসময়-ই একটি সমসাময়িক বিষয়। এবার ভারতের নারী সাংবাদিকদের টার্গেট করে অদ্ভুতুড়ে অনলাইন স্ক্যামের ঘটনা সামনে এসেছে।
ভারতের বিভিন্ন প্রখ্যাত নারী সাংবাদিকদের বিভিন্ন সময় ফেইক টুইটার প্রোফাইল থেকে নক দিয়ে জানানো হয় তারা হার্ভার্ডে চাকরির সুযোগ পেয়েছেন। শুরুটা হয় তাদেরকে মিডিয়া কনফারেন্সে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়ে। ধীরে ধীরে চাওয়া হয় তাদের পাসপোর্টের তথ্য, মেডিক্যাল রেকর্ড, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নাম্বারসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত গোপনীয় সব তথ্য।
ফেসবুক, টুইটার, জিমেইল আর হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে একজন নারী সাংবাদিককে কয়েক মাস ধরে চাকরির কথা, সম্ভাব্য সময়, সুযোগ-সুবিধা, আমেরিকা যাওয়ার পুরো প্রক্রিয়া এসব বিষয়ে মেসেজ দেওয়া হয়।
'আমেরিকা এসে পৌঁছানোর পর এই হোটেলের এই রুম আপনার জন্য বুকিং করা হবে নাকি,"
এ ধরনের মেসেজ দিয়ে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করা হয়। প্রথমে কয়েকজনকে হার্ভার্ডে চাকরির অফার দেওয়ার সময় কোনো অফিসিয়াল ডকুমেন্ট দেখানো হয়নি। এরফলে সন্দেহ হওয়ায় অনলাইন প্রতারণার হাত থেকে বেঁচেও যান অনেকে।
এই প্রতারণা দলের প্রথম টার্গেট ছিলেন দ্য ওয়্যারের ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক রোহিনি সিং। ২০১৯ সালের আগস্টে তৌসিফ আহমেদ নামের এক টুইটার প্রোফাইল থেকে তাকে বার্তা পাঠিয়ে মিডিয়া কনফারেন্সে আমন্ত্রণ জানানো হয়। পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় অ্যালেক্স নামের আরেক ব্যক্তির সঙ্গে। এই দুইজনই নিজেদের হার্ভার্ডের শিক্ষার্থী পরিচয় দেয়। তাদের মেইল আইডি বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসিয়াল মেইলও ছিল না। এরপর রোহিনির কাছে ব্যক্তিগত গোপনীয় কিছু তথ্য চাইলে প্রতারণা চক্র সন্দেহে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন রোহিনি।
এরপর টার্গেট করা হয় আরেক নারী সাংবাদিক জয়নাব সিকান্দারকে। একই রকম মেসেজ পাঠিয়ে একই প্রোফাইল থেকেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাদের নাম্বারের লোকেশন দেখাচ্ছিল আরব আমিরাতে, কিন্তু তারা জানিয়েছিল তারা আছে বোস্টনে। তারপরও বুঝে উঠতে পারছিলেন না জয়নাব। শেষ পর্যন্ত তিনি ডিনের অফিস থেকে পাঠানো অফিসিয়াল লেটার চাওয়ার পর তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় প্রতারক দলই।
এরপর টার্গেট করা হয় আরেক নারী সাংবাদিককে, সংবাদমাধ্যমে নাম না প্রকাশের শর্তে নিজের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা জানান তিনি। এবার প্রতারক দল হার্ভাডের লেটার আর ডিনের সই নকল করে পাঠালেও তাদের আরব আমিরাতের ফোন নাম্বার দেখে সন্দেহ হয় তার। যোগাযোগ করেন হার্ভার্ডে। তখনই জানতে পারেন ওই নামে হার্ভার্ডে কোনো শিক্ষার্থী নেই।
২০২০ সালে এসে প্রতারক দলের ফাঁদে পড়ে যান বিখ্যাত ভারতীয় নিউজ অ্যাঙ্কর নিধি রাজদান। তার সব গোপনীয় তথ্য ওই দলকে পাঠিয়ে দেন তিনি। হার্ভার্ডে পড়াতে যাচ্ছিলেন এ ঘোষণাও দিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ফলে তিনি প্রতারিত হয়েছেন বুঝতে পারার পর হতবিহ্বল হয়ে পড়েন, কারণ ততোদিনে হার্ভার্ডে চাকরি পেয়েছেন ধরে নিয়েই দেশ ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিলেন। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে বসে নিধি শুধু ভাবছিলেন তিনি এই বোকামি করলেন কীভাবে।
নিধিকে টার্গেট করার আগে নিজেদের দুর্বলতা কাটিয়ে নিয়ে ততোদিনে আরও চতুর হয়ে উঠেছিল তারা। হার্ভার্ডএডমিশন নামে ওয়েবসাইটের ডোমেইন কিনে নেয়, সঙ্গে একই নামের জিমেইল অ্যাকাউন্ট।
টার্গেট করা নারী সাংবাদিক কারো কাছ থেকেই কোনো অর্থ চাওয়া হয়নি। তারা ঠিক কী কারণে সাংবাদিকদের টার্গেট করে এতো পরিশ্রম করে ঘোল খাওয়াতে চাইলেন তার পরিষ্কার জবাব না মিললেও তাদের কাজের দিকে তাকালেই হয়তো অনেক কিছু আন্দাজ করা যেতে পারে।
রোহিনী সিং ভারতের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছেলের ব্যবসা হঠাত করেই ফুলে ফেঁপে ওঠা নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন লিখেছিলেন ২০১৭ সালে। ভারতে সংখ্যলঘু মুসলিমদের ওপর নির্যাতন নিয়ে ও নরেন্দ্র মোদির সমালোচনা করে বিশ্লেষণী প্রতিবেদন লিখতেন জয়নাব সিকান্দার। ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের অধীনে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে প্রদত্ত বিশেষ মর্যাদা বাতিল ও কাশ্মীরে গ্রেপ্তার ও ক্র্যাকডাউন নিয়ে বেশ সোচ্চার ছিলেন তিনি। ভারতের বিভিন্ন বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ও কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে সোচ্চার ছিলেন নিধি রাজদান।
এই ঘটনাগুলো সাড়া ফেলার পরও দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এক ভুক্তভোগী হার্ভার্ডে যোগাযোগ বিস্তারিত ডকুমেন্টেড প্রমাণও পাঠান।
নিধি রাজদান পরে যোগাযোগ করেছিলেন সাইবার সিকিউরিটি ফার্ম ভয়েজার ইনফোসেকের সঙ্গে। ফার্মটির পরিচালক জানান, খুব সম্ভবত রাজদানের ইমেইল হ্যাক করা হয়েছিল। এমনকি তার কোনো ডিভাইসে ম্যালওয়্যার ইনস্টল করা হয়েছিল এমন আশঙ্কার কথাও জানায় ফার্মটি।
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস