সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন করে যেভাবে পশ্চিমা বিশ্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে রাশিয়া
সামরিক বাহুবলে ১৯ শতক থেকেই বিশ্ব শক্তির কাতারে উঠে আসে রাশিয়া। এমনকি স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে অর্জন করে পরাশক্তির মর্যাদা। তবে ব্যতিক্রম ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পরের এক দশক। এসময় নতুন গঠিত রাশিয়ান ফেডারেশন চরম অর্থনৈতিক দৈন্যতায় আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়।
রাশিয়ার সামরিক বাহিনীও এই সময়ে ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়। পর্যাপ্ত তহবিল না থাকায় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয় হাজারো কোটি ডলারের সমরাস্ত্র: সাবমেরিন, ট্যাঙ্ক, ক্ষেপণাস্ত্র, মহাকাশ যান—কিছুই বাদ পড়েনি। থেমে যায় নতুন প্রযুক্তির সমরাস্ত্র উদ্ভাবন। তবে পরিস্থিতি বদলায় ভ্লাদিমির পুতিন ক্ষমতার হাল ধরার পর। তার অধীনে রুশ অর্থনীতিতেও কিছুটা প্রাণসঞ্চার হয়, আসে স্থিতিশীলতা। আর নতুন অস্ত্র গবেষণাও জোরদার হয়।
পুতিনের অধীনে নয়া সামরিক প্রকল্পে বড় অঙ্কের বরাদ্দও দেওয়া শুরু হয়। মস্কোর এসব উদ্যোগের আধুনিকায়ন হয় দেশটির বিমান ও নৌবাহিনীর। তৈরি হয় সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইলসহ অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র।
পশ্চিমা সামরিক জোট (ন্যাটো) রাশিয়ার সামরিক সক্ষমতা নিয়ে মাঝেমধ্যেই প্রশ্ন তুললেও; সম্প্রতি বেলারুশ থেকে শুরু করে পূর্ব ইউক্রেনের সাথে নিজেদের সীমান্তে স্বল্প সময়ের মধ্যে বিপুল সেনা মোতায়েন করে সব পক্ষকে বিস্মিত করেছে রাশিয়া। পশ্চিমা দুনিয়ার রাজধানীগুলোয় নীতিনির্ধারকরা এনিয়ে উদ্বিগ্ন হতে বাধ্য হয়েছেন। সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার মেঘ জড়ো হয়েছে ওয়াশিংটনের আকাশে।
এর আগে সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের সরকার পতন ঘটাতে বিদ্রোহী পক্ষগুলোকে অস্ত্র, অর্থ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করে পশ্চিমা বিশ্ব, তাদের আরব মিত্ররা এবং ইসরায়েল। অন্যদিকে, আসাদ সরকার রক্ষায় এগিয়ে আসে রাশিয়া ও ইরান। এই যুদ্ধে নিজেদের তৈরি নতুনতম দূরপাল্লার হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে রাশিয়া। সিরিয় বিদ্রোহীরা তাতে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রাশিয়া মিত্র আসাদ সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য হস্তক্ষেপ করলেও, সেই সুযোগে বিশ্বকে নিজেদের নতুন সামরিক প্রযুক্তির প্রমাণ দিয়ে তাক লাগায়। খোদ পশ্চিমা সেনা কর্মকর্তারাই তা স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন।
ইউরোপে মোতায়েন করা মার্কিন সেনাদলের সাবেক সর্বাধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল বেন হজেস বলেন, "কয়েক বছর আগের ওই সময়ে যখন রুশ ক্ষেপণাস্ত্র কাস্পিয়ান সাগরের উপর দিয়ে এসে সিরিয়ায় লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে তখন আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। বিষয়টি বিব্রতকর তাও স্বীকার করছি। বিস্মিত হওয়ার কারণ, শুধু সক্ষমতার দিক থেকে নয়, রুশ নৌবহর সেখানে থাকার তথ্যও আমাদের জানা ছিল না।"
পশ্চিমা চাপ ও অর্থনৈতিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এভাবেই নিজের সামরিক বাহিনীগুলোর আধুনিকায়নে সফল হয়েছে রাশিয়া। সেই সুবাদে অর্জিত আত্মবিশ্বাস থেকেই সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে পেশিশক্তির ব্যবহার করেছে ক্রেমলিন। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গোপন হস্তক্ষেপ করেছে আফগানিস্তান ও ভেনিজুয়েলায়।
নিজ সীমানার কাছে ন্যাটোর সম্প্রসারণ মেনে নেবে না মস্কো। ইউক্রেন নিয়ে অতি-সাম্প্রতিক উত্তেজনা চলাকালে সে দাবি স্পষ্ট করে জানিয়েছে মস্কো। ইউক্রেনে রয়েছে বড় সংখ্যক রুশভাষী জনসংখ্যা, তাছাড়া ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক দিক থেকেও দুই ভূখণ্ডের অভিন্নতা রয়েছে। কিয়েভ ন্যাটো সদস্য হওয়া মানে দেশটির সম্পূর্ণ পশ্চিমামুখীতা। তাই রাশিয়া চায়, ইউক্রেনকে কখনোই ন্যাটোর সদস্য করা হবে না- এমন প্রতিশ্রুতি।
রাশিয়ার সামরিক সক্ষমতা কতখানি অগ্রসর
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর ১৯৯০ এর দশকের সেই চরম বিপর্যয়কর বছরগুলোতেও মস্কোর হাতে ছিল বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পরমাণু অস্ত্র ভাণ্ডার। ফলে দেশটির বহিঃশত্রুর আগ্রাসন মোকাবিলার সক্ষমতা ছিল অটুট। কেউই অন্তত সামরিকভাবে রাশিয়ার ভূখণ্ডের দিকে হাত বাড়ানোর চিন্তা করেনি। বর্তমানে বিশ্বের যেকোনো পরাশক্তির চেয়ে বেশি পরমাণু অস্ত্র রয়েছে রাশিয়ার কাছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ বিমান বাহিনীর অধিকারী রাশিয়া। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত দশকে অত্যাধুনিক সুখই-৩৫ সহ আরও এক হাজার বিমান যুক্ত হয়েছে বিমান বাহিনীতে।
সুখই-৩৫ বর্তমানে প্রযুক্তিতে সেরা যুদ্ধবিমানগুলোর একটি। রাশিয়ার মিত্র ও ইউক্রেনের আরেক প্রতিবেশী বেলারুশেও লড়াকু বিমানটি মোতায়েন করা হয়েছে । তাছাড়া, বৃহদাকৃতির কৌশলগত বোমারু বিমান কেবল যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়া এই তিনটি দেশের কাছেই রয়েছে।
বিমান বাহিনীর মতোই যুক্তরাষ্ট্রের পর বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা সমুদ্র শক্তি রুশ নৌবাহিনী। মস্কোর কাছে রয়েছে ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বহনকারী দ্বিতীয় বৃহত্তম সাবমেরিন বহর।
রুশ স্থলবাহিনীও যথেষ্ট শক্তিশালী। রিজার্ভসহ ৩০ লাখের বেশি সদস্য রয়েছে রুশ সেনাবাহিনীতে। সংখ্যার দিক থেকেও যা বিশ্বের অন্যতম বড়।
তবে যেদিক থেকে রাশিয়ার কোনো তুলনা নেই, তা হলো ট্যাঙ্ক বহরের বিপুলতায়। পুরোনো প্রযুক্তির ট্যাঙ্কগুলোর ব্যাপক আধুনিকায়ন করা হয়েছে। নৈশকালীন লড়াইয়ের জন্য উন্নত নাইট ভিশন প্রযুক্তির যুক্ত হয়েছে রাশিয়ার টি-৭২বি৩ শ্রেণির ট্যাঙ্কে। এছাড়া, বহরের প্রায় সব ট্যাঙ্ক শত্রুর ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মিসাইল ছুঁড়তে সক্ষম। মার্কিন সামরিক বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস, বর্তমানে রাশিয়ার ট্যাঙ্কগুলোই সবচেয়ে দূর-পাল্লার মিসাইল ছুঁড়তে পারে।
রাশিয়ার আরেক বিখ্যাত মারণাস্ত্র ইসকান্দার-এম কৌশলগত মিসাইল। পুতিনের প্রশাসন এই ক্ষেপণাস্ত্র গবেষণাকে গুরুত্ব দেয়। এটি দেশটির নতুন প্রজন্মের ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র,যা সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তেও মোতায়েন করা হয়েছে। এই ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনের অভ্যন্তরে যেকোনো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম।
শুধু সংখ্যায় বিশাল সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে সন্তুষ্ট নয় মস্কো। তাই একটি সুশৃঙ্খল ও সুপ্রশিক্ষিত বাহিনীও গড়ে তোলা হয়েছে। তবে এখনও স্বেচ্ছাসেবী সেনাভর্তির ওপর নির্ভরশীল রাশিয়া। এমন সেনা সদস্যের সংখ্যা তাদের মোট বাহিনীর ৩০ শতাংশ। তবে মূল বাহিনী এখন উচ্চ বেতন ও প্রশিক্ষণের সুবিধাভোগী। এই অভিজ্ঞ সেনাদের সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ।
সমর কৌশলের ক্ষেত্রেও উদার হয়েছে মস্কো। সেনা নেতৃত্ব মাঠ পর্যায়ের অফিসারদের রণাঙ্গনের পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণে আরও অনেক বেশি ছাড় দিচ্ছেন। একইসাথে সামরিক বাহিনীর সকল র্যাঙ্কধারীদের মধ্যে আত্নবিশ্বাস, দেশপ্রেম বৃদ্ধি ও পদোন্নতির মতো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
সিরিয়ার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধেই রাশিয়া তার সেনাবাহিনীর একটি বড় অংশকে যুদ্ধ বাস্তবতায় প্রশিক্ষণ ও নতুন অস্ত্র ব্যবহার করে তার কার্যকারিতা পরীক্ষার সুযোগ পায়। রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুর মতে, সিরিয়ায় যুদ্ধ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে রুশ নৌবাহিনীর ৬২ শতাংশ সদস্য।
এব্যাপারে মার্কিন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ফ্রেড কাগান বলেন, "নিক্ষেপ করার মতো সব ধরনের অস্ত্র তারা সিরিয়ায় ব্যবহার করেছে।"
জনগণকে যুদ্ধের জন্য সদা-প্রস্তুত রাখতে রাশিয়ায় ১৮-২৭ বছরের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সামরিক বাহিনীতে একটি নির্দিষ্ট সময় যুক্ত থাকা বাধ্যতামূলক।
তবে পুতিনের সর্বোচ্চ চেষ্টা সত্ত্বেও সামরিক ব্যয়ে এখনও যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে রাশিয়া। ব্যয়ের দিক থেকে দেশটি বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে।
রাশিয়ার হাইব্রিড যুদ্ধসক্ষমতা
আধুনিক যুগে শুধু অস্ত্র ও গোলাবারুদে যুদ্ধ জয় সম্ভব নয়। চাই সাইবার আক্রমণ ও গুপ্তচরবৃত্তির বিষদাঁত। রাশিয়া সেদিক থেকে বেশ এগিয়ে। রুশ হ্যাকারগোষ্ঠী এরমধ্যেই পশ্চিমা দুনিয়ার বিভিন্ন কূটনৈতিক, আর্থিক ব্যবস্থা ও সামরিক গবেষণাগারে সফলভাবে হামলা চালিয়েছে। এমনকি সামাজিক মাধ্যমে যুক্ত হয়ে মার্কিন নির্বাচনকেও প্রভাবিত করে তারা।
অস্ত্র তৈরির চেয়েও জটিল সাইবার হামলার সক্ষমতা তৈরি। সেদিক থেকে এগিয়ে গিয়ে রাশিয়া যে আধুনিক যুগের যুদ্ধের জন্যও প্রস্তুত সেই ইঙ্গিতই দিয়েছে।
এব্যাপারে আজারবাইজানে নিযুক্ত সাবেক একজন মার্কিন কূটনীতিক ম্যাথু ব্রাইজা বলেন, "রাশিয়া ন্যাটোর বিরুদ্ধে সর্বদা হাইব্রিড যুদ্ধের মধ্যে রয়েছে। এর অর্থ, তারা শুধু বাস্তবিক সেনাশক্তিই মোতায়েন করছে তা নয় বরং সাইকোলজিক্যাল, মাল্টিমিডিয়া, সামাজিক মাধ্যম ও অর্থনৈতিক সব ধরনের অপারেশন চালিয়ে শত্রুকে দুর্বল করার চেষ্টা চালাচ্ছে।"
সূত্র: টিআরটি ওয়ার্ল্ড