পুতিনের ওপর নিষেধাজ্ঞা কেন কাজে আসবে না?
রোনাল্ড রিগ্যানের ভাষায় বললে আবারও একই পথে হাঁটছে আমেরিকা। ভ্লাদিমির পুতিন সৈন্য সরিয়ে না নিলেও ইউক্রেনে সামনে আর হামলা চালাবে না- এমন আশায় রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ মিত্রদেশগুলো।
তাদের উদ্দেশ্য সফল হোক সেই কামনাই করি। প্রতিপক্ষকে দমাতে ওয়াশিংটনের অন্যতম প্রিয় কাজ হলো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। বর্তমানে ইরান, ভেনেজুয়েলা, কিউবা, উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া ছাড়াও প্রায় ১৫টি রাষ্ট্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস ট্রেজারি বা অর্থ দপ্তরের তথ্যানুসারে, ৯/১১ হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা, বৈদেশিক নীতি ও অর্থনীতির জন্য কেউ হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ালে নিষেধাজ্ঞা আরোপ হলো 'প্রথম হাতিয়ার'। এমনকি প্রত্যাহার করে নেওয়া নিষেধাজ্ঞাগুলো বাদ দিয়েও ২০২১ সালের শেষ নাগাদ দুই দশকে বিভিন্ন দেশ, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার সংখ্যা ১০ গুণ বেড়ে ৯,৪২১টিতে এসে দাঁড়িয়েছে।
আমেরিকা কেন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পছন্দ করে তা বোঝা কঠিন নয়। তারা এমন সব বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে যেগুলো নিয়ে তাদের তাৎক্ষণিক দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। যেমন, রাশিয়ার ইউক্রেনে আক্রমণ কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের হস্তক্ষেপ। আমেরিকার নীতি-নির্ধারকদের মতে বৈশ্বিক শৃঙ্খলা রক্ষা তাদের দায়িত্ব। দেশটির জনগণ অবশ্য এ বিষয়ে একমত নয়। যুদ্ধে যেতে আগ্রহী নয় তারা। মার্কিনিদের ইতোমধ্যে এসব যুদ্ধে অসংখ্য জীবন হারাতে হয়েছে। তার চেয়েও বেশি হারাতে হয়েছে সামরিক বাজেটের পিছে ব্যয় করা অর্থ। আর তাই যুদ্ধের চেয়ে বর্তমানে নিষেধাজ্ঞা আরোপই উৎকৃষ্ট হাতিয়ার।
নিষেধাজ্ঞা আরোপের এই প্রবণতার পিছে আরেকটি কারণ হলো বৈশ্বিক অর্থনীতির ডলার নির্ভরতা। একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রই ডলারের কারণে কার্যকরভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। ভিন্ন দুই দেশের লেনদেন কিংবা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ডলার ও আমেরিকান ব্যাংকগুলোকে বিনিময় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার না করার নজির কম।
সত্যি বলতে, নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে আমেরিকা এক ধরনের একক কর্তৃত্ব ভোগ করে।
কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে নিষেধাজ্ঞা আরোপে আসলেই কোনো কাজ হয়।
একথা সত্যি যে, নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে দেশগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। কিন্তু তারপরও অনেক দেশই যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত মেনে নেয় না। উত্তর কোরিয়া, ইরান কিংবা ভেনেজুয়েলার মতো একরোখা দেশগুলো এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
ট্রাম্প পরমাণু চুক্তি প্রত্যাহারের পর ২০১৮ সালে ইরানের ওপর আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। এই নিষেধাজ্ঞার পর ইরানি মুদ্রার মূল্য অর্ধেকের বেশি কমেছে। বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার ৩৫ শতাংশের বেশি। দাপ্তরিক তথ্যানুসারে, ২০১৭ সালে ইরানের দৈনিক ২৫ লাখ ব্যারেল তেল রপ্তানি ২০২০ সালে ছয় লাখ ব্যারেলের নিচে নেমেছে। তবে গত বছর থেকে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটাই সামলে উঠছে ইরান।
পশ্চিমা আরোপিত নিষেধাজ্ঞার ভুক্তভোগী রাশিয়াও। ২০১৪ সালে রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। জ্বালানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত না হলেও পশ্চিমা দেশগুলো থেকে রাশিয়ার সরকার ও ব্যাংকগুলোর ঋণ গ্রহণের পথ বন্ধ হয়। একটি পরিসংখ্যান অনুসারে, ৪৭৯ বিলিয়ন ডলার ঋণ রাশিয়ার হাতছাড়া হয়, যা মোট জিডিপির এক-তৃতীয়াংশ। বিনিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় রাশিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রবৃদ্ধির পথ বন্ধ হয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। তবে এক্ষেত্রে তেলের মূল্য হ্রাস পাওয়ার বিষয়টিও ভূমিকা রেখেছিল।
নিষেধাজ্ঞায় অভ্যস্ত হয়ে পড়া
নিষেধাজ্ঞা আরোপের মূল সমস্যা হলো, এগুলো কখনোই ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ওপর আরোপ করা হয় না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নেতাদের জনগণের জীবনযাত্রার মান এবং ভোক্তা স্বাচ্ছন্দ্যের কথা মাথায় রাখতে হয়। কিন্তু ইরানের শীর্ষ নেতা কিংবা উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত হয় না। আর তাই তাদের পরবর্তী নির্বাচনের জন্য জনগণের সন্তুষ্টি অর্জনের চিন্তা করারও দরকার পড়ে না।
এছাড়া ইরানে খামেনি ও ইসলামি রেভুল্যুশনারি গার্ড কর্পস এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই টিকে থাকা শিখে গেছে। এমনকি তারা বিষয়টি উপভোগও করছে। বিদেশি কোনো প্রতিযোগী ছাড়াই আইআরজিসি একাই ইরানী বাজার দখল করে রেখেছে।
খামেনি একে প্রতিরোধের অর্থনীতি বলেছেন। পশ্চিমা পুঁজিবাদের ক্ষতিকর প্রভাবকে দূরে রাখায় তিনি বিষয়টিকে আত্মত্যাগী দেশপ্রেম হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তবে সাধারণ ইরানীরা যে এতে সন্তুষ্ট নয় তা প্রায়ই তীব্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়।
পুতিনও রাশিয়ার সঙ্গে একই আচরণ করছেন। রাশিয়ানরা কীভাবে ভুগবে তা নিয়ে পুতিনের তেমন মাথাব্যথা নেই। রাশিয়ানদের সামনে কী আসতে চলেছে তার আন্দাজ পুতিন আগেই করতে পেরেছিলেন। সে কথা মাথায় রেখেই শুক্রবার তিনি বলেন, "এই সংকট (নিষেধাজ্ঞার চাপ) থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো নিজেদের অভ্যন্তরীণ শক্তি, বিশেষ করে অর্থনীতিকে সুসংহত করা।
পুতিন স্রেফ দেশপ্রেম থেকে আত্মত্যাগের চর্চা করছেন না। ২০১৪ সাল থেকেই মস্কো নিজেদের নিষেধাজ্ঞা উপযোগী করে গড়ে তুলেছে। লন্ডনভিত্তিক অর্থনীতি বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের তথ্যানুসারে, রাশিয়া স্বল্পমেয়াদী বৈদেশিক ঋণ কমানোর পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি করেছে। একইসঙ্গে বিশ্বের উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর সঙ্গেও সম্পর্কে লাগাম টেনেছে।
পুতিনের সৃষ্টি করা এই সংকটের কারণে তেলের দাম বৃদ্ধি পেলেও, নতুন নিষেধাজ্ঞার অর্থ রাশিয়াকে আরও বেশ কয়েক বছর ধীর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্মুখীন হতে হবে। ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের পূর্বাভাস অনুসারে, নিষেধাজ্ঞার ফলে রাশিয়ার জিডিপির সর্বোচ্চ ১ শতাংশ হ্রাস পাবে। তবে রাশিয়ার কেউ যদি বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামায়ও, তাও কি কোনো আন্দোলনের সুত্রপাত হতে পারে? সেই সম্ভাবনা কম।
এই বিষয়ে কথা বলতে গেলে ইসরায়েলের প্রসঙ্গও আসে। ফিলিস্তিনের বিডিএস আন্দোলন এরকম কিছু আশা করলেও এখন পর্যন্ত এই আন্দোলন ক্যাম্পাস-কেন্দ্রিক। কোনো রাষ্ট্রীয় (বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র সরকার) সমর্থন না পাওয়া অবধি এই বয়কট কোনো ফল বয়ে আনবে না।
ইসরায়েলের ওপর বাস্তবিক কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হবে, এমন কিছু কল্পনা করা কঠিন। ধরা যাক, ধর্মভিত্তিক-ডানপন্থী সরকারের প্রধান হিসেবে নেতানিয়াহু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিরে এসে পশ্চিম তীর দখলে নিলেন। সেক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্র কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে তেমন সম্ভাবনা কম। তবে ইউরোপের জন্য কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেওয়া এতটা কঠিন হবে না। ইউরোপের মাঝারি কোনো নিষেধাজ্ঞাও ইসরায়েলের জন্য বড় ধরনের বিপদ তৈরি করবে।
- হারেৎজ থেকে অনূদিত