ইরান যেভাবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সুবিধা পাচ্ছে
জ্বালানির আন্তর্জাতিক বাজারে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ছায়া। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া থেকে তেল সরবরাহ বন্ধ হবে এই ভীতি ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে নিয়ে গেছে অপরিশোধিত তেলের মূল্য। চলতি মাসে ব্রেন্ট ক্রুড ২০০ ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার আভাসও দিয়েছেন অনেকে।
রাশিয়ার তেল-গ্যাস রপ্তানি থমকে গেলে বাজারে যে বিশাল শূন্যতা তৈরি হবে তা অপূরণীয়। কিছুটা সরবরাহ অন্য উৎস থেকে দরকার হবেই। দীর্ঘদিন ধরে ইরানের তেল-গ্যাস রপ্তানি সীমিত, যুদ্ধের কারণে তেল রপ্তানিতে পশ্চিমারা কিছুটা ছাড় দেবে বলে আশা করছে তেহরান।
তাছাড়া, ইউরোপে যুদ্ধ বাধলে জ্বালানি পণ্যের দাম চরম পর্যায়ে বাড়বে বিশ্লেষকদের এমন ধারণাও সত্যি প্রমাণিত হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক রেটিংস সংস্থা-ফিচ জানিয়েছে, ইউক্রেনে সশস্ত্র সংঘাতের কারণে রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার জেরে রাশিয়ার রপ্তানি করা তেলের মূল্য ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার পার করবে। এমন পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক পর্যায়ে জ্বালানি সংকট সৃষ্টির সতর্কবাণী দিয়েছে ফিচ।
গবেষণা সংস্থাটির জ্বালানি শাখার বিশেষজ্ঞদের মতে, জ্বালানির বিশ্ববাজার এখন ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান সৃষ্ট ঝুঁকি এবং ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য পরমাণু চুক্তি—এ দুয়ের আশা-নিরাশায় দুলছে। যুক্তরাষ্ট্র চুক্তিতে ফিরলে ইরানের জ্বালানির রপ্তানিতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা শিথিল হবে- তাতে মূল্য কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আসবে, ওয়াশিংটনের মিত্র পশ্চিম ইউরোপও কিছুটা চাপ মুক্ত হবে।
ভিয়েনায় আলোচনায় করছেন ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকরা। তাদের মধ্যে একটি চুক্তির সম্ভাবনা জোরালো হয়ে ওঠার কথাও কিছুদিন ধরে সংবাদ শিরোনামে আসছে।
ফিচের জ্বালানি শাখার ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থাপক রিচার্ড ব্রোঞ্জ উল্লেখ করেছেন, ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য দ্বিতীয় পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরের আশাবাদ আপাতত রাশিয়া থেকে রপ্তানি ব্যাহত হওয়ার হুমকিকে সামাল দিচ্ছে। নাহলে মূল্য আরও আকাশছুঁত- একথার মাধ্যমে এমন ইঙ্গিতই দেন তিনি।
ইরানের কাছে বর্তমানে ৮ কোটি ব্যারেল অপরিশোধিত তেল মজুদ আছে বলে সংস্থাটির এনার্জি অ্যাসপেক্ট উল্লেখ করে। এই মজুদের একটি বড় অংশ আবার ইরানি তেলের ক্রেতা দেশগুলোর উপকূলের জলসীমায় ট্যাংকার জাহাজে রাখা আছে, যাতে সেগুলো অত্যন্ত দ্রুত বিক্রি করা যায়।
তার ওপর পরমাণু চুক্তি হলে তেহরান স্থানীয়ভাবে তেলের উৎপাদন দৈনিক ১২ লাখ ব্যারেলে উন্নীত করতে পারবে, যাতে অনেকটা স্তিমিত হবে বিশ্ববাজারে মূল্যের ঊর্ধ্বগতি।
এতে শুধু নিষেধাজ্ঞা জর্জরিত ইসলামী প্রজাতন্ত্রটির অর্থনীতি নয়, বরং সস্তা জ্বালানি নিশ্চিতের চেষ্টারত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পাবে।
উচ্ছ্বাস গোপন-ই রাখছেন ইরানি কর্মকর্তারা:
রাশিয়া-ইরান সম্পর্কের বন্ধন সাম্প্রতিক সময়ে দৃঢ় হচ্ছে। তবে কৃষ্ণসাগর অঞ্চলের প্রতিবেশী ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার আগ্রাসনের ফলাফল সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখেন ইরানি কর্মকর্তারা। এতে নিজস্ব রপ্তানি সুবিধার সুযোগ নিয়ে তারা অবশ্য উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে চান না, মস্কোর সাথে সম্পর্কের অবনতি হওয়ার শঙ্কা থেকেই।
তবে ইরানের অর্থনীতিবিদ সমিতির এক সদস্য বলেছেন, "ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যেকার যুদ্ধের ফলাফল দীর্ঘদিন পর্যন্ত জ্বালানির বিশ্ববাজারে ছায়া ফেলবে। আমাদের দেশের আছে বিপুল পেট্রোলিয়াম সম্পদ, ভালো দাম থাকায় রপ্তানি বাড়ানো গেলে তা আমাদের অর্থনীতির জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠবে।"
ইরানের সরকারি কর্মকর্তারা অবশ্য সতর্ক, সংযত। বিশেষ কিছুই হয়নি- এমনটাই তারা দেখাতে চাইছেন। বরং ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।
যেমন ইরানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র কর্মকর্তা সৈয়দ খতিবজাদেহ সম্প্রতি বলেছেন, "যুক্তরাষ্ট্র ও তার ন্যাটো মিত্রদের উস্কানিমূলক হস্তক্ষেপের কারণেই ইউক্রেন পরিস্থিতি এখন জটিল আকার ধারণ করেছে। তেহরান পরিস্থিতির ওপর ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখছে।"
এই মন্তব্যের এক সপ্তাহ আগে ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রি কুলেবার সাথে এক ফোনালাপে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আব্দুল্লাহিয়ান রাশিয়ার সাথে দেশটির সংঘাত 'শান্তিপূর্ণ উপায়ে নিষ্পত্তি'র জন্য সহায়তার প্রস্তাব দেন।
আব্দুল্লাহিয়ান বলেছিলেন, "আমরা এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা অটুট রাখতে চাই।"
ইরানের সাথে বাইডেন প্রশাসনের সহযোগিতার সম্ভাব্যতা:
এদিকে ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তির আলোচনায় রুশ প্রতিনিধিদলের সদস্য এবং ভিয়েনায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোয় মস্কোর প্রধান দূত মিখাইল উলায়েনভ আশ্বস্ত করে বলেছেন, তার দেশের ইউক্রেন অভিযানের কোনো নেতিবাচক প্রভাব পরমাণু চুক্তির আলোচনায় পড়বে না।
তিনি বলেন, "ভিয়েনা আলোচনার জটিলতা এবং ডনবাস অঞ্চলের সংকট আন্তর্জাতিক এজেন্ডায় একে-অপরের বিরোধী অবস্থানে নেই। ভিয়েনা আলোচনা স্বাভাবিক গতিতেই চলছে। এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার রাশিয়া। আলোচনা সমাপ্তির দিকেই এগিয়ে চলেছে।"
তবে আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতা ইরানের পরমাণু আলোচনায় নতুন গতি যোগ করেছে নিঃসন্দেহে। ইরানি কূটনীতিকরাও এতে দর কষাকষির নতুন শক্তি পেয়েছেন। ওয়াশিংটনও ইরানের রপ্তানির গুরুত্বকে অনুভব করছে।
পরামর্শক ফার্ম স্ক্যারাব রাইজিং- এর সিইও ইরিনা জাকারবার্গ লিখেছেন, "ঠিক একারণেই রাশিয়া যখন পূর্ব ইউরোপের দুটি বিচ্ছিন্নতাকামী অঞ্চলকে স্বাধীন দেশের স্বীকৃতি দিল—তখন আমরা ইরানের পরমাণু চুক্তির আলোচনা চুক্তি সইয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানোর সংবাদ শুনেছি।"
প্রেসিডেন্ট বাইডেনও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি মোকাবিলায় সস্তায় ইরানি তেল কেনা ভালো বিকল্প হতে পারে বলে উল্লেখ করেছেন। তারপর থেকেই গণমাধ্যমে পরমাণু চুক্তি নিয়ে আশাবাদের কথা জানানো হচ্ছে।
ইরিনা মনে করেন, "রাশিয়ার বিশ্ববাজারকে অস্থিতিশীল করাকে অসাধু উপায়ে কাজে লাগিয়ে ওয়াশিংটনও ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তিকে বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে, ইরানের ক্ষমতাসীনদের তুষ্ট রাখার পুরোনো নীতিতে ফিরছে। যুক্তরাষ্ট্র চায় কম দরে ইরানি তেলের যোগান। তাই আকর্ষনীয় জ্বালানি চুক্তি এবং ইরানিদের সহযোগিতার বিনিময়ে ইউক্রেনের স্বার্থ জলাঞ্জলিও দিতে পারে ওয়াশিংটন।"
তবে আরও সহজে পুরো ব্যাপারটি ঘটতে পারে। এমনটাই মনে করেন বিসিএস ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্টের রাশিয়ান বিনিয়োগ কৌশলবিদ আলেক্সান্ডার বাখতিন। তিনি জানান, পরমাণু চুক্তি ছাড়াই বাইডেন প্রশাসন তেহরানের তেল রপ্তানির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার বা শিথিল করতে পারে।
বাখতিনের মতে, "জোসেফ বাইডেন জানেন, তেল মার্কিন অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। আবার গাড়ির জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিও আমেরিকান জনতা ভালোভাবে নেয় না। দেশটির জীবাশ্ম জ্বালানি খাতে, বিশেষ করে তেল উত্তোলনে সাম্প্রতিক সময়ে বিনিয়োগ কম হয়েছে। বাইডেন সব ছক কষেই এগোচ্ছেন।"
- সূত্র: টিআরটি ওয়ার্ল্ড