‘নিষেধাজ্ঞা দিতে যুক্তরাষ্ট্রের এত আসক্তি কেন?’
ইউক্রেনে রুশ বাহিনী প্রবেশের পর পরই রাশিয়ার ওপর নজিরবিহীন আর্থিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার বোঝা চাপিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। মঙ্গলবার (৮ মার্চ) প্রেসিডেন্ট বাইডেন রাশিয়া থেকে তেল ও অন্যান্য জ্বালানি পণ্য আমদানি নিষিদ্ধের ঘোষণা দেন।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, রাশিয়ার হামলা ন্যাটোর পূবমুখী বিস্তার বন্ধের কৌশলগত পদক্ষেপ। নিষেধাজ্ঞা মস্কোর সিদ্ধান্ত বদলাতে তো পারবে না; বরং হিতে-বিপরীত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র যেসব দেশকে তার নীতি ও স্বার্থের বিরুদ্ধাচারণ করতে দেখে বা যাদের শত্রুজ্ঞান করে- তাদের শাস্তি দিতে, ভয় দেখিয়ে বাগে আনতে বিধিনিষেধ আরোপের নীতি নেয়। কিন্তু, কেন ওয়াশিংটনের এতে আসক্তি- সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কারণ অবধারিতভাবেই বলা যায়, জ্বালানি তেলের চড়া দর নিশ্চিত করার চেয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ অনেক স্বার্থরক্ষার ভার রয়েছে ওয়াশিংটনের।
স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের পর বিভিন্ন দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা যেসব নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তাতে ভুক্তভোগী দেশগুলোর নীতিতে পরিবর্তন আসেনি। তবুও নিষেধাজ্ঞাকেই নিজেদের প্রাথমিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে মার্কিন সরকার।
বিধিনিষেধ আর অবরোধের উল্টো প্রতিক্রিয়া ওয়াশিংটনের নীতি-নির্ধারকরা ঠিকই বোঝেন, তবুও এটাই তাদের সবচেয়ে সহজে ব্যবহারযোগ্য অর্থনৈতিক অস্ত্র; যা দুনিয়াজুড়ে আমেরিকার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আর্থিক খাতে আধিপত্য ধরে রাখতে ব্যবহৃত হচ্ছে।
আসলে এই অস্ত্রের ব্যবহার বিশ্বব্যবস্থায় এক দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত অভিঘাত সৃষ্টি করছে।
এবিষয়ে নিউইয়র্কের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সহযোগী অধ্যাপক নিকোলাস মুলডার তার বই 'দ্য ইকোনমিক ওয়েপন'- এ লিখেছেন, "আধুনিক যুদ্ধের উপাদান হিসেবে নিষেধাজ্ঞার ব্যবহার বেড়েই চলেছে। অথচ দীর্ঘমেয়াদে মার্কিন সরকার পণ্যবাজার নিয়ন্ত্রণেই সবচেয়ে সফল- সে দাবিও করা যায় না। পণ্যবাণিজ্যের চেয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সংস্থা, নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ, প্রযুক্তিগত এবং আর্থিক কাঠামোতেই ওয়াশিংটনের শক্তি বেশি। এসব সক্ষমতাকেই নীতিনির্ধারকরা রাষ্ট্রীয় নীতির সরঞ্জাম হিসেবে দেখেন।"
রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত যখন প্রকাশ্য রূপ নেয়, সেই ২০১৪ সাল থেকেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে আমেরিকা ও তার মিত্ররা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে চলেছে। প্রথমদিকের নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে ভেঙে ফেলার চেয়ে পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রিত আর্থিক/বাণিজ্য ব্যবস্থায় রাশিয়ার অংশগ্রহণকে অনেকাংশে দুর্বল করার উদ্দেশ্য ছিল। রাশিয়াকে তারা সর্বাধুনিক মানের প্রযুক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন করে, জ্বালানি ও কাঁচামাল রপ্তানির ওপর বেশি নির্ভরশীল হতে বাধ্য করে।
২০১৪ সালের ওই নিষেধাজ্ঞাগুলোই ইউক্রেনে পশ্চিমাদের গোপন লড়াইয়ের সম্মুখভাগ চিহ্নিত করে এবং নিজেদের মধ্যে রাশিয়া বিরোধিতার একটি যৌথ মূল্যবোধ শক্তিশালী করে, যা তাদের নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানানো মস্কোর বিরুদ্ধে কাজে লাগানো যাবে।
ওই বছরের সেপ্টেম্বরে মার্কিন পণ্ডিত জোসেফ নি তার 'অ্যা ওয়েস্টার্ন স্ট্র্যাটেজি ফর অ্যা ডিক্লাইনিং রাশিয়া' শীর্ষক এক নিবন্ধে লিখেছেন, "এক শতাব্দী আগে অস্ট্রো-হাঙ্গেরি ও অটোমান সাম্রাজ্যের পতন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় প্রচণ্ড অরাজকতার জন্ম দিয়েছিল। প্রাচীন রোম বা ১৮ শতকের স্পেনের মতো পরাশক্তির ধারাবাহিক পতনের দিকে এগিয়ে যাওয়াও চরম বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয়। এ বাস্তবতায় সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতি হতে পারে, রাশিয়া যদি তার পতনের খাদ থেকে বেড়িয়ে আসতে পারে এবং আগামী এক দশকের মধ্যে একটি পুনঃউত্থিত, ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি হয়ে উঠতে পারে।"
জ্বালানি রপ্তানি করে রাশিয়া বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারলেও, বৈচিত্র্যপূর্ণ উৎপাদন অর্থনীতির সাহায্য ছাড়া বিশ্ব অর্থনীতিতে রাশিয়ার ওজন কমতেই থাকবে, এবং সে দুর্বল হতেই থাকবে। এর অভিঘাত হবে সুদূরপ্রসারী।
অনেক মার্কিন বিশেষজ্ঞ মনে করেন, স্নায়ুযুদ্ধের কালে সোভিয়েত ব্লকের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ফেলা সহজ হয়েছে। সেই প্রক্রিয়াতে তৈরি হয় আর্থিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থা। যে ব্যবস্থায় বাইরের কোনো দেশ যোগ দিতে চাইলে- তাকে পশ্চিমাদের তৈরি নিয়মনীতি মেনেই তা করতে হবে। এভাবে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য আরও শক্তিশালী হতে থাকে।
আর্থিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য আসলে একটি নেতৃত্বমূলক শক্তি, যা সামরিক নেতৃত্বের মতোই বলশালী; যার সাহায্যে এবার রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৬৩০ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক রিজার্ভের একটি বিশাল অংশ ফ্রিজ করেছে আমেরিকা ও তার মিত্ররা।
নিষেধাজ্ঞার আরেক উদ্দেশ্য লক্ষ্যবস্তু দেশকে বিশ্বায়নের কাতার থেকে বিচ্ছিন্নতায় ঠেলে দেওয়া। ফলে দেশটি বৈশ্বিক অর্থনীতি, আর্থিক খাত ও বাণিজ্য ব্যবস্থার সুবিধা বঞ্চিত হতে থাকে। ধীরে ধীরে বিশ্ব রাজনীতিতে তার অবদান ন্যূনতম হয়ে ওঠে।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে এই আধিপত্যবাদের দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিচার করলে বোঝা যায়, সেগুলোর আঘাতকে যৌক্তিক প্রতিযোগিতা বা অন্য উপায়ে পাশ কাটানো যায় না।
এ বাস্তবতা বর্তমান আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আর্থিক ব্যবস্থার অযৌক্তিক, ভারসাম্যহীন দিকটি স্পষ্ট করে। পশ্চিমা দেশগুলো এভাবে তাদের পুঁজিবাদী শক্তিকে বলিষ্ঠ করার মাধ্যমে নিজস্ব স্বার্থ সংরক্ষণে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে পারছে। এভাবে তারাই তৈরি করছে শ্রেণি-বিভেদ অনুযায়ী বৈশ্বিক উন্নয়নের সংজ্ঞা এবং বিশ্বায়নে বুনে চলেছে বৈরিতার বীজ।
- লেখক: ডিং গ্যাং চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যম পিপলস ডেইলির একজন জ্যেষ্ঠ সম্পাদক। বর্তমানে তিনি রেনমিন বিশ্ববিদ্যালয়ের চংইয়াং ইনস্টিটিউট ফর ফিন্যান্সিয়াল স্টাডিজে সিনিয়র ফেলো হিসেবে যুক্ত আছেন।
- সূত্র: গ্লোবাল টাইমস