পুতিনের দুর্ধর্ষ ভাড়াটে যোদ্ধা- কারা এই মার্সেনারি ওয়াগনার গ্রুপ?
ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান পার করেছে তিন সপ্তাহ। এরপরও উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ও সামরিক লক্ষ্যবস্তু অধরা রয়েছে রুশ বাহিনীর। পশ্চিমাদের অন্তত তেমনই দাবি। তারা আরো বলছে- মস্কো উপলদ্ধি করছে, প্রতিবেশী ইউক্রেনে আগ্রাসন দিনকে দিন দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে।
আর এতে করে, ইউক্রেনে মস্কোর যুদ্ধাভিজ্ঞ ওয়াগনার গ্রুপের মার্সেনারি বা ভাড়াটে যোদ্ধাদের মোতায়েনের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে।
মার্সেনারি সংস্থা অর্থের বিনিময়ে কোনো সংঘাতে একটি পক্ষের হয়ে লড়াই করে। ওয়াগনার গ্রুপ- পিএমসি ওয়াগনার, সিএইচভিকে ওয়াগনার বা ভাগনার নামেও পরিচিত।
পশ্চিমাদের দাবি, মার্সেনারি যোদ্ধাদের এই নেটওয়ার্কটি আসলে প্রেসিডেন্ট পুতিনের 'প্রাইভেট আর্মি'- যাদের সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আফ্রিকার বিভিন্ন সংঘাত অঞ্চলে মস্কো সমর্থিত পক্ষের হয়ে যুদ্ধে অংশ নিতে দেখা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের যেমন বৈদেশিক গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ, রাশিয়ার তেমন সংস্থা জিআরইউ মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি। সামরিক এ গোয়েন্দা সংস্থা বিদেশের মাটিতে গোপন অভিযানের সাথে যুক্ত। ওয়াগনার গ্রুপের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিভিন্ন স্থাপনায়। আর পেছন থেকে গ্রুপটির কার্যক্রমের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয় জিআরইউ। এটিকে তাই জিআরইউ- এর সহযোগী সশস্ত্র সংস্থা বলে দাবি করে পশ্চিমারা।
বিভিন্ন সংঘাতে যেখানে রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ থাকতে পারে, কিন্তু রুশ সামরিক শক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে জড়িত নয়- সেখানে এই মার্সেনারি সংস্থার যোদ্ধাদের পাঠানো হয়েছে। এতে করে, নিজেদের দায় এড়ানোর সুযোগ পায় মস্কো।
কিছু বিশেষজ্ঞ ওয়াগনার গ্রুপকে যুক্তরাষ্ট্রের বহুল সমালোচিত প্রাইভেট সিকিউরিটি ফার্ম ব্ল্যাকওয়াটারের সঙ্গে তুলনা করেন। সাবেক মার্কিন নেভি সিল সদস্য এরিক প্রিন্স ব্ল্যাকওয়াটারের প্রতিষ্ঠাতা। এই সংস্থার যোদ্ধারা ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধে পেন্টাগনের হয়ে লড়েছে। তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে, বিভিন্ন সময়ে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘণের অভিযোগ।
মধ্যপ্রাচ্যের অনেক মানবাধিকার কর্মী বলেছেন, মার্কিন সেনাবাহিনী যেসব জঘন্য কাজের দায় নিজেরা নিতে চায় না, তেমন অনেক নিপীড়ন ও নির্যাতনের কাজ করিয়েছে এসব ভাড়াটে যোদ্ধাদের দিয়ে।
রাশিয়ার ওয়াগনার গ্রুপের যোদ্ধারা এর আগে ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্নতাকামী ও রুশ ভাষাভাষী অধ্যুষিত ডনবাস অঞ্চলে লড়েছে। তারা বিদ্রোহীদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ে এবং তাদের প্রশিক্ষণও দেয়। ইউক্রেন আগ্রাসনের আগে ডনবাসের দুটি স্বঘোষিত প্রজাতন্ত্রকে (দনেৎস্ক ও লুহানস্ক) স্বাধীনতার স্বীকৃতিও দেন পুতিন।
#অভিজ্ঞতার ঝুলি:
সিরিয়া, লিবিয়া, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র ও মালিসহ আফ্রিকার বিভিন্ন গৃহযুদ্ধে মস্কোর স্বার্থঘনিষ্ঠ পক্ষের হয়ে লড়েছে ওয়াগনারের মার্সেনারি বাহিনী। রাশিয়া সমর্থিত সিরিয়া ও মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের সরকার তাদের স্বাগত জানালেও, বিভিন্ন সময়ে এই গ্রুপটির বিরুদ্ধে কিছু এলাকায় যুদ্ধাপরাধ সংগঠনের অভিযোগ উঠেছে।
পাশ্চাত্যের কিছু গণমাধ্যমে এখন এমন সংবাদ আসছে যে, আফ্রিকা থেকে ওয়াগনার গ্রুপের ৪০০ ভাড়াটে যোদ্ধাকে ইউক্রেনে আনা হয়েছে। তাদের মোতায়েন করা হয়েছে কিয়েভ অঞ্চলে। উদ্দেশ্য, ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে হত্যা।
জেলেনস্কিকে পশ্চিমারা অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে। তাকে প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করছে। ইউরোপিয় ইউনিয়ন ও মার্কিন আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশ্যে তিনি ভার্চুয়াল ভাষণও দিয়েছেন। তার আহ্বানে তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দিয়ে বিপুল সামরিক সহায়তাও ইউক্রেনে পাঠিয়েছে পশ্চিমারা।
তাই জেলেনস্কি রাশিয়ার জন্য উপযুক্ত লক্ষ্যবস্তু হতে পারেন। তাকে হত্যা করে একটি চরম বার্তা পাঠানোর সুযোগ পাবে মস্কো।
এদিকে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগেই জানায়, ইউক্রেনের বিদ্রোহী অঞ্চলে আগের মাস জানুয়ারিতে ২,০০০-৪,০০০ হাজার ওয়াগনারের ভাড়াটে যোদ্ধাদের মোতায়েন করা হয়। ইউক্রেনীয় কিছু সমর বিশেষজ্ঞের দাবি, রাজধানী কিয়েভ দখলের উদ্দেশ্যে পরিচালিত রাশিয়ার সামরিক অভিযানে ওয়াগনার গ্রুপের সদস্যরা অংশ নিচ্ছে।
ব্রিটিশ দৈনিক টাইমস অব লন্ডন এক প্রতিবেদনে জানায়, রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হওয়ার পরপরই কিয়েভে ভাড়াটে যোদ্ধাদের উপস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারে ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থা। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে, সঙ্গে সঙ্গেই শহরে জারি করা হয় কারফিউ। যুদ্ধ শুরুর ওই দিনগুলোতে এই ভাড়াটে যোদ্ধাদেরকেই অন্তর্ঘাতমূলক হামলাকারী বলে উল্লেখ করেছিল ইউক্রেন সরকার। এরপর দাবি করা হয়, নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানের মাধ্যমে এসব বিশেষ যোদ্ধাদের নির্মুল করা হয়েছে।
শত্রু নিয়ন্ত্রিত এলাকায় অভিযানের আগে তাদের শক্তিসামর্থ্য, অস্ত্র-সরঞ্জাম, প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে পাঠানো হয় 'অ্যাডভান্স স্কাউট'। তারা শত্রুর গতিবিধি সম্পর্কে যেমন জানায়, তেমনি দিতে পারে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বিমান হামলার সংকেত। শত্রু বাহিনীর দুর্বল জায়গায় বা গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোও তারা ধবংস করতে পারে। ওয়াগনার গ্রুপের সদস্যদের এপর্যন্ত এই অ্যাডভান্স স্কাউটের ভূমিকাতেই বেশি মোতায়েন করেছে ক্রেমলিন।
সমর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু এই ভূমিকার জন্য হলেও ৪ হাজার খুব নগণ্য সংখ্যা। সত্যিকারের সফলতা পেতে হলে, মস্কোকে আরো বড় সংখ্যায় মার্সেনারি মোতায়েন করতেই হবে। আর রণাঙ্গনের বর্তমান পরিস্থিতি ইঙ্গিত দেয়, ক্রেমলিন সংখ্যাবৃদ্ধির সিদ্ধান্তই হয়তো নেবে।
ইউক্রেনীয় সূত্রগুলোর আরো দাবি, যুদ্ধকে সামনে রেখেই রাশিয়ায় ভাড়াটে যোদ্ধাদের ভর্তি বাড়িয়েছে ওয়াগনার গ্রুপ।
ওয়াগনারের প্রধান সদর দপ্তর দক্ষিণ রাশিয়ার রস্টভ অন ডন অঞ্চলে, যা ইউক্রেন সীমান্ত থেকে মাত্র ১২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
মার্সেনারি সংস্থাটির অর্থায়নকারী হিসেবে সন্দেহ করা হয়, পুতিন ঘনিষ্ঠ রুশ ব্যবসায়ী ইয়েভগেনি পিরগোজনিন'কে।
২০২১ সালের জানুয়ারিতে আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে মার্কিন পার্লামেন্ট ক্যাপিটল হিলে অনুপ্রবেশ করে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমর্থকরা। এরপর কট্টরপন্থী বলে পরিচিত পিরগোজনিন সামাজিক মাধ্যমে করা তার এক পোস্টে ক্যাপিটল হিল ও হোয়াইট হাউসে অবসরপ্রাপ্ত রুশ সেনা বিশেষজ্ঞদের পাঠানোর সুপারিশ করেন।
এর আগে ২০১৮ সালে সিরিয়ায় মার্কিন সেনারা ওয়াগনার গ্রুপের কয়েক ডজন যোদ্ধাকে হত্যা করে। ওই ঘটনার তিন বছর পর সুযোগ বুঝে বিদ্রুপ করার সুযোগ নষ্ট করেননি পিরগোজনিন।
আসলে ২০১৮ সালের মে'তে সিরিয়ার দেইর এজ-জৌর প্রদেশে মার্কিন ও সিরিয় বিদ্রোহী বাহিনীর (সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস) একটি ঘাঁটিতে হামলা চালায় সিরিয়ার সেনাবাহিনী ও ওয়াগনার গ্রুপ। ওই সময় কামানের গোলাবর্ষণ, বিমান হামলা, হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে হামলার মাধ্যমে আক্রমণকারীদের সমূলে বিনাশ করে দেয় মার্কিন বাহিনী।
এতে শত্রুপক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার দাবি সেসময় করেছে পেন্টাগন। কিন্তু, লজ্জাজনক এ হারের বিষয়ে তখন মুখে কুলুপ এঁটেছিল রুশ গণমাধ্যম। অথচ, ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর এটিই ছিল মার্কিন সেনাবাহিনীর সাথে রাশিয়ার গোপন কোনো বাহিনীর প্রথম সম্মুখযুদ্ধ।
ওয়াগনার গ্রুপের নাম বদলে পরবর্তীতে রাখা হয়- 'লিগা'। এই নামেই এখন তারা ভাড়াটে সেনাদের ভর্তি, প্রশিক্ষণ দান চালায় এবং গ্রাহকের চাহিদা মাফিক বিভিন্ন সংঘাত অঞ্চলে 'প্রাইভেট আর্মি' সরবরাহ করে থাকে।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ওয়াগনার গ্রুপের ভাড়াটে বাহিনী মোজাম্বিকে পাঠানো হয়। তারা দেশটির ক্যাবো ডেলাগাডো প্রদেশের ইসলামিক বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে দমন করতে মোজাম্বিক সরকারের হয়ে লড়েছে।
২০২০ সালের জুলাইয়ে বেলারুশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ৩৩ জন বিদেশিকে আটক করে। পরে জানানো হয়, তারা ওয়াগনার গ্রুপের সদস্য। মিনস্ক অভিযোগ করে, আগস্টে আসন্ন নির্বাচনের আগে দেশটিতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোকে উৎখাতই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।
তবে রাশিয়া জানায়, এসব ব্যক্তি বেলারুশ হয়ে তুরস্কের ইস্তাম্বুল যাচ্ছিল। অর্থাৎ, তাদের সেখানে অবস্থানের উদ্দেশ্য ছিল না। এরপর নির্বাচনের পর গ্রেপ্তারকৃত সকলকে মুক্তি দেওয়া হয়।
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, লিবিয়ার যুদ্ধবাজ শাসক খলিফা হাফতারের লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির হয়ে লড়তে ১,২০০ যোদ্ধা পাঠিয়েছে ওয়াগনার।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের সফলতা সম্পর্কে সন্দেহ দিন দিন বেড়েই চলেছে। তাই পুতিন প্রাইভেট আর্মিটিকে ব্যবহারে দ্বিধা করবেন বলে মনে হয় না। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধ লড়ে অভিজ্ঞ ও নির্দয় হয়ে ওঠা এই ভাড়াটে যোদ্ধাদের গুরুত্ব নিঃসন্দেহে আরো বাড়তে চলেছে। আগামী দিনগুলোতে তাদের হয়তো গুরুত্বপূর্ণ সব অভিযানের সামনের সাড়িতেই দেখা যাবে।
- লেখক: সার্বিয়ান রাজনৈতিক বিশ্লেষক নিকোলা মিকোভিক। তিনি রাশিয়া, ইউক্রেন ও বেলারুশের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। জ্বালানি ও পাইপলাইন নিয়ে ভূরাজনীতিক বিশ্লেষণকে তিনি বিশেষ প্রাধান্য দেন।
- সূত্র: এশিয়ান টাইমস