সত্যিই কী ঘটেছিল রাশিয়ার গর্বের যুদ্ধজাহাজ মস্কভার কপালে?
বৃহস্পতিবার (১৪ এপ্রিল) রাশিয়ার গাইডেড-মিসাইল বহনকারী ক্রুজার মস্কভা কৃষ্ণ সাগরে ডুবে যায়।
ঠিক কী কারণে এ নিয়তি যুদ্ধজাহাজটির, তা এখনো পরিষ্কার নয়। ইউক্রেন দাবি করেছে তাদের মিসাইলের আঘাতে জাহাজটিতে বিস্ফোরণ ঘটেছে। রাশিয়ার তথ্য অনুযায়ী জাহাজটিতে আগুন লেগে গিয়ে গোলাবারুদ বিস্ফোরিত হয়। পরে বন্দরে নিয়ে যাওয়ার সময়ে ডুবে যায় এটি।
গত ৪০ বছরে এ প্রথম কোনো নৌবাহিনীর এতবড় ফ্ল্যাগশিপ জাহাজ ডুবে গেল। কিন্তু সত্যিই কী ঘটেছিল জাহাজটিতে?
ডুবে যাওয়ার কারণ কী?
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি অনুযায়ী, গোলাবারুদ থেকে সৃষ্ট বিস্ফোরণে মস্কভার কাঠামোগত ক্ষতি হয়েছিল। এরপর বন্দরের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় উত্তাল সাগরে এটি ডুবে যায়।
অন্যদিকে ইউক্রেন দাবি করেছে তাদের নিক্ষেপ করা যুদ্ধজাহাজবিধ্বংসী ক্রুজ মিসাইল থেকে সৃষ্ট আগুনের ফলেই গোলাবারুদের ডিপোতে বিস্ফোরণ ঘটেছে।
এ ঘটনায় পশ্চিমাদের মত কিছুটা ইউক্রেনিয়ানদের দাবির সপক্ষে। 'মোটামুটি আত্মবিশ্বাসের' সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে ইউক্রেনের দাবিই সত্য। এক বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে এমনটা জানিয়েছে সিএনএন।
মস্কভা রাশিয়ার নৌবাহিনীর গর্বের যুদ্ধজাহাজ ছিল। এতে ছিল জাহাজবিধ্বংসী ও বিমানবিধ্বংসী মিসাইল, টর্পেডো, নেভাল গান, ও মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। স্বভাবতই এতসব অস্ত্র চালনার জন্য জাহাজটিতে প্রচুর গোলাবারুদের মজুদ ছিল।
এতবড় যুদ্ধজাহাজ শেষ কবে যুদ্ধে ডুবেছিল?
ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের হাতে একটি ক্রুজার হারায় আর্জেন্টিনা। ১৯৮২ সালের ২ মে ব্রিটিশ নিউক্লিয়ার-সাবমেরিন এইচএমএস কনকুয়েরর টর্পেডো ছুঁড়ে আর্জেন্টিনার ক্রুজার জেনারেল বেলগ্রানোকে ডুবিয়ে দেয়।
জেনারেল বেলগ্রানো আর মস্কভা একই আকৃতির ক্রুজার যুদ্ধজাহাজ। দুটোর দৈর্ঘ্যই প্রায় ৬০০ ফুট (১৮২ মিটার), ও ভর ১২ হাজার টন। তবে মস্কভার ক্রু'র সংখ্যা ৫১০ জন থাকলেও জেনারেল বেলগ্রানোতে মোট ১১০০ নাবিক ছিলেন।
জেনারেল বেলগ্রানোর ৩২৩ জন ক্রু নিহত হয়েছিলেন। তবে মস্কভার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত কারও নিহত হওয়ার তথ্য জানায়নি রাশিয়া।
মস্কভা ডোবায় যুদ্ধে কতটুকু ক্ষতি হলো রাশিয়ার?
এ ঘটনায় আর কিছু ক্ষতি না হলেও রাশিয়ানদের মনোবলে কিছুটা হলেও ঘাটতি তৈরি হবে। কৃষ্ণ সাগরে রাশিয়ান নৌবাহিনীর ফ্ল্যাগশিপ হাজার ছিল মস্কভা। ইউক্রেন যুদ্ধে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছিল জাহাজটি। হঠাৎ করে এটি হারানোয় তা রাশিয়ানদের জন্য এ যুদ্ধে একটি শূন্যতা হিসেবেই দেখা দেবে।
ইউক্রেনের শিকার হোক বা স্রেফ দুর্ঘটনার কবলে পড়ুক; এ জাহাজডুবির ফলে এখন রাশিয়ার যুদ্ধক্ষমতা নিয়েও সন্দেহ দেখা দিতে পারে অনেকের মনে।
যদি ইউক্রেনের মিসাইল সত্যিই জাহাজটিতে আঘাত করে, তার মানে দাঁড়াবে রাশিয়ার আকাশ-প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। আর দুর্ঘটনায় ডুবলে তার অর্থ রাশিয়ার এই জাহাজের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও ড্যামেজ-কন্ট্রোল ব্যবস্থা খুবই অপ্রতুল ছিল।
তবে ইউক্রেন যুদ্ধে এ জাহাজ হারানোর প্রভাব কী হতে পারে তা নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত বিশ্লেষকেরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থিংক ট্যাংক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার-এর বিশ্লেষকেরা এ ঘটনাকে রাশিয়ার জন্য ছোট আঘাত বলে মনে করছেন।
তাদের মতে, এ জাহাজটি থেকে মূলত ইউক্রেনের লজিস্টিকস সেন্টার ও এয়ারফিল্ডগুলোতে ক্রুজ মিসাইল নিক্ষেপ করা হতো। সেই একই কাজ রাশিয়া এখনো ভূমি থেকে ও আকাশপথে করতে পারবে।
তবে তারা আরও মনে করেন, যদি এটি সত্যিই ইউক্রেনের হামলা হয়ে থাকে, তবে রাশিয়ান নৌবাহিনীকে এর অপারেশন নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
পেন্টাগনের মুখপাত্র জন কার্বি জানিয়েছেন, মস্কভার মূল মিশন ছিল কৃষ্ণ সাগরে থাকা রাশিয়ান বাহিনীর জন্য এয়ার-ডিফেন্স প্রদান করা। কার্বি বলেন, এ জাহাজডুবির ফলে রাশিয়ান এয়ার-ডিফেন্স সক্ষমতার ওপর প্রভাব পড়বে।
চীনের জন্য একটি শিক্ষা?
মস্কভার ঘটনাকে গুরুত্বপূর্ণভাবে দেখবে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো, বিশেষত যদি নিশ্চিত হওয়া যায় ইউক্রেনের মিসাইলের আঘাতে জাহাজটি ডুবে গেছে।
নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, মস্কভা'র ঘটনা থেকে চীন-তাইওয়ান দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে কোনো ইনসাইট পাওয়া যায় কিনা তা দেখার চেষ্টা করবেন বিশেষজ্ঞরা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি প্রখ্যাত থিংক ট্যাংক র্যান্ড কর্পোরেশন-এর জ্যেষ্ঠ আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা গবেষক টিমোথি হিথ বলেন, মস্কভার ঘটনা চীন ও যুক্তরাষ্ট্রকে দেখিয়ে দিয়েছে 'পানির ওপরে থাকা যুদ্ধজাহাজ' কতটা অরক্ষিত অবস্থায় থাকতে পারে।
হিথ বলেন, এরকম দৃশ্যপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার যুদ্ধজাহাজগুলোকে চীনের জাহাজবিধ্বংসী মিসাইল থেকে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করবে।
অন্যদিকে তাইওয়ানের কাছেও ইউক্রেনের মতো অ্যান্টি-শিপ মিসাইল রয়েছে। সে কথাটিই এখন থেকে আরও গুরুত্বের সাথে মাথায় রাখবে চীন, বলে মন্তব্য করেন হিথ ও অন্যরা। হিথ আরও বলেন, একই কারণে তাইওয়ানের ওপর চীনের কোনো সম্ভাব্য আক্রমণ হবে চরম ঝুঁকির বিষয়।
তবে এ দৃষ্টিভঙ্গিরও সাথে মতবিরোধ জানিয়েছেন অন্য বিশেষজ্ঞরা। মার্কিন নৌবাহিনীর সাবেক একজন সাবমেরিন কমান্ডার ও বর্তমানে সেন্টার ফর আ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটি'র বিশেষজ্ঞ টমাস শুগার্ট বলছেন, দুই দৃশ্যপটে অনেককিছুর পার্থক্য রয়েছে।
শুগার্ট বলেন, মস্কভার কাছে যে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল, তার চেয়ে ঢের উন্নত এগিস কমব্যাট সিস্টেম নামের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে মার্কিন নৌবাহিনীর ডেস্ট্রয়ার জাহাজগুলোতে।
আর ইউক্রেনের অ্যান্টি-শিপ মিসাইলগুলোর চেয়ে চীনের অ্যান্টি-শিপ মিসাইলগুলো অনেক বেশি উন্নত বলেও মন্তব্য করেন শুগার্ট। মস্কভার মতো সোভিয়েত যুগের যুদ্ধজাহাজগুলো সাধারণত এগুলোর আক্রমণের ক্ষমতার জন্য বেশি পরিচিত, প্রতিরক্ষা-ক্ষমতার জন্য নয় বলে জানান এ ভেটেরান কমান্ডার।
সূত্র: সিএনএন