শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক ট্র্যাজেডি ভারতের জন্য সুবর্ণ সুযোগ!
বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। তার ভাই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে কার্যত জনবিচ্ছিন্ন এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সুরক্ষার পেছনে অবরুদ্ধ। অর্থনৈতিক সংকটে আপামর লংকানদের দূরাবস্থা বর্ণনাতীত। শ্রীলঙ্কায় আজ সকলেই কিছু না কিছু হারিয়েছে।
দেশটির এ দুর্যোগে একমাত্র লাভবান- প্রতিবেশী ভারত।
জ্বালানি, ওষুধ ও খাদ্যপণ্য পেতে এখন দিনকে দিন নয়াদিল্লির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে কলম্বোর। এরমধ্যেই ভারতের থেকে ঋণ গ্রহণ ও মুদ্রা বিনিময়সহ ৩০০ কোটি ডলারের বেশি সহায়তা নিতে হয়েছে লংকান সরকারকে। এ ছাড়া, এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের মাধ্যমে দেশটির কাছে প্রাপ্য অন্তত ২০০ কোটি ডলার এই মুহূর্তে দাবিও করছে না নয়াদিল্লি।
রাজাপাকসে ভাইদের শাসনে এতদিন শ্রীলঙ্কা ছিল অনেকটাই চীন-ঘেঁষা। ভারত ধৈর্য ধরে এতদিন সুচতুর কৌশলে এগিয়েছে, আর সংকট দেখা দেওয়া মাত্রই এতদিনে যেন বাগে পেয়েছে দেশটিকে। এতে কলম্বোর সাথে ভারতের দর কষাকষির ক্ষমতাও অনেকগুণ বেড়েছে। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার হয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে একটি জরুরি অর্থায়ন সহায়তাও চেয়েছে ভারত। ভূরাজনীতির পর্যবেক্ষকরা যাকে খুবই বিরল এক পদক্ষেপ বলে মতপ্রকাশ করেছেন।
তবে একটি বিষয় সুস্পষ্ট। ভারত দীর্ঘদিন ধরে যে চেষ্টা চালিয়েছে এবার তারই ফল পেতে শুরু করেছে। কারণ প্রতিবেশী দেশের বিপদে এমনি এমনি পাশে দাঁড়ায়নি ভারত, সুযোগ-সুবিধাও ঠিকই আদায় করে নিচ্ছে।
সংকটের সুযোগে কলম্বোর সাথে যেসব চুক্তি বাগিয়ে নিয়েছে ভারত
শ্রীলঙ্কার একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদ ত্রিনকোমালি ওয়েল ট্যাংক ফার্ম। এটির মালিকানা ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশনের সাথে ভাগাভাগিতে সম্মতি দিয়েছে লংকান সরকার। এর আগে কয়েক দশক চেষ্টা করেও এমন লাভজনক চুক্তি করতে পারেনি ভারত।
ভারতের জাতীয় তাপবিদ্যুৎ কর্পোরেশন শ্রীলঙ্কার সামপুরে একটি ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে চলেছে। ত্রিনকোমালি বন্দরের কৌশলগত অংশেই এটি নির্মিত হবে। এই অবকাঠামো বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ বন্দরে ভারতের অধিকার আরও পাকাপোক্ত করবে।
গত বছর কলম্বো বন্দরে একটি টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার লাইসেন্স পেয়েছে ভারতের আদানি শিল্পগোষ্ঠী। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম কলম্বো বন্দর কমপ্লেক্সে এটিই হবে প্রথম ভারতীয় মালিকানাধীন ও পরিচালিত টার্মিনাল।
ভারতের চাপের কারণেই চীনা একটি কোম্পানিকে দেওয়া মাইক্রো-ইলেক্ট্রিসিটি গ্রিড নির্মাণের লাইসেন্স বাতিল করেছে শ্রীলঙ্কা। বলাইবাহুল্য, এতে চীন প্রচণ্ড ক্ষুদ্ধ হয়।
তারপরও সে সিদ্ধান্ত থেকে না সরে আসা কলম্বোর নির্ভরশীলতা ভারতের দিকে ঝুঁকে পড়ারই ইঙ্গিত দেয়।
এরমধ্যেই ঘটেছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ভারত ও শ্রীলঙ্কা যৌথ মেরিটাইম রেসকিউ কো-অর্ডিনেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সমুদ্রে উদ্ধার কাজে ভারতের সাথে এই সম্পৃক্ততা শ্রীলঙ্কার সমুদ্রসীমায় ঘটা যেকোনো দুর্ঘটনা মোকাবিলায় শ্রীলঙ্কার সামর্থ্য বাড়াবে। তবে একইসাথে, এর ফলে দুই দেশের নৌবাহিনীর মধ্যে সম্পর্কের উষ্ণতা বাড়াবে। জোরদার হতে পারে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা। অর্থাৎ, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এখন শ্রীলঙ্কাকে পাশে পাচ্ছে দিল্লি।
শ্রীলঙ্কার প্রতিটি বড় বন্দর ও পোতাশ্রয়ে মেরিটাইম রেসকিউ কো-অর্ডিনেশন সেন্টারের শাখা থাকবে। চীনের বিপুল বিনিয়োগে নির্মাণ হলেও এ তালিকা থেকে বাদ পড়বে না হাম্বানটোটা বন্দর।
ভারত কি শ্রীলঙ্কার মিত্র!
পরিস্থিতি ভারতের অনুকূলে এসেছে যেন রাতারাতি। কয়েক বছর আগেও চীনের কাছে শ্রীলঙ্কাকে প্রায় হারাতেই বসেছিল ভারত। চীন হয়ে উঠেছিল কলম্বোর প্রধান কৌশলগত অংশীদার। সাম্প্রতিক সময়ের আগেও, শ্রীলঙ্কার বেশিরভাগ বৈদেশিক বিনিয়োগ, ঋণ ও উচ্চাভিলাষী প্রকল্পগুলোয় দক্ষতা সরবরাহ করেছে বেইজিং।
কলম্বো ও হাম্বানটোটাসহ শ্রীলঙ্কার প্রধান প্রধান বন্দর উন্নয়ন, নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনায় বিপুল অঙ্কের চুক্তি করে চীনা কোম্পানিগুলো। উভয় দেশের বন্ধুত্ব গভীরতর হতে থাকে, যা ভারতের জন্য হয়ে ওঠে কৌশলগত হুমকি।
শ্রীলঙ্কার বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের পেছনে চীন থেকে নেওয়া ঋণের দায় সামান্যই। এ বিষয়ে যে প্রচারণা পশ্চিমা দুনিয়া ও ভারত করে- তা প্রকৃত সত্য তুলে ধরে না। তবে বড় পরিসরে ঋণ দিয়ে একটি ব্যর্থ সরকারকে চীন সমর্থন দেওয়ার দায়ও এড়াতে পারে না চীন। তাছাড়া, ঋণের বোঝা শ্রীলঙ্কার আর্থিক অবনতির একটি অনুঘটকও ছিল।
শ্রীলঙ্কা সংকটে পড়লে এক পর্যায়ে চীন তার ঋণ পরিশোধ মওকুফ/স্থগিত রাখার বিষয়েও আগ্রহ দেখিয়েছিল। কিন্তু, এরপর আর কোনো নতুন ঋণ বা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সহযোগিতা আর দেয়নি।
এশিয়ার বড় দাতা চীন ও জাপানের কাছ থেকে সহায়তার পাওয়ার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়লে, শ্রীলঙ্কার সামনে শুধু ভারতের কাছে ধর্না দেওয়াই বাকি ছিল। বড় অর্থনীতির দেশ হিসেবে ভারত হয়ে ওঠে কলম্বোর 'হাতের পাঁচ' একমাত্র মিত্র। কারণ, ততোদিনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের দ্বারস্থ হতেও অনেক দেরি হয়ে যায় শ্রীলঙ্কার।
প্রতিবেশী দেশে দারিদ্র্য ও অনাহারের তাণ্ডব আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে- একথা নয়াদিল্লির জন্য উদ্বেগের অবশ্যই। কিন্তু, আসলে সহায়তা করা হয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সুবিধা আদায় করতেই। সেই সুবাদে শ্রীলঙ্কার নানান বিষয়ে ছড়ি ঘোড়ানোর সুযোগ ভারত কখনোই হাতছাড়া করতেও রাজি নয়।
ভারতের সম্পৃক্ততা কেন বড় ধরনের বিরোধীতার মুখে পড়েনি
রাজাপাকসে পরিবারই ছিল চীনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। সে তুলনায় শ্রীলঙ্কার বিরোধী দলগুলোর সাথে নয়াদিল্লির যোগাযোগ বেশ ভালো। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া এখনও দেশ নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাই ভারত সহায়তার নামে গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ-সুবিধা নিলেও দুই শিবির থেকেই কোনো বিরোধীতার গুঞ্জন ওঠেনি। প্রতিবাদ করেনি লংকান কূটনৈতিক ও পররাষ্ট্র বিশেষজ্ঞ মহল। দুর্দশা তাড়িত জনগণেরও এসব বিষয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। খাদ্য, ওষুধসহ নিত্যপণ্যের চরম অভাবের সময়ে তারা যেকোনো ভাবে যেকোনো দেশ থেকে জরুরি সহায়তা পেতে চায়।
এমন পরিস্থিতি নাহলে বা সুদিনের সময়ে বড় প্রতিবেশী ভারতের যেকোনো পদক্ষেপ নিয়ে বরাবরই শঙ্কিত থাকতো দ্বীপরাষ্ট্রটি।
শ্রীলঙ্কার অর্থমন্ত্রীর সাবেক উপদেষ্টা ড্যানিয়েল আলফান্সোর কথাতেই পরিবর্তনের স্পষ্ট প্রতিধবনি মেলে।
"শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রীয় নীতিতে অনেক ব্যর্থতা ছিল। অভ্যন্তরীণ নীতিতে ব্যর্থতার দায় চাপানো হয়েছে আন্তর্জাতিক রূপ দিয়ে। এখন আইএমএফ অনুমোদিত কর্মসূচির ভিত্তিতে দেশের অর্থনৈতিক নীতি-নির্ধারণ চলছে। আন্তঃসম্প্রদায় সম্পর্ক জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার দিকনির্দেশনা অনুসারে পরিচালিত হচ্ছে আর আমাদের পররাষ্ট্রনীতি সম্পূর্ণভাবে কয়েকটি প্রভাবশালী দেশের মর্জিমতো নেওয়া হচ্ছে।"
তবে তিনি এও বলেছেন যে, "ভারতীয় সহায়তার কারণেই এখন ওষুধ, খাদ্য ও বিদ্যুৎ সংযোগ কিছুমাত্রায় হলেও পাওয়া যাচ্ছে।"
কলম্বোর সরকার-বিরোধী আন্দোলনরত একজন শিক্ষার্থী শেহান ওয়ানিদু পিয়েরিস বলেন, "আমরা এখন ভারতের সামনে মাথা নিচু করেছি। এখন দিল্লি বললে প্রেসিডেন্ট তার কাপড় খুলেও দেবেন, এটাই এখন বাস্তবতা।"
ভারত নিয়ে এই বিরোধীতাকে আপাতত আমল দিচ্ছে না কেউই। তবে ভারতপন্থী হওয়াটা লংকান রাজনীতিতে খুব একটা গর্বের বিষয়ও নয়। তাই ভারতের সহায়তা নেওয়ার প্রকাশ্যে স্বীকারোক্তি দিতে চান না অনেকেই।
বিষয়টির ব্যাখ্যা করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক লংকান ভারতীয় গণমাধ্যম স্ক্রোলকে বলেছেন, "ভারতের বিষয়ে মনোভাব বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিতে ভিক্ষুরাই নির্ধারণ করেন।"
সরকার ও জনতা সর্বস্তরে প্রভাব আছে এই ভিক্ষুদের। যেকোনো প্রকার 'ভারতীয় প্রভাব' দেখলেই তারা ফুঁসে উঠতেন। চিরকাল এমনটাই হয়ে এসেছে। কিন্তু, বর্তমান সংকটের সময়ে তারা মুখে কুলূপ এঁটেছেন।
শ্রীলঙ্কায় সরকারের পক্ষে দেশ শাসন দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে। ভারত এখন অর্থ ও প্রশাসনিক সাহায্য দুই-ই দিতে পারে। ফলে দিল্লির বন্ধুত্ব কাম্যও হয়তো। কিন্তু, তার বিনিময়ে শ্রীলঙ্কা কতটুকু অধিকার ছেড়ে দিতে রাজি? ভারতই বা প্রতিবেশীর জন্য কতটুকু এগোতে ইচ্ছুক? পরিস্থিতি আরও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে দিল্লি তবুও থাকবে কলম্বোর পাশে?
- সূত্র: স্ক্রোল ডটইন