সম্ভাব্য যে ৫ উপায়ে বন্ধ হতে পারে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের ১০০ দিন পার হয়েছে। এখনও চলছে এ সংঘাত। অথচ গেল ২৪ ফেব্রুয়ারি যখন রাশিয়া ইউক্রেনকে 'নব্য নাৎসিমুক্ত' করার বিশেষ অভিযান শুরু করেছিল, তখন কেউই ভাবেনি এই সংঘাত এত লম্বা হবে। চলমান সহিংসতা, অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববাজারও হয়ে উঠেছে অস্থিতিশীল। বেড়েছে খাদ্য ও জ্বালানির দাম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আরও কিছু সময় দীর্ঘ হলে চরম খাদ্য সংকট পরিস্থিতিও দেখা দিতে পারে, যার আভাস মিলছে ইতোমধ্যেই।
এই পরিস্থিতি আরও দীর্ঘ হলে বিশ্বব্যবস্থায় এর প্রভাব কতটা বিরূপ হবে, পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার বিকল্প কী হতে পারে অথবা কীভাবেই বা থামাতে পারে এই সংঘাত, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা নিজেদের ধারণা, অনুমান ও যুক্তিনির্ভর মতামত দিয়েছেন। ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে সেরকমই ৫টি বিষয় উঠে এসেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন উত্তেজনার ভবিষ্যৎ নিয়ে সম্ভাব্য ৫ পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
শক্তিক্ষয়ের যুদ্ধ
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদি রাশিয়া বা ইউক্রেন কোনো দেশই হাল ছাড়তে রাজি না হয় কিংবা এক পক্ষ অপরপক্ষকে একেবারে পরাস্ত করতে না পারে, তবে যুদ্ধ আরও দীর্ঘ হবে।
অন্যদিকে, রুশ কিংবা ইউক্রেনীয় বাহিনী, কোনো একপক্ষ হাল ছেড়ে দিলেই অবসান ঘটবে যুদ্ধের। কারণ উভয় বাহিনীই গত তিনমাসের লড়াইয়ে ক্লান্ত।
কিন্তু কোনো পক্ষই যে হাল ছাড়তে রাজি নয়, তা ইতোমধ্যেই দেখা যাচ্ছে। রুশ প্রেসডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন অনেকটা ধৈর্যশীলতার কৌশল অবলম্বন করেছেন। তিনি পশ্চিমাদের সঙ্গে জুয়া খেলায় মেতে উঠেছেন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থ ও সামরিক সহায়তা দিয়ে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই সহায়তা কতদিন চালিয়ে যাবে তারা? জটিল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে এটি।
প্রেসিডেন্ট পুতিন মনে করেন, ইউক্রেনকে সহায়তা করতে করতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়বে পশ্চিমা বিশ্ব। নিজেদের অর্থনৈতিক সংকট এবং চীনের হুমকি মোকাবেলার দিকে তাদের আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে। তখন ইউক্রেন একা হয়ে পড়বে।
তবে পশ্চিমারা অবশ্য ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহের সংকল্প অব্যাহত রাখেছে। ভবিষ্যতেও তারা দেশটির পাশে থাকবে এমন আশ্বাস দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের একাংশ আবার মনে করেন, অস্ত্রের যোগান না দিয়ে বরং দুই দেশের মধ্যে আলোচনায় মাধ্যমে সংঘাত থামার উদ্যোগ নেওয়া উচিত পশ্চিমা দেশগুলো। কিন্তু সেটি না করে তারা যেভাবে অস্ত্রের যোগান দিয়ে যাচ্ছে, তাতে সংঘাত আরও দীর্ঘ এবং মারাত্মক হচ্ছে।
আর এরই ধারাবাহিকতায় আরেকটি 'স্নায়ুযুদ্ধের' আশঙ্কা করছেন তারা। রাজনৈতিক ভাষায় তারা বলছেন 'ফরেভার ওয়ার' বা চিরকালব্যাপী যুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে বিশ্ব।
পুতিনের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা
প্রেসিডেন্ট পুতিন যদি একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে বিশ্বকে চমকে দেন, তাহলে বন্ধ হতে পারে এ সংঘাত।
হতে পারে যে অঞ্চলগুলোর নিয়ন্ত্রণ রুশ বাহিনী নিয়েছে, সেগুলোর দেখিয়ে পুতিন 'বিশেষ সামরিক অভিযান' সফলভাবে শেষ হয়েছে বলে ঘোষণা দেবেন। অভিযানে রাশিয়ার বিজয় ঘোষণা করতে পারেন তিনি।
দাবি করতে পারেন, ডনবাসে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চল এখন সুরক্ষিত। ক্রিমিয়ায় প্রতিষ্ঠিতা করতে পারেন একটি স্থল করিডোর। এরপর তিনি সংঘাত বন্ধের জন্য চাপ দিতে পারেন ইউক্রেনকে।
প্যারিস, বার্লিন এবং রোম ইতোমধ্যেই জানিয়েছে, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হোক, তারা সেটি চায় না। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট শেষ করতে চায় তারা। ফলে যুদ্ধবিরতির বিষয়টি ইতোমধ্যেই আলোচনায় তুলেছে দেশগুলো।
তবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং পূর্ব ইউরোপের বেশিরভাগ দেশই এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করতে পারে। এ দেশগুলোর নীতিনির্ধারকরা বিশ্বাস করেন, ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার স্বার্থে অবশ্যই ব্যর্থ হবে।
সুতরাং রাশিয়ার পক্ষ থেকে একতরফা যুদ্ধবিরতির ঘোষণা পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাতে পারলেও যুদ্ধের ইতি হয়তো টানতে পারবে না।
আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান
যদি ইউক্রেন এবং রাশিয়া উভয়েই আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধ বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে নিষ্পত্তি হতে পারে এই রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৩ মাসের বেশি সময় ধরে চলতে থাকা এই সংঘাতের মধ্য দিয়ে রাশিয়া-ইউক্রেন, কোনো পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়া লাভবান হয়নি। সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তির ক্ষয় হয়েই যাচ্ছে চলমান উন্মাদনায়। এটি ইউক্রেনের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, রাশিয়ার ক্ষেত্রেও সত্য।
সেইসঙ্গে, ক্লান্ত হয়ে পড়েছে দুই দেশের বাহিনীও। জনবল, অস্ত্র, অর্থ সবদিক দিয়েই ক্ষতির সম্মুখীন তারা।
তাই উভয়পক্ষ থেকে আলোচনায় বসার উদ্যোগ ও যুদ্ধের ইতি টানার সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায়না।
তবে এ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট পুতিনের ব্যাপারে একেবারে নিশ্চিত হয়ে কিছুই বলা যায়না। পরিস্থিতি সাপেক্ষে তিনি যেকোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারেন।
ইউক্রেনের 'বিজয়'
যুদ্ধ সমাপ্তির আররেকটি সম্ভাব্য দৃশ্যপট হল, ইউক্রেনের 'বিজয়'। যদি রুশ বাহিনীকে ইউক্রেনীয়রা পরাস্ত করতে পারে এবং ১৯৮৯ সালে আগানিস্তান থেকে সাবেক সোভিয়েত বাহিনী যেভাবে বিদায় নিয়েছিল, পরিস্থিতি সেরকম হয়, তবে যুদ্ধের অবসান ঘটবে। কিন্তু ইউক্রেনীয় বাহিনীর হাতে রুশদের পরাজয় অনেকটা অলীক ভাবনার মতোই।
কারণ সে পরাজয় মেনে নেবেন না পুতিন। পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাশিয়া ইউক্রেনের কাছে কখনই নতি স্বীকার করবে না, এমনটিই ধারণা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
রাশিয়ার 'বিজয়'
ইউরোপে এই সংঘাতের আরেকটি সম্ভাব্য চিত্র হল, রাশিয়ার বিজয়। যদি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়া জিতে যায়, তাহলে অবসান ঘটবে চলমান সংঘাত, সহিংসতার।
মার্কিন সমর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়া আবারও কিয়েভকে টার্গেট করতে পারে। দখলে নেওয়া ডনবাস অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের শক্তভাবে বসিয়ে রুশ বাহিনী আবারও আক্রমণ করতে পারে ইউক্রেনের রাজধানীতে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রতিদিন গড়ে ১০০জন ইউক্রেনীয় সেনা মারা যাচ্ছে এবং কমপক্ষে ৫০০ জন আহত হচ্ছে। এদিকে, দেশটির সাধারণ নাগরিকরাও যুদ্ধের ব্যাপারে ভিন্নমতে বিভক্ত হতে শুরু করেছেন। একদল চাচ্ছেন যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় আনতে, অন্যদল আবার জীবন ও অর্থনৈতিক ক্ষতিকে এড়াতে চাচ্ছেন।
সুতরাং, এই সংঘাতের ভবিষ্যৎ আসলে কোন দিকে যাবে তা এখনি নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের দেওয়া যুক্তিনির্ভর মতামতের ওপর ভিত্তি করে কেবল ভবিষ্যৎ পরিস্থিতির অনুমান করা যেতে পারে।
- সূত্র: বিবিসি