আল হারামাইন ও সৌরভ কাহিনি
১.
গন্ধবণিক কারবারের জগতে আল-হারামাইন বেশ বিখ্যাত নাম। আরবের বালুময় মরুভূমির বুকে এর জন্ম। ১৯৭০ সাল থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যাত্রা শুরু প্রতিষ্ঠানটির। মক্কায় সুগন্ধি আগর কাঠের বাণিজ্য দিয়ে শুরু হলেও ধীরে ধীরে গন্ধবণিকের কারবার শুরু করে তারা। মক্কার মসজিদুল হারাম আর মসজিদে নববীর নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়।
আল-হারামাইনের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম কাজী আবদুল হক বিশ্বাস করতেন, সুগন্ধি আতরের ক্ষমতা অনেক- সৌরভ মানুষের বাসনাকে জাগিয়ে তুলতে পারে, নিয়ে যেতে পারে স্মৃতির রাজ্যে এমনকি সামান্য এক ফোঁটাই এনে দিতে পারে প্রশান্তিও। সুগন্ধির এই মোহময় জাদুর রহস্য ধরে ফেলেছিলেন তিনি। তারপর থেকেই বাণিজ্য বাড়াতে থাকেন। তার পর তার উত্তরসূরীরা এগিয়ে নিয়ে যায় আল-হারামাইনের নাম।
ধীরে ধীরে বালুকাময় আরবের সীমা ছাড়িয়ে তার সুবাস ছড়িয়েছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার মতো পর্যটন রাজ্যেও।
বাংলাদেশে আল-হারামাইনের প্রথম প্রকাশ যমুনা ফিউচার পার্কের এক কোণে পরিপাটি সাজানো দোকানের বেশে। এরপর বছরখানেক হলো বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্সের নিচতলায় আরেকটি দোকানে রং-বেরঙের শিশিতে আতর আর সুগন্ধির পসরা সাজানো। সুগন্ধিপ্রেমীদের কাছে ইতোমধ্যেইে এই নাম এই ব্র্যান্ড সুপরিচিত।
আল-হারামাইনের দোকানে গেলেই ছোট ছোট কাগজের টুকরায় আপনাকে একটু স্প্রে করে দেওয়া হবে সৌরভ নাকে পরখ করে নেওয়ার জন্য। নাকে কাছে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হবে আরব্য রজনীর গল্পের পাতায় চলে গেছেন যেন।
আল-হারামাইনের সুগন্ধির দাম নাগালে মধ্যে আবার অনেকের নাগালের বাইরেও। শুরু হয় আউন্সপ্রতি সর্বনিম্ন ২৫০টাকা থেকে, তারপর শুধু এক আউন্সের মূল্যই ৫০ হাজার টাকা।
শুধু সুগন্ধিই নয়, আল-হারামাইনের নানা আকারের কাঁচের বোতলও মুগ্ধ করার মতো, বিশিষ্ট। ইসলামী ঐতিহ্যের ছাপ স্পষ্ট। হারামাইন ব্যান্ডের সুগন্ধি ধারণাকরা পাত্রগুলো, আরবের মরু প্রান্তর, এবং সৌরভ বিলাসিতার দীর্ঘ অতীতের কথাই মনে করিয়ে দেয়, সুদৃশ্য, নকশাদার রঙিন কাঁচ আর ক্রিস্টালের বোতলে রাখা মহার্ঘ আতর। সবচেয়ে কম দামের আতর বা আল-হারামাইন সৌরভের শিশি কিনতে খরচ হবে সর্বনিম্ন ২ হাজার থেকে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত।
আর আল-হারামাইনের সবচাইতে দামি সুগন্ধির নাম 'আগর'। এর এক আউন্সের দাম ৫০ হাজার টাকা।
কত সুগন্ধি আল-হারামাইনে
নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য তাদের নানা ধরনের সুগন্ধি আছে। আছে বিভিন্ন অনুষ্ঠান বা উৎসব উপযোগী সুগন্ধিও। যেমন প্রতিদিন ব্যবহারের জন্য নারীরা বেছে নিতে পারেন 'অপোজিট পিঙ্ক' যার এক বোতলের দাম পড়বে ২ হাজার টাকা। আর পুরুষদের জন্য আছে 'আরবানিস্ট হোম', মৃদু ঝাঁঝের এই সুগন্ধির রেশ অনেকক্ষণ থেকে যায় মনে, মস্তিষ্কে।
নর-নারী নির্বিশেষে 'ইউনিসেক্স' সুগন্ধিও আছে। হালকা মিষ্টি সুবাসের মীক্বাত বা চকলেটের সুবাসওয়ালা ড্যাজেল এমনই আরেক সুগন্ধি।
তবে কড়া ঝাঁঝের জন্য আল-হারামাইনের বিখ্যাত দুইটি পারফিউম রয়েছে: সোফিয়া ভায়োলেট এবং মারকিউরি।
সুগন্ধি তৈরির উপকরণ
সুগন্ধির ইতিহাসে সবচাইতে প্রাচীন উপকরণ 'ওউধ'। সুগন্ধি আগর কাঠের নির্যাস থেকে তৈরি হয় এই 'ওউধ' তেল। প্রাকৃতিক এই উপাদানটি সরাসরি ত্বকে মাখা যায়, কেননা এতে কোন ক্ষতিকারক উপকরণ নেই, তাই ত্বকের কোন ক্ষতি করে না। এর সুবাস বেশ গাঢ়, আর কাঠের নির্যাসের হালকা ঝাঁঝ আছে, রেশ থেকে যায় অনেকক্ষণ। বিভিন্ন অঞ্চলের ওউধ সুবাসের ধরণও ভিন্ন ভিন্ন। যেমন কম্বোডিয়ার ওউধ থেকে তৈরি 'দুজ্ঞাত আল ওউধ কম্বোডি' কিংবা ভারতের 'ওউধ হিন্দ মা'আল আতর'। একটু গাঢ় আর উষ্ণ আবেদনময় সুবাস পেতে চাইলে আছে 'ওউধ শেখ' বা 'দুজ্ঞাত মা'আল অ্যাম্বার'।
আতর
আগর কাঠের তেল অর্থাৎ ওউধ দামি সুগন্ধিতে ব্যবহার করা হয়। তবে ওউধ ছাড়াও আরও নানা রকমের উপকরণ দিয়ে আতর তৈরি হয়, যেমন গোলাপ তেল, চন্দন তেল ইত্যাদি আরও নানা উপকরণ মিশিয়ে হয় আতর।
নিত্যদিনের ব্যবহারের জন্য আল-হারামাইনে আছে 'মেজ' বা গোলকধাঁধাঁ নামের আতর। ফুল আর আম্বারের মিশেলে তৈরি এই আতরের মিষ্টি সুবাস মনে গেঁথে যায়। আরও আছে চকলেট আর ভ্যানিলার মিশেলে বানানো 'নজম'।
করোনার করাল গ্রাসে বিশ্বজুড়ে অন্য ব্যবসায়ের মতো সুগন্ধির বাজারেও কেনাবেচা কমে গেছে। বায়তুল মোকাররমের আল-হারামাইন আতর হাউজের বিক্রেতা মোশাররফ হোসেন জানান, গেল রোজার ঈদে অন্যান্যবারের চেয়ে অর্ধেক কমেছে তাদের বিক্রি। ছোটখাট আতরের বিক্রি কিছুটা হলেও, দামি আতর এখন আর কিনছেন না কেউই। এই ব্র্যান্ডের অনেক সুগন্ধিই আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। আমদানিও কমে গেছে অনেক।
করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি না হলে সুগন্ধির বাজারে শঙ্কা রয়েই যাবে বলে মনে করেন মোশাররফ হোসেন।
২.
আরবের সৌরভের দেশি কথা শুনলেন এতক্ষণ। এবার আসা যাক বাইরের দুনিয়ার সৌরভের কিছু খবর-বেখরে।সুগন্ধির বাজারে লিঙ্গভেদের চল ছিল বহুদিন ধরেই।
বিখ্যাত ফ্যাশন ব্র্যান্ড 'ডিওর' এর প্রতিষ্ঠাতা ক্রিশ্চিয়ান ডিওর-এর এক বিখ্যাত বাণী আছে- 'একজন নারী সম্পর্কে তার হাতের লেখায় যতটা না জানায়, তার চেয়েও বেশি জানায় তার সুগন্ধি।'
বিক্রি বাড়াতে এমন অনেক বাণীই সুগন্ধির বাজারে আছে। কিন্তু পারফিউম নিয়ে নারী-পুরুষের এই বিভেদ ধীরে ধীরে কমে আসছে। 'ফর মেন' অর্থাৎ পুরুষদের জন্য আর 'ফর ওমেন' অর্থাৎ নারীদের জন্য- এই চিরাচরিত লিঙ্গভেদের ধারণা থেকে বেরিয়ে আসছে ব্র্যান্ডগুলো। ২০২০ সালে এসে অনেক বিখ্যাত সৌরভের ব্র্যান্ডই নারী-পুরুষ উভয়ের ব্যবহারের এক সুগন্ধি বাজারে নিয়ে আসছে।
অবশ্য সবাই যে একই পথে হাঁটছে তা নয়। এখনও বড় বড় দোকানগুলোতে গেলে নারী-পুরুষের সুগন্ধির আলাদা তাক খুঁজে পাবেন আপনি। সেখানে ফর ওমেন লেখা বোতলগুলো গোলাপি বা তথাকথিত 'মেয়েলি' রঙের, ফুলের গন্ধের সঙ্গে মিলিয়ে তাতে ফুল আঁকা, বোতলের গায়ে মোলায়েম বাঁক। তাদের নামগুলোও সেরকম- 'জ্যাসমিন', 'ডেইজি', 'সুইটহার্ট' ইত্যাদি।
আর অন্যদিকে পুরুষদের জন্য বরাদ্দ সুগন্ধি বোতলগুলো খুব চোখা, কালো, ধূসর বা গভীর গাঢ় রঙের। তাদের গায়ে চামড়ার খাপ আর সুবাসের ধরণও 'পুরুষালি'। 'স্যাভেজ' বা 'লা মেল' নামের সুগন্ধিগুলোর দিকে তাকালেই মনে হয় দুঃসাহসী বেয়ার গ্রেইলসের মতো যেন এখনই কোন সুদর্শন এগিয়ে আসবে নায়িকাকে বাঁচাতে।
বিষয়টা ভেবে হাস্যকর লাগছে? সুগন্ধি শিল্পকে বিলিয়ন ডলারের ব্যবসায় পরিণত করেছেন বিপণন কৌশলবিদেরা, নারী পুরুষের পৃথক সৌরভের থারণা তাদের্। এইসব সামাজিক বিনির্মাণের জন্য তারাই দায়ী। এখন সেই চিরাচরিত নিয়মগুলো আস্তে আস্তে ভাঙতে শুরু করেছে। এখন সুগন্ধির বাজারে এসেছে বাইরেডো, ফ্রেডেরিক ম্যালে, ডিপটিক এবং এসেনট্রিক মলিকুলের মতো নামজাদা ব্র্যান্ডগুলো।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০১০ সালে বাজারে 'ইউনিসেক্স' বা নরনারী নির্বিশেষে সুগন্ধি ছিল ১৭%। আর ২০১৮ সালে এসে তার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫১%। অর্থাৎ অর্ধেকেরও বেশি। ২০১৯ সালে এই ধরণের সুগন্ধির শীর্ষে ছিল গুচি'র মোমোয়ার দ্য'উনে ওডোর এবং সেলিন'র ১১টি পারফিউম।
ইংল্যান্ডের সুগন্ধি ব্র্যান্ড অরমন্ডো জেইন। সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা লিন্ডা পাইলিংটন বলেন, "একদিন আমার দোকানে এক পুরুষ এলেন, হাতে নিলেন জুঁই ফুলের এক সুগন্ধির বোতল। নেড়েচেড়ে শেষ পর্যন্ত গোলাপের সুগন্ধি নিয়ে গেলেন তিনি। কিন্তু কিছুদিন পর আমাদের ফোন করে অভিযোগ করলেন, আমরা নাকি নারীদের পারফিউম দিয়েছি ওনাকে। আমি তখন তাকে বললাম, 'আপনার যদি এটা ভালো লাগে, আপনি ব্যবহার করুন। কে কি বলল তাতে কি যায় আসে?' তখন থেকেই আমার মনে হল, সুগন্ধিকে লিঙ্গ অনুসারে শ্রেণিবদ্ধ করার এই ধরণ আমাদের পাল্টাতে হবে।
৩.
কিছু সুগন্ধি রয়েছে যা আপনার আমার (এটা পুরোই আমার ধারণা) একেবারেই নাগালের বাইরে। কিছু পৃথিবীবিখ্যাত সুগন্ধির নাম বলি:
অনিক গোটেল অ ডিহাড্রিয়েন: এই সুগন্ধির এক আউন্সের দাম পড়বে পাঁচশ ডলারের কাছাকাছি। কি আছে এ সুগন্ধিতে: লেবুর সুবাস, কমলা, আঙুল, সিট্রন, সাইপ্রেস নির্যাস আর মাদাগাস্কারের রহস্যময় উদ্ভিদ ইয়ালাং ইয়ালাংয়ের নির্যাস।
হার বল্ট অফ লাইটিনিং: এই সুগন্ধির এক আউন্সের মূল্য প্রায় হাজার ডলারের কাছাকাছি। এক জহুরীর উদ্ভাবন এই সুগন্ধি। এটা যতটা না সৌরভের জন্য বিখ্যাত বা নজরকাড়া তার চেয়ে বেশি সমাদর এই সুগন্ধির বোতলের। হাতে তৈরি, নকশা করা বোতলে ভরা থাকে এ সৌরভ।
জয়: জাঁ পাতো এই সুগন্ধির প্রস্তুতকারী। এউ সৌরভের মূল্য প্রায় হাজার ডলার, এক আউন্স। বিশেষত ফুলের সৌরভের কারণেই এই সুগন্ধি মহার্ঘ। ১৯৩৬ সালে মহামন্দার সময় লোকজনকে চাঙ্গা করে তুলতে এই সৌরভ বাজারে ছাড়া হয়, তখন থেকেই তুমূল প্রশংশিত এই সৌরভ। জয় সুগন্ধির এক আউন্স তৈরিতে ব্যবহার হয় ১০ হাজার ফুল আর ৩৩৬ গোলাপ। মহামন্দার সময় মহাদামী এই সুগন্ধি দরিদ্র মানুষকে কিভাবে চাঙ্গা করেছে এ এক বিস্ময় বটে।তবে কোনো না কোনোভাবে এটা সফল হয়েছে, নয়তো ফ্র্যাগরান্স ফাউন্ডেশন কেন এইসুগন্ধিকেই শতাব্দীর সেরা সুগন্ধি হিসেবে নির্বাচিত করবে?
উপরের সুগন্ধির চেয়ে দামে এগিয়ে ক্যারন পোইভরি (এক আউন্স এক হাজার ডলার) এরমেস টুয়েন্টি ফোর ফবো্র (এক আউন্স পনেরশ ডলার), শ্যানেল গ্র্যান্ড এক্সট্রেইট (এক আউন্স সাড়ে চারশ ডলার প্রায়) শ্যানেল ফাইভের শ্রেষ্ঠ, ক্লাইভ ক্রিশ্চিয়ান (এক আইন্স বাইশ ডলার)।
গিনেস বুক অফ রেকর্ডর মতে, বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান সুগন্ধির নাম ক্লাইভ ক্রিশ্চিয়ান নাম্বার-ওয়ান ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টি। এর মাত্র দশ বোতল সুগন্ধি তৈরি হয়েছে।
আচ্ছা এবারআসা যাক, সবচেয়ে দামি সুগন্ধি: ডিকেএনওয়াই গোল্ডেন ডেলিসাস মিলিয়ন ডলার ফ্র্যাগরেন্স বটল। দাম কত? এক মিলিয়ন ডলার। বলে রাখি সুগন্ধি নয় এটা মহামূল্যবান বোতলের জন্য। এ সুগন্ধি বোতরের নকশা করেছেন বিখ্যাত জহুরী মারটিন কাৎজ। বোতলে ব্যহৃত হয়েছে ১৪ ক্যারেট হলুদ আর সাদা সোনা। এবং এটাই যেন যথেষ্ট না, এই বোতলের টোপরে আছে ২,৯০৯ টি দামী পাথর।
এক ডাচ সুগন্ধি শিল্পী লুসি ম্যাকরে কাজ করছেন একটি পিল তৈরির।এই পিল শুধু গিলে ফেলতে হবে, তারপর ঘুমের সঙ্গে মিশে সৌরভ ছড়াবে।
সৌরভ দীর্ঘ এক পাড়ি দিয়ে এসেছে, ভারত উপমহাদেশ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপ তারপর আমেরিকা...সুগন্ধি এই দুনিয়ায় চিরকাল টিকে থাকবে, তবে ভবিষ্যতে হয়তো বোতল নয়, হয়তো ছোট কোনো ক্যাপসুল যা ভিটামিনের মতো খেতে হবে।