উত্তমকুমার: এক বন্দুকবাজ বাঘের গল্প
এক
সুন্দরবনে বাঘ থাকে। আর থাকে মানুষ। তাদের মধ্যে থাকে নদী। তাদের মধ্যে থাকে নালা। তবু তারা একে অন্যকে এত ভালোবাসে, মাঝের নদী-নালা সুতো হয়ে যায়। জল টপকে মানুষ যায় বাঘের ঘরে। তখন বাঘেদের পাড়ায় হই হই পড়ে যায়। তারা 'এসো মানুষ, বোসো মানুষ' করে অতিথি সৎকারে লেগে পড়ে। বাঘেরা জোর করে ধরে নিয়ে যেতে চায় তাদের বাড়ি। মানুষ যাবে না, তারাও ছাড়বে না। শেষে সুযোগ বুঝে একটা-দুটো মানুষকে ঘেঁটি ধরে তারা নিয়ে যায় নিজেদের আস্তানায়। সেখানে এত আদর-যত্ন যে বাঘের বাড়ি থেকে সেই মানুষদের আর ফেরা হয় না। মানুষ বাঘের বনে যায় দল বেঁধে। কিন্তু ফিরে আসে বাঘের অতিথি হওয়া এক-দুজনকে বাদ দিয়ে। যারা ফিরল না, তারা হয়তো কারও বাবা। কারও মামা। কারও কাকা। তাদের ছেলেরা কাঁদে। মেয়েরা কাঁদে। ভাগ্নে-ভাগ্নিরা কাঁদের। ভাইপো-ভাইঝিরা কাঁদে। বাবা কবে আসবে। কাকা কবে আসবে। মামা কবে আসবে। তবে ওই কাঁদাই সার। ক-দিন পরে তারা ভুলে যায়। বাবা-কাকা-মামারা পাকাপাকিভাবে মানুষের গাঁ থেকে বাদ পড়ে।
মাঝে মাঝে বাঘও নদী-নালা সাঁতরে চলে যাসে মানুষের বাড়ি। তাদের দেখেই হুলুস্থুল পড়ে যায়। বাঘের খাতিরদারি করার জন্যে কেউ আনে বল্লম, কেউ লাঠি, কেউ বা বন্দুক। মানুষের এমন উৎসাহ দেখে বাঘ গিয়ে ঢোকে হয়তো গোয়ালঘরে। আর মোটেও বাইরে বেরোতে চায় না। মানুষরাও নাছোড়বান্দা। মেহমান নওয়াজি করেই ছাড়বে তারা। বাঘকে কাঁধে চড়িয়ে পাড়া ঘুরিয়ে দেখাবে। কিন্তু বাঘেরা স্বভাবলাজুক কি না। তাই গোয়ালঘর থেকে উঁকি দিয়ে দেখে কত মানুষ বাইরে। তারপর মুখ লুকিয়ে চুপটি করে বসে থাকে। গোয়ালের গরুগুলো বাঘের সঙ্গে কথা বলতে চায়। তারা হাম্বা রবে গান ধরে।
কতদিন পরে এল বাঘ
জঙ্গল পেরিয়ে আজ
তারপর তারা গানের তৃতীয় লাইন ভুলে গিয়ে হুঁ হুঁ হাঁ হাঁ করে তাল দিয়ে চার নম্বর লাইনে ছন্দ মিলিয়ে দেয়—
মানুষের নেই কোনও কাজ
বাঘ তাদের চুপ ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করায়— "চেঁচাস না প্লিজ। বাইরে দ্যাখ কত মানুষ। আমার এমনিই টেনশানে হিসি পাচ্ছে।" গরুদের মধ্যে যে একেবারে ছোট, সে উপায় বাতলায়— "গোয়ালের পেছনের যে চিলতে দরজা, ওটা দিয়ে বেরিয়ে দেখবে সামনেই একটা তেঁতুল গাছ। আমার হিসি পেলে আমি ওই তেঁতুল গাছের নিচে গিয়ে হিসি করে আসি।" বাঘও সেই মতো চিলতে দরজা গলে বেরোতে গেল। গোয়ালের এদিকটা নির্জন। মানুষজন নেই। কিন্তু দরজাটা এতটাই ছোট বাঘের পেট গেল আটকে। গরুদের দিকে তাকিয়ে একটু অপ্রস্তুত হেসে বাঘ বলল, "হে হে হে… আসলে… হে হে হে… একটু ডায়েট করা দরকার…" টিনএজার ধলা গাই বাঘকে পরামর্শ দেয়— "শ্বাস টেনে পেটের ঘের একটু কমিয়ে নাও।" বাঘ সু-উ-উ-প করে কিছুটা হাওয়া পেট থেকে মুখের দিকে দিকে নিয়ে আসে। তারপর পেটটা একটু কমিয়ে নিয়ে পুটুস করে গোয়াল থেকে বেরিয়ে তেঁতুল গাছের নিচে আসে।
হিসি করতে যাবে কী, গোয়ালের ওদিকে জড়ো হওয়া মানুষদের মধ্যে কে যেন চেঁচিয়ে ওঠে— "ওরে বাঘটা মনে হয় তেঁতুলতলায়।" বাকি মানুষরা তাদের অতিথি খুঁজে পাওয়ার আনন্দে হো-ও-ও-ও করে সেদিকে আসারা তাল করে। বাঘ খুবই বিরক্ত হয়ে নিজেকে আড়াল করতে কাছাকাছি আর কোনও ঝোপঝাড় না পেয়ে তেঁতুল গাছেই উঠে পড়তে চায়। হাঁচোড় পাঁচোড় করে গাছের ওপর কিছুটা উঠে একটা মোটা ডালে বসে শ্বাস নেয় বাঘ। নাহ! এবার সত্যিই ডায়েটিং শুরু করা উচিত। এই সামান্য গাছে উঠতেই যদি এত হাঁপাতে হয়!
বাঘ যে ডালে উঠে বসেছে, তার ঠিক ওপরেই বসেছিল কামালের দাদি। অনেক বয়স হয়েছে। তাই মাঝে মাঝে ভুলেই যায় সে বেঁচে আছে। বিকেলবেলা ছাদে এসেছিল রোদে দেওয়া লেবুর আচার তুলতে। পড়ন্ত বেলার আলিস্যিতে দাদির চোখে ধরে এসেছিল। একপাশে মাদুর পেতে একটু শুয়েছে কী শোয়নি, চোখ খুলেছে যখন, সূর্য গেছে ডুবে। চারদিকে অন্ধকার দেখে দাদি ভেবেছে সে মরেই গেছে শেষমেশ। তাই নিজেকে ভূত ভেবে ছাদের লাগোয়া তেঁতুল গাছের একটা ডাল ধরে গাছে উঠে এসে একটা ডালের ওপর শুয়েছিল। বাঘ একটু থিতু হয়ে বসেছে কি বসেনি, ওপর থেকে বুড়ি খনখনে গলায় জিজ্ঞাসা করল— "গামু এসেছিস?" গামু কামালদের বাড়ির হারিয়ে যাওয়া বিড়াল। বছরদশেক আগে মেলায় ঘুরতে যাওয়ার নাম করে সেই যে বেরিয়েছিল, আর ফেরেনি। কিন্তু বুড়ি মাঝে মাঝেই খোয়াব দেখে তার হারানো বিড়াল ফিরে এসেছে।
এদিকে ওপর থেকে অমন গলা শুনে বাঘের তো পিলে চমকে গেছে। রাত্রিবেলা গাছের ডালে বসে যে কোনও জ্যান্ত মানুষ ডাকতে পারে না, বাঘ হলেও এ বুদ্ধিটুকু তার আছে। নিচে মানুষ। ওপরে ভূত। বাঘ পড়ল দোটানায়। ওদিকে ওপর থেকে হাত বাড়িয়ে দাদি বাঘের গায়ে হাত বোলাতে গেল। ঠিকঠাক সামলাতে না পেরে ঝুপ করে এসে পড়ল সে বাঘের ওপরই। বয়স হয়ে দাদির শরীর হালকা। তাই বাঘের এতটুকু লাগেনি। বরং বুড়ি যখন বাঘের পিঠে শুয়ে শুয়েই তার কান চুলকে দিতে শুরু করল, বাঘের ভয়ানক আরাম হল। সে গলা দিয়ে বিড়ালের মতো গর্ গর্ গর্ করে আওয়াজ বের করতে শুরু করল। আর বুড়ি নিজের মনেই বকে যেতে লাগল— "আমার গামু সোনা। কতদিন দেখিনি তোকে। কত বড় হয়ে গেছিস।"
রাত আরেকটু বাড়তে মানুষরা বাঘ খুঁজে না পেয়ে যে যার বাড়ি গেল। কামালের দাদিও বাঘের পিঠে শুয়ে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে বাঘের গায়ের ওমে। বাঘ তাকে পিঠে নিয়েই তেঁতুল গাছ থেকে এসে উঠল কামালদের বাড়ির ছাদে। তারপর মেলে রাখা মাদুরে দাদিকে শুইয়ে দিয়ে নিজে দাদির কোল ঘেঁষে শুয়ে পড়ল। সারাদিন কম ধকল তো যায়নি। নদী সাঁতারানো, মানুষের আদরযত্ন এড়াতে দৌড়-ঝাঁপ করা, গাছে ওঠা। তারপর সারাদিন পেটেও কিছু পড়েনি। খোলা ছাদে মৃদুমন্দ হাওয়া দিচ্ছে। ক্লান্তিতে খিদেয় আরামে রাতের আকাশে তারা গুনতে গুনতে বাঘের চোখে একরাশ ঘুম নেমে এল।
দুই
ভোর হতে না হতেই কামালদের বাড়ি হইচই পড়ে গেল। কামালের দাদিকে পাওয়া যাচ্ছে না। কামালের মা দাবি করল— "কাল রাতেও দুটো রুটি ডালে ডুবিয়ে খেল।" দেখা গেল, রুটি ডাল, রুটির থালা আর ডালের বাটি— সবই যেমন কে তেমন পড়ে আছে বুড়ির ঘরের মেঝেতে। কেউ খায়নি। এর মধ্যে কামালের ছোট ভাই বলল সে বিকেলে দাদিকে ছাদে উঠতে দেখেছিল। তারপর কী হয়েছে সে জানে না।
এদিকে বাড়ির নিচের তলায় হইচই শুনে বুড়ির ঘুম গেছে ভেঙে। একটু এদিক-ওদিক তাকিয়ে কামালের দাদির আবছা মনে পড়ল সে ছাদে লেবুর আচার তুলতে এসেছিল। যেই মনে পড়া, পাশে শুয়ে থাকা বাঘের লেজ ডিঙিয়ে ছাদের একদিকে রাখা আচারের বয়ামের দিকে গুটিগুটি এগোল সে। ওদিকে বাঘেরও ঘুম ভেঙে গেছে। গতরাতে কী কী হয়েছে এক লহমায় মনে পড়ে গেল তার। উঠে আড়মোড়া ভেঙে সে সামনে দেখল একটা বুড়ি মানুষ দাঁড়িয়ে। বোঝা গেল আসলে মানুষটা মানুষই, ভূত নয়। বাঘের তখন খিদে পেয়েছে, আগের দিন কিছু পেটে পড়েনি তার। তাই একটু কিন্তু-কিন্তু করেই সে কামালের দাদিকে জিজ্ঞাসা করল— "খিদে পেয়েছে ঠাকুমা। কিছু আছে?" কামালের দাদির একইসঙ্গে ভয়ানক আনন্দ আর দুঃখ হল। আনন্দ এই কারণে যে তার গামু কথা বলতে শিখেছে। হয়তো বাড়ি থেকে পালিয়ে কোনও ইস্কুল-কলেজে ভরতি হয়ে লেখাপড়াও শিখেছে সে। আর দুঃখ এই কারণে যে গামু কিছু খেতে চাইছে, কিন্তু তাকে খেতে দেওয়ার মতো তার কাছে কিছুই নেই সেই মুহূর্তে।
ওদিকে বাঘ কিন্তু দাদির আচারের বয়ামের গন্ধ পেয়েছে। সে জিজ্ঞাসা করল— "তোমার হাতে ওটা কী? খাবার?" দাদি শুকনো মুখে বলল, "খাবার তো বটে। কিন্তু এ তো লেবুর আচার। খালি পেটে খেলে আর দেখতে হবে না। অম্বল হয়ে…" বুড়ির কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি, বাঘ সড়াত করে তার দু-হাতে ধরে রাখা আচারের বয়াম কেড়ে নিয়ে বয়ামটার গায়ে চোখ ঠেকিয়ে দেখে। ভেতরে বড় বড় রসগোল্লার মতো গোটা গোটা লেবুর জারকের আচার। গন্ধেই তার জিভে জল এসে যায়।
এর মধ্যে দাদিকে খুঁজতে খুঁজতে খুঁজতে খুঁজতে কামালের বাবা আর ছোটকাকা উঠে এল ছাদে। তারা দেখল বুড়ি দাঁড়িয়ে। তার সামনে একটা কেঁদো রয়াল বেঙ্গল টাইগার। টাইগারের হাতে দাদির আচারের বোতল। আমরা তো আগে থেকেই জানি আমাদের বাঘ কত লাজুক। তাই কামালের বাবা-কাকার গোল গোল চোখ দেখে ঠিক করল এখনই পিঠটান দেওয়া দরকার। নাহলে এক মুহূর্ত পরে এই মানুষগুলো ধাতস্থ হলেই তাকে থেকে যাওয়ার জন্যে জোরজার করবে। বলবে, "চালের আটার রুটি আর খাসির মাংসের সুরুয়া। খেতেই হবে। নাহলে ছাড়ছি না।" আহা! খাসির মাংসের সুরুয়া! জিভের জল সুড়ুপ করে টেনে নিয়ে বাঘ ঘাড় নাড়ল। সুরুয়ার লোভ না করে এখান থেকে কেটে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
কামালের বাবা আর কাকা সম্বিত ফিরে পেয়ে যতক্ষণে 'বাঘ! বাঘ!' চিৎকার শুরু করেছে, তার বহু আগেই বাঘ একহাতে আচারের বয়াম আর একহাতে তেঁতুল গাছের ডাল ধরে নেমে সেই গোয়ালঘরের পেছনে। তারপর সেই একচিলতে দরজা দিয়ে গলার আগে আবার সু-উ-উ-প করে নিশ্বাস টেনে পেটটা একটু রোগা করে নিয়ে গোয়ালের মধ্যে। গরুরা কেউ নেই, সকালবেলা চরতে বেরিয়েছে। বাঘ এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে গোয়ালঘরের সামনের দরজা খুলে চোঁ-চাঁ দৌড় শুরু করল।
বাঘ দৌড়াচ্ছিল বনবাদাড়ের মধ্যে দিয়ে। গ্রামের রাস্তা ঘেঁষে। হঠাৎ শুনতে পেল সামান্য দূরে অনেকগুলো মানুষ জড়ো হয়ে ব্যস্ত গলায় কী যেন আলোচনা করছে। বাঘ একদণ্ড থামল। তারপর কান দুটো খাড়া করে ঝোপের মধ্যে বসে শুনতে চেষ্টা করল।
- বাঘটা তো বুঝলি প্রায় কুড়ি ফুট লম্বা।
- কুড়ি ফুট লম্বা বাঘ হয়! বানাচ্ছিস।
- আর চোখগুলো যেন জ্বলন্ত মার্বেল। দেখেই আত্মারাম খাঁচাছাড়া।
- আর দাঁতগুলোর কথা বল।
- আর গোয়ালে ঢুকে লেজটা কীভাবে মাটিতে আছাড়াচ্ছিল দেখেছিস? ভয় পেয়ে কানাইদের গরুগুলোর সে কী চিৎকার।
বাঘ আর থাকতে না পেরে ঝোপ থেকে গলা বাড়িয়ে বলল, "গরুগুলো তো গান গাইছিল। ভয় পায়নি তো।"
ব্যস! হঠাৎ করে 'ওরে গেছি রে!' 'বাঘে খেলো রে!' 'মামা বাঁচা রে!' ইত্যাদি প্রভৃতি চিৎকার করতে করতে মানুষগুলো হাওয়া। আসলে সেটা ছিল একটা চা দোকান। গ্রামে ঢোকার মুখে এই দোকানে বসে চা খায় মানুষজন। যারা বসে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিল, তারা তো চায়ের গেলাস, পায়ের চপ্পল, এমনকী একজন হাতের ছাতা পর্যন্ত ফেলে দৌড় মেরেছে। ফেঁসে গেছে একা চায়ের দোকানি সিরাজ মণ্ডল। তার একচিলতে দোকানে দরজা বলে কিছু নেই। দোকানের সামনের দেওয়ালের ওপরের অর্ধেকটা জানালার মতো খুলে যায়। সে জানালা গলেই যাতায়াত করে। এখন একটা জ্বলন্ত কেরোসিনের স্টোভ বসানো সেই জানালায়। ফলে সিরাজ মণ্ডল দোকানের মধ্যে দাঁড়িয়ে ঠক ঠক করে কাঁপতে শুরু করেছে বাঘ দেখে।
বাঘ ঝোপ থেকে বেরিয়ে পালাতে থাকা মানুষগুলোকে প্রথমে অবাক চোখে দেখল। তারপর সিরাজ মণ্ডলকে দেখে আরও অবাক হয়ে বলল, "তোমার ঠান্ডা লাগছে?" সিরাজ এত সামনে থেকে আগে কখনও বাঘ দেখেনি। তাই উত্তর দিতে গিয়ে দাঁতে দাঁতে ঠোকাঠুকি লেগে বেরিয়ে এল— "ঘ্যাঁ!" আসলে সে হ্যাঁ বলতে চেয়েছিল, নাকি ভয়ে ভ্যাঁ করে কাঁদতে চেয়েছিল, সে নিয়ে তর্ক চলতে পারে। কিন্তু বাঘ সেসব কিছু না বুঝেই এদিক ওদিক তাকিয়ে সামনের ছোট বেঞ্চ থেকে একজন খদ্দেরের ফেলে যাওয়া ছাতা তুলে নিল। তারপর সিরাজের দিকে বাড়িয়ে ধরল— "নাও। এটা গায়ে দাও।"
চাদর আর ছাতার পার্থক্য বাঘ বেচারা জানে না। কিন্তু বাঘকে জ্ঞান দিতে গিয়ে যদি তার হাতে একটা আলতো চাঁটি খায়, এই ভয়ে বেচারা সিরাজ মণ্ডল কিচ্ছুটি না বলে হাত বাড়িয়ে ছাতাটা নিল। তারপর ছাতার হাতলের দিক থেকে কিছুটা নিজের মাথায় গলিয়ে বুক পর্যন্ত ঢেকে নিয়ে আবার চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। এখন অন্তত চোখের সামনে বাঘটাকে দেখতে পাচ্ছে না। তাই তার কাঁপুনি একটু কমল। মনে সাহস এনে বলল, "তোমার কী দরকার এখানে?"
বাঘ একটু ভেবে বলল, "তোমার কাছে কিছু খাবার আছে? খিদে পেয়েছে।" তারপর হাতের বয়ামটা দেখিয়ে বলল, "এটা লেবুর আচার। কিন্তু খালি পেটে ঠাকুমা খেতে বারণ করেছে।"
সিরাজ মণ্ডল মাথায় ছাতা ঢাকা অবস্থাতেই বলল, "আমার কাছে চা আছে।" তারপর একটু মনে করে বলল, "বাপুজি কেক আছে আর আছে লেড়ো।"
বাঘ কিছু না ভেবেই বলল, "সবগুলোই দাও।"
সিরাজ মণ্ডল নিজের মাথার দিকে দেখাল— "এভাবে আমি দেব কী করে? তুমি নিজেই নিয়ে নাও। স্টোভের ওপর কেটলিতে চা ফুটছে। পাশে গেলাস আছে ঢেলে নাও।" তারপর ডান হাত দিয়ে দেখাল— "আর এদিকে দ্যাখো লেড়ো আর কেক আছে ওই কৌটোতে।"
বাঘ হাতের বয়ামটা বেঞ্চের ওপর রেখে, কেটলি থেকে চা ঢালল একটা গেলাসে। তারপর সিরাজ মণ্ডলের দেখিয়ে দেওয়া বয়াম থেকে একটা লেড়ো বের করে আরাম করে বসল মাটিতে। তারপর সুড়ুত করে চায়ের গ্লাসে চুমুক দিল। বাঘ আগে চা খায়নি। তাই গরম গরম গুড়ে গুম গুম করা মিষ্টি সেই চা খেয়ে তার আরামে চোখ বুজে এল। তারপর লেড়োতে একটা কামড় দিল। আওয়াজ হল ক্রা-উ-উ-উ। এটা তার ঠিক পছন্দ হল না। তাই সিরাজ মণ্ডলের দিকে তাকিয়ে বলল, "এ কেমন খাবার? হাড়ের মতো শক্ত! মানুষ এমন খাবার খায়?"
সিরাজ মণ্ডল ততক্ষণে মাথা থেকে ছাতা খুলেছে। তার ভয় পুরোপুরি না কাটলেও বাঘকে দেখে আর আগের মতো কাঁপুনিটা দিচ্ছে না। সেই তাই উপায় বাতলে দিল— "লেড়োটা আগে চায়ে ভিজিয়ে নাও। তারপর মুখে দাও।" বাঘ তার কথামতো লেড়োটা চায়ে ডোবাল। তারপর সেটা তুলে মুখে দিল— "উ-ম-ম-ম!"
তিন
বাঘ আয়েশ করে সিরাজ মণ্ডলের দোকানে বসে চা খাচ্ছে। ওদিকে চা দোকান থেকে যারা পালিয়ে গিয়েছিল, তারা গ্রামে গিয়ে খবর দিল কালকের রাতের সেই বাঘ সিরাজ মণ্ডলের দোকানে হানা দিয়েছে। তারা প্রাণ হাতে করে পালিয়ে এসেছে বটে, কিন্তু সিরাজ মণ্ডলকে বোধ হয় বাঘটা তাদের বনের কুটুম করে নিয়ে পালিয়েছে। সেই শুনে সিরাজ মণ্ডলের বউ জাহানারা বুক চাপড়ে কাঁদতে বসল— "ওগো! আমার এবার কী হবে গো!" তাকে গ্রামের আর কয়েকজন বউ শান্ত করতে এগিয়ে এল।
যারা পালিয়ে এসেছিল, তাদের একজন হল বিজন পাল। তার ভাই হল দশরথ পাল। সে মিলিটারি ব্যারাকে রাধুঁনির কাজ করে। ছুটিতে বাড়ি এসেছে। তার বাড়িতে একটা বন্দুক আছে। দশরথের বাবা রামচন্দ্র পাল সেটা কিনেছিলেন এককালে। দশরথ সেই বন্দুক নিয়ে ছুটিতে বাড়ি এলে পাখি আর খরগোশ মারার নাম করে বেরিয়ে পড়ে। তারপর রাস্তায় বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে সবাই মিলে নদীর পাড়ে গিয়ে গল্প করে। আর ফেরার পথে পরিমল মাঝির থেকে সকালের বাসি মাছ কিনে এনে বাড়িতে বলে— "বেরিয়েছিলাম তো পাখি মারতে। কিন্তু নদীর পাড়ে গিয়ে দেখি এত মাছ।" তারপর নদীর জলে নেমে কীভাবে খালি হাতে সে মাছ ধরেছে সেই গল্প শোনায়। বিজনের এক ছেলে এক মেয়ে। তারা গোল গোল চোখে খুড়োর কীর্তি শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে— "কাকা, তুমি খালি হাতে মাছ ধরা কী করে শিখলে?" দশরথ তার সরু গোঁফে একটা নকল পাক দিয়ে বলে— "মিলিটারি ট্রেনিং। হুঁ হুঁ। সে কী আর সহজ জিনিস রে!"
বাঘের কথা শুনে দশরথ লাফ দিয়ে নামল বাড়ির উঠোনে। পিঠে তার সেই পুরনো বন্দুক। পুরনো হলে কী হবে, দশরথ বড়ই আদরযত্ন করে সেটাকে। সময় পেলেই বন্দুকের কলকব্জা আর নলে তেল দিতে বসে সে। বছর ঘুরলে কাছের শহর থেকে কাঠের বাঁট পালিশ করিয়ে আনে। একেবারে চকচকে ট্রফির মতো ঝকঝক করছে সে বন্দুক।
"আজ এই বাঘের একদিন কি আমার একদিন। কোথায় সে বাঘ? একবার দেখিয়ে দাও। তারপর তার চামড়া খুলে ওই সিরাজ মণ্ডলের দোকানেই ঝুলিয়ে রাখব। এই গ্রামে ঢোকার আগে সব বাঘ দুবার ভাববে।"
কিন্তু দেখা গেল সিরাজের দোকানের দিকে কেউই আর যেতে আগ্রহী নয়। একজন পরামর্শ দিল— "বন দপ্তরকে একটা খবর দিলে হয় না?" দশরথ তার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল— "বন দপ্তরে আজ খবর দিলে তারা পরশু সন্ধেবেলা আসবে। ততক্ষণে বাঘ তার নিজের বনে ফিরে গিয়ে পেট উলটে ঘুমোবে। সিরাজ মণ্ডলের চিহ্নটুকু পাওয়া যাবে না।"
অগত্যা গ্রামের আর সবাইকে 'ভীতু, কাপুরুষ, ধর্মের ষাঁড়' এইসব বাছা বাছা বিশেষণে বিঁধতে বিঁধতে দশরথ হাতে বন্দুক, কাঁধে গুলির ব্যাগ আর ঘাড়ের ওপর একরাশ রাগ নিয়ে রাস্তায় নামল। কিছুটা এগিয়ে তার মনে হল ব্যাপারটা কি হঠকারিতা হয়ে গেল? বন্দুক সে ব্যবহার করেনি বহুদিন হয়ে গেছে। নিয়মিত বন্দুকের যত্ন নিলেও শেষ কবে বন্দুক চালিয়েছে সে নিজেও মনে করতে পারে না। জীবনে একটা পাখি বা খরগোশ সে মারেনি আজ পর্যন্ত। আজ কি একটা আস্ত বাঘ সে ঘায়েল করতে পারবে? কিন্তু এত ঘটা করে রাস্তায় নামার পর ফিরে গেলে গ্রামের সবাই দুয়ো দেবে। তাই কপালে যা থাকে ভেবে সে সিরাজ মণ্ডলের চায়ের দোকানের দিকে সাবধানে রাস্তার দু-দিক দেখতে দেখতে, আকাশের মেঘ দেখতে দেখতে, রাস্তার খানাখন্দ এড়িয়ে এগোতে লাগল।
বাঘ ওদিকে এক গেলাস চা আর একটা লেড়ো শেষ করে আর এক গেলাস চা শুরু করেছে। এবার সে নিয়েছে বাপুজি কেক। লেড়োর মতো কেক চায়ে ডোবাতেই থস করে সেটা চায়ের গ্লাসেই পড়ে গেল। সিরাজ মণ্ডল তাকে শেখাতে শুরু করল— "কেক এমনিই খেতে হয়। প্রথমে চা সুড়ুত। তারপর কেক খাউম।" সে হাত মুখের কাছে নিয়ে গিয়ে কেক খাওয়া নকল করে দেখায়। বাঘও তাকে অনুসরণ করে কেক খায়। মুখে দিলেই মিলিয়ে যায়। আহা! কী ভালো সোয়াদ।
"তোমার বাবা ভালো কেক বানায় সিরাজ।" আসলে বাপুজি কেক নাম শুনে বাঘ ভেবেছে কেকের অমন নাম সিরাজের বাপুজি বানায় বলে রাখা হয়েছে। সে কেক যে একদিন ছাড়া শহর থেকে পাইকার এসে দিয়ে যায়, সিরাজ মণ্ডল সে কথা বেমালুম চেপে গিয়ে আকর্ণ হাসে— "থ্যাংকিউ স্যার।" সে বাঘকে 'স্যার' বলতে শুরু করেছে। শুনেছে 'স্যার' বা 'ম্যাডাম' বলে ডাকলে নাকি লোকে খুশি হয়। বাঘও খুশি হবে নিশ্চয়। বনের বাঘ হলেও তার দোকানে আর পাঁচজনের মতোই চা খাচ্ছে তো।
বাঘ চায়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে গরুদের গাওয়া আগের রাতের গানটা হুঁ হুঁ করে গাইছে—
কতদিন পরে এল বাঘ
জঙ্গল পেরিয়ে আজ…
হঠাৎ গুড়ুম করে একটা আওয়াজ হল। বেশ দূরে। কিন্তু হল। বাঘ আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনে বলল, "আকাশ তো পরিষ্কার। তাহলে বাজ পড়ার শব্দ হল কেন?" সিরাজ মণ্ডল বনজঙ্গলে মানুষ। সে এই শব্দ চেনে। তাই কিন্তু-কিন্তু করে বলল, "স্যার, মনে হচ্ছে ওটা বন্দুকের শব্দ।" বাঘ একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল— "সে আবার কী জিনিস!" সিরাজ মণ্ডল আবার কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, "বন্দুক হল অস্ত্র।" তারপর একটু থেমে বলল, "বাঘ শিকার করে।" ততক্ষণে আবার গুড়ুম। এবার একটু কাছেই যেন শব্দটা।
বাঘ বুঝতে পারছে না কী করা উচিত। কেউ কেন তাকে মারতে চাইবে? সে তো কারও কোনও ক্ষতি করেনি। সে সিরাজ মণ্ডলের দিকে তাকিয়ে বলল, "কী করা যায় বলো তো?" সিরাজ মণ্ডল বুঝে উঠতে পারল না বন্দুকের নিশানায় দাঁড়িয়ে থাকা বাঘকে একজন মানুষ হয়ে কী পরামর্শ দেওয়া যায়। তাই সে মাথা থেকে খুলে রাখা ছাতাটা বাঘের দিকে এগিয়ে দিল— "এটা কাজ লাগাতে পারেন।"
বাঘ তৎক্ষণাৎ ছাতাটা নিয়ে বোতাম টিপে ফটাস করে খুলে ফেলল। তারপর সামনে দিকে ঢালের মতো ধরে বলল— "হুঁশিয়ার!"
দশরথ দূর থেকে বাঘকে চা খেতে দেখে গুলি চালিয়েছিল। তারপরও বাঘ একই জায়গায় বসে আছে দেখে সাহসে ভর করে আরেকটু এগিয়ে এসে আবার গুলি চালিয়েছিল। কিন্তু এখন বাঘটা ছাতা মেলে ধরে হুঁশিয়ারি দিতে সে দারুণ অবাক হল। এ আবার কেমন ধারা বাঘ! চা খায়! ছাতা খুলে হুমকি দেয়!
সে আরেকটু এগিয়ে এসে বলল, "খবরদার! আমার হাতে বন্দুক। চালাকি করলেই গুলি চালাব।"
বাঘও দমবার পাত্র নয় মোটেও। সেও তাল ঠুকে বলল, "সাবধান! আমার হাতে কালো ছাতা। গুলি চালালে ফল ভালো হবে না।"
এইভাবে একবার রামচন্দ্রের ব্যাটা দশরথ বন্দুক উঁচিয়ে তাল ঠোকে। আবার উলটোদিকে বাঘ ছাতা হাতে গর্জন করে। এই করতে করতে তারা একেবারে পাঁচ হাত দূরত্বে এসে গেল। দশরথকে দেখে সিরাজ মণ্ডল একগাল হেসে বলল— "দাশুদাদা চা খাবে?" দশরথ সিরাজকে দেখে দারুণ খুশি হল। যাক! বাঘ সিরাজের কোনও ক্ষতি করেনি। তার ওপর বাঘটা দেখতে যতই বড়সড় হোক, বেশ নিরীহই মনে হচ্ছে। তাই বন্দুক নামিয়ে রেখে বলল, "চা দিবি? দে এক গেলাস।" সেই দেখে বাঘও ছাতা গুটিয়ে বলল, "আমিও আর এক গেলাস চা খাব।"
চার
চা খেতে খেতে দশরথ বলল, "গ্রামের সবাই ভেবেছে তুমি সিরাজকে নিয়ে চম্পট দিয়েছ।"
বাঘ অবাক চোখে বলল, "সে কী! সিরাজ কি আচারের বয়াম নাকি যে ওকে নিয়ে চম্পট দেব?" তারপর একটু থেমে আর কথা খুঁজে না পেয়ে বলল, "সিরাজের বাবার বানানো কেক খুবই ভালো।"
দশরথ শেষ কথাটার মানে না বুঝতে পেরে বলল, "শোনো বাপু। তুমি বনের বাঘ বনেই ফিরে যাও। আমাদের গ্রামে এসে গোল কোরো না।"
বাঘও তার বনে ফিরে যেতে চায়। লোকালয়ে এসে এত দৌড় ঝাঁপ তারও পোষাচ্ছে না। তাই সে চায়ে চুমুক দিয়ে বলল— "আমি ফিরেই যাব। তবে একটা শর্ত আছে।"
কী শর্ত?
"আমায় তোমার এই বন্দুকটা দিতে হবে। এর আওয়াজটা বড়ই মিঠে।"
দশরথ আঁতকে উঠল। বাঘ বন্দুক চাইছে! সে ব্যস্ত গলায় বলল, "এটা কি হারমোনিয়াম নাকি যে আওয়াজ মিঠে বলে নিয়ে যাবে? এটা বন্দুক, এ দিয়ে আমরা তোমার মতো ত্যাঁদড় বাঘদের শায়েস্তা করে থাকি।"
বাঘও এবার রাগী গলায় বলল, "দ্যাখো বাপু। এই বন্দুক আমার পছন্দ হয়েছে। তোমার মতো এঁড়ে মানুষ বনে এলে তাদের তাড়াতে এ যন্ত্র বড়ই কাজে লাগবে।"
দশরথ পাল বন্দুক দেবে না। বাঘও ছাড়বে না। দুজনের মধ্যে জোর বচসার মাঝে দশরথ রেগে গিয়ে বাঘকে যেই বলেছে 'ইতর ছোটলোক', বাঘ ফট করে রেগে গিয়ে 'তবে রে' বলে হুংকার দিয়ে ঝট করে দশরথকে আস্ত গিলে ফেলল। পাশে পড়ে রইল দশরথের গুলির ব্যাগ, বন্দুক আর চায়ের গেলাস। সিরাজ মণ্ডল এর আগে এভাবে বাঘকে মানুষ খেতে দেখেনি। ভয়ে তো তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। ছুটে পালাবে সেই শক্তিটুকুও নেই তার।
কিন্তু পাঁচ সেকেন্ডও লাগল না 'হে-উ-উ-উ' করে বমি তোলার মতো করে আবার দশরথকে উগরে দিল বাঘ। তারপর থাবার উলটো দিক দিয়ে ঠোঁট আর গোঁফ মুছে, মুখ ভেটকে, নাক সিঁটকে বলল, "তোমার গায়ে কীসের গন্ধ?"
আগেই বলেছি, দশরথ মিলিটারি ব্যারাকের হেঁশেলে হাঁড়ি ঠেলে। তাই তার গায়ে হরেক মশলার গন্ধ— জিরে, ধনে, গুঁড়ো লঙ্কা, আদা, রসুন, এলাচ, লবঙ্গ, চিটে গুড়, সরষের তেল… লিস্টি বানাতে বসলে শেষ হতে কয়েকদিন লেগে যেতে পারে। সাধারণ মানুষ সেসব গন্ধ পায় না ঠিকই, কিন্তু বাঘের ঘ্রাণশক্তি তো মারাত্মক। তাই তার নাক এড়ানো মুশকিল।
একটা বাঘ একটা মানুষের গন্ধে বমি করে ফেলেছে এটা দশরথের জন্যে যথেষ্ট অপমানেরই বটে। কিন্তু এই গন্ধের জোরেই তার প্রাণে বেঁচেছে বলে সে বিশেষ ট্যাঁ-ফোঁ করল না।
বাঘের নালেঝোলে মাখামাখি হয়ে কোনোরকমে উঠে দাঁড়াল দশরথ। তারপর তার বন্দুক আর গুলির ব্যাগ বাঘের হাতে তুলে দিয়ে বলল, "এই নাও বন্দুক আর এই রইল গুলি। যা পারো করো। এবার আমায় যেতে দাও।"
কিন্তু 'যা পারো করো' বললেই হল? বাঘ তো জানেই না কী করে বন্দুক চালাতে হয়। অগত্যা দশরথ তার ব্যাগ থেকে গুলি বের করে বন্দুকে ভরল— "এই গুলি ভরলাম।" তারপর বন্দুকের কুঁদ কাধে ঠেকিয়ে দাঁড়াল সে— "এবার নিশানা লাগিয়ে এই দ্যাখো ঘোড়া…" তার আঙুলটা নিয়ে গেল বন্দুকের ট্রিগারে— "এভাবে টিপে দিলেই গুলি বেরোবে।" বলে সে দুম করে গুলি চালাল। ভাগ্যি বাঘ বেরিয়েছে শুনে রাস্তাঘাটে কেউ নেই। দূরে একটা গাছের ওপর কিছু পাখি বসেছিল। তারা ঝটপট করে উড়ে গেল গুলির শব্দে।
বাঘ এবার দশরথের হাত থেকে বন্দুক নিয়ে তার নকল করে টোটা ভরল বন্দুকে— "এই গুলি ভরলাম।" তারপর বন্দুক বাগিয়ে সে এক চোখ বন্ধ করে নিশানা লাগাতে গেল। কিন্তু আশেপাশে কোনও কিছুই নেই। তাই সে বন্দুক হাতে ঘুরল সিরাজ মণ্ডলের দিকে— "সিরাজ ভাই, তুমি আমার নিশানা হবে?" শুনেই সিরাজের আত্মারাম খাঁচাছাড়া। এ বাঘ বলে কী! সে কোনোমতে তুতলে বলল, "স্যার, একটাই মাত্র প্রাণ আমার। আপনার গুলিতে সেটা উড়ে গেলে আমি খাব কী?" বাঘ ঘাড় নাড়ল— "ঠিক!" এবার সে ঘুরল দশরথের দিকে। দশরথ চটজলদি উত্তর দিল— "আমার গায়ে গন্ধ।" বাঘ আবারও ঘাড় নাড়ল—"ঠিক!" তাহলে নিশানা কোথায় লাগাবে সে?
সমাধান করল দশরথই। সে সিরাজের একটা চায়ের গেলাস নিয়ে বসাল বেঞ্চের ওপর। তারপর বাঘকে বলল, "তুমি গুনে গুনে তিরিশ পা পিছিয়ে যাও রাস্তার ওদিকে। তারপর ওদিক থেকে ওই চায়ের গ্লাসে নিশানা লাগাও।"
বাঘ সেই মতো মেপে মেপে তিরিশ পা পিছিয়ে বেশ কসরত করে নিশানা লাগাল— "এইবার!" বলেই বন্দুকের ট্রিগার টানল সে। গুড়ুম আওয়াজ হল। আর একই সঙ্গে বেঞ্চের ওপর থাকা চায়ের গেলাস 'কড়াক' শব্দ করে উড়ে গেল বেমালুম। বাঘ আনন্দে লাফিয়ে উঠল— "আবার! আবার!"
অতএব আবার বাঘ বন্দুকে গুলি ভরে আরেকটা গেলাস রেখে নিশানা লাগাল। আবার গুড়ুম! আবার কড়াক!
বাঘের নিশানা দেখে দশরথ আর সিরাজের তো চোখ কপালে উঠে গেছে। এমন বাঘ যত তাড়াতাড়ি বনে ফেরে ততই মঙ্গল। তাই দশরথ একটু ব্যস্ত গলায় কবজি উলটে ঘড়ি দেখে বলল, "অনেক বেলা হল। আমি এখন চলি, বাড়িতে কিছু কাজ আছে।" বাঘ তখন গুলি চালানোর মজা পেয়েছে, তাই একটু বিরক্ত হয়ে বলল, "বাড়িতে আবার কী কাজ তোমার?" দশরথ আমতা আমতা করছে দেখে সিরাজ পাশ থেকে বলল, "খই ভাজার কাজ। দাশুদা রাঁধুনি তো।" তারপর মিহি গলায় বলল, "আমারও কিছু কাজ ছিল।" একটু ভেবে ঘাড় চুলকে বলল, "আমার বাড়িতে ভ্যারেন্ডা ভাজার ব্যাপার আছে আজ। বউ একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছিল।"
দুজনেই পা ঘষছে দেখে বাঘ একটু মুষড়ে পড়ল। সে বলল, "আমি কি তাহলে একা-একাই নিশানা লাগাব?"
দশরথ ব্যস্ত হয়ে বলল, "না না, এই বন্দুক আর গুলির ব্যাগ নিয়ে তুমি বনে চলে যাও। সেখানে নিশানা লাগানোর নানা কিছু পাবে তুমি। গাছে পাখি, মাটিতে খরগোশ, জলে মাছ।" শুনে বাঘ বেশ আনন্দিত হল। বন্দুকটা এক কাঁধে আর গুলির ব্যাগ আরেক কাঁধে ঝোলাল সে। তারপর আচারের বয়ামটা বগলে গুঁজে সিরাজ মণ্ডলের দিকে তাকাল— "ছাতাটাও নেব? কেমন স্যাট করে খুলে ফেলা যায়।"
কালো ছাতাটা আসলে ইলিয়াস গাজীর। সে গত দু-মাস ধারবাকিতে চা খেয়ে চলেছে। সিরাজ তাকে পয়সা মেটানোর কথা তুললেই বলে— "আরে! ঠিক দিয়ে দেব। আমি কি আর পালিয়ে যাচ্ছি?" সিরাজ তাই ঘটাঘট মাথা নাড়াল— "হ্যাঁ হ্যাঁ, নিয়ে যান। বৃষ্টি-বাদলার দিনে কাজ লাগবে।"
বাঘ এক কাঁধে বন্দুক, আরেক কাঁধে গুলির ব্যাগ, এক বগলে আচারের বয়াম আর কাঁধে ছাতা ফেলে বনের দিকে হাঁটা দিল। তার যাওয়ার রাস্তার দিকে তাকিয়ে দশরথ পাল দীর্ঘশ্বাস ফেলল—"বাবার বন্দুকটা শেষ পর্যন্ত বাঘে নিয়ে গেল রে সিরাজ।" সিরাজ মণ্ডল অস্ফুটে বলল— "পিতৃদত্ত প্রাণ যে বাঘের পেটে গিয়ে ফিরে এল সে কী কম কথা গো দাশুদা!"
দশরথ তার কথায় সায় দিয়ে ঘাড় নাড়ল— "চল গ্রামে ফেরা যাক।"
একটা বাঘ বন্দুক নিয়ে আর দুজন মানুষ তাদের প্রাণ নিয়ে নিজের নিজের বাড়ির দিকে রওনা দিল।
- [গল্পটি Shel Silverstein-এর Lafcadio, the Lion Who Shot Back থেকে অনুপ্রাণিত]
- (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)