উত্তমকুমার: এক বন্দুকবাজ বাঘের গল্প
(গত সংখ্যার পর)
পাঁচ
বাঘ বন্দুক নিয়ে বনে এসেছিল বৈশাখ মাসের শেষের দিকে। তারপর সারা জ্যৈষ্ঠ মাসের গরমে সে নিশানা লাগিয়ে গেছে তার বন্দুকে। তবে সে দশরথ পালের কথা শুনে গাছের পাখি, মাটির খরগোশ বা জলের মাছে তার নিশানা অভ্যাস করেনি। বাঘেরা খিদে না পেলে শুধু শুধু কোনও জীবজন্তু মারে না তো, তাই। তার বদলে সে মরা একটা গাছের শুয়ে পড়া গুঁড়ির ওপর মাটির ঢেলা সাজিয়ে সেগুলো গুলি করে ওড়াত। গুড়ুম! ছ্যাড়াক! গুড়ুম করে গুলি আর ছ্যাড়াক করে ঢেলার ফেটে যাওয়া। গুড়ুম! ছ্যাড়াক!
আশেপাশের বাঘেরা রীতিমত বিরক্ত হয়ে উঠল বাঘের এমন নতুন বিদঘুটে শখের ঠেলায়। তাদের মধ্যে সবথেকে বুড়ো যে বাঘ, সে একদিন বলল, "বাপ, মানুষের রীতি রেওয়াজ কোনোদিনও ভালো নয়। বন্ধ কর এসব। এই আওয়াজে আমার দিনের ঘুম মাটি হয়েছে। রাতে স্বপ্ন দেখি বন্দুক হাতে শিকারি এসে আমার ছাল ছাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আর সে কী জ্বলুনি।" বুড়ো বাঘের জ্বলুনির কারণ অবশ্য ভিন্ন।
দু-তিনদিন আগে বন থেকে মধু নিতে আসা একটা মানুষের দল থেকে একজন মানুষকে জোর করে বাঘেরা নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল তাদের ডেরায়। কিন্তু বাঘেদের আদর-যত্নের মায়া ত্যাগ করে- সে কী করে কে জানে পালিয়ে যায়। তবে মানুষটাকে না পেলেও, বাঘেরা তার জমা করা মধুর বড় ক্যানেস্তারাটা হাতিয়ে নিয়ে আসে।
তারপর বাঘেদের সারা পাড়া ভাগ-বাঁটোয়ারা করে সেই মধু খায়। বুড়ো বাঘ সামান্য বেশি মধুই পেয়েছিল তার ভাগে। কিন্তু বয়স হয়েছে তো। তাই অত মধু একসঙ্গে খাওয়ার ফলে তার গা চুলকোতে শুরু করে। তার সঙ্গেই পেট ফেঁপে গ্যাস হয়ে তার প্রাণ যায়-যায় অবস্থা। সেই সময় কেউ যদি কানের কাছে গুড়ুম গুড়ুম করে বন্দুক দাগে, কার না অসহ্য লাগে।
সত্যি বলতে কী, ক-দিন পরে বাঘের নিজেরও একঘেয়ে লাগতে শুরু করল। তখন সে হরিণ আর খরগোশ ধরে খাওয়ার সময় মাংসের মাঝে দাদির দেওয়া সেই আচারের বয়াম থেকে লেবুর জারক রেখে খেত। সেই টোকো আচার খেয়ে তার মুখের স্বাদ আর মনের আনন্দ দুই-ই ফিরে আসত। তখন আবার শুরু হত গুড়ুম! ছ্যাড়াক! গুড়ুম! ছ্যাড়াক!
প্রথম প্রথম বাঘ দু-পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে দু-হাতে বন্দুক ধরে মানুষের মতো গুলি চালাত। তারপর সে শুয়ে পড়ে পিঠের ওপর বন্দুক ধরে লেজ দিয়ে বন্দুকের ঘোড়া টিপতে শুরু করল। তার ওপর বাঘ মাথায় ভর দিয়ে শীর্ষাসনের মতো করে দাঁড়িয়ে পেছনের দু-পা দিয়ে বন্দুক চালাতে শুরু করল। এইভাবে মাসখানেকের মধ্যেই সে হয়ে উঠল দুনিয়ার সেরা বন্দুকবাজ বাঘ।
এই করতে করতে এসে গেল আষাঢ় মাস। বাঘ তখন সিরাজ মণ্ডলের দেওয়া সেই কালো ছাতা মাথায় দিয়ে ঝুপঝুপ বৃষ্টির মাঝে বন্দুক চালাত। শ্রাবণ মাসের শেষে বাঘ আবিষ্কার করল, তার গুলির ব্যাগে সামান্য ক-টা গুলিই আর পড়ে আছে। এখন উপায়?
মানুষদের গ্রামে গিয়ে দশরথ পালের থেকে আবার গুলি চেয়ে নিয়ে আসা যায়। কিন্তু বাঘ তো দশরথ পালের বাড়ি চেনে না। সেক্ষেত্রে সিরাজ মণ্ডলের দোকানে গিয়ে দশরথের বাড়ির ঠিকানা চাওয়া যেতে পারে। আর ফেরার সময় একবার যদি কামালদের বাড়ি ঘুরে আসা যায়। দাদির সঙ্গে দেখা করে আর এক বয়াম আচার যদি জোগাড় করা যায়। বলা তো যায় না, হয়তো তারা চালের আটার রুটি আর খাসির মাংসের সুরুয়া খাওয়াতেও পারে।
বাঘ একটা গাছের উঁচু ডালে বসে মনে মনে এইসব হিসাব কষছে। হঠাৎ দেখল দূরে ঝোপঝাড় নড়ছে। বনের জীবজন্তুদের চলন একটু অন্যরকম। তাদের চলাফেরায় যেভাবে গাছপালা নড়ে এ তেমন নয়। এই নড়াচাড়া একটু অগোছালো, অভদ্র। বাঘ এক মুহূর্তে বুঝে ফেলল। মানুষ! একটা মানুষ এসে হাজির হয়েছে তাদের পাড়ায়!
এমনিতে বাঘেদের পাড়ায় জোর করে মানুষদের ধরে আনতে হয়। কিন্তু আজ মানুষ নিজে থেকে এসেছে তাদের সঙ্গে দেখা করতে। তাও আবার একটা মানুষ নয়, দু-দুটো। তার মধ্যে সামনের জনকে কেউ চেনে না। কিন্তু পেছনে রয়েছে মধুর ক্যানেস্তারা ফেলে পালিয়ে যাওয়া সেই ভিতু লোকটা। দেখতে দেখতে সেই দুটো মানুষকে ছ-টা বাঘ ঘিরে ফেলল। কিন্তু কেউ কিছু করার আগেই গাছের ওপর থেকে আমাদের বন্দুকবাজ বাঘ হুংকার দিয়ে উঠল— "খবরদার!" তারপর বন্দুক কাঁধে তুড়ুক করে নেমে এল সে মাটিতে।
হয়েছে কী, সামনের যে লোকটা, যে কিনা গোলাপি একটা টুপির ওপর সবুজ পালক পরে, যার কিনা মুখভর্তি কাঁচা-পাকা দাড়ি আর পরনে হলুদ একটা কোর্ট-প্যান্ট আর পায়ে বাদামি জুতো, সে হাতে ধরে আছে একটা সাদা পতাকা। আর কে না জানে, সাদা পতাকা মানেই সাত খুন মাপ। মানে তুমি শান্তিতে দুটো কথা বলতে এসেছ, কেউ তোমার কিচ্ছুটি করতে পারবে না।
পেছনের লোকটার গায়ে একটা হাফ হাতা নীল শার্ট আর পরনে একটা সবুজ-নীল চেক লুঙ্গি। তার হাতেও একটা সাদা পতাকা ছিল। কিন্তু চারদিকে এত বাঘ দেখে ঠক-ঠক করে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে হাতের পতাকা ফেলে সে দু-হাত ওপরে তুলে দিয়েছে। তোমরা তো জানোই, দু-হাত ওপরে তুলে দেওয়া মানে আবার আট খুন মাপ। অতএব, সব মিলিয়ে মানুষ দুটোর চারদিকে গোল করে ঘিরে থাকল ছ-টা বাঘ। আর তাদের সামনে এসে বন্দুক কাঁধে দাঁড়াল আমাদের চেনা সেই বাঘটা।
সে কিছু বলার আগেই সামনের গোলাপি টুপি লোকটা হাত বাড়িয়ে দিল হাত মেলানোর জন্যে। তারপর গলগল করে হেসে বলল, "হাই, আমার নাম হারুণ আল রশিদ।" এত বাঘ দেখে লোকটা মোটেও ভয়-টয় পায়নি।
বাঘ একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, "আমাদের পাড়াও কোনও মানুষ তো আসতেই চায় না এমনিতে। জোর করে ধরে আনতে হয়। তুমি এভাবে চলে এসেছ যে?"
লোকটা, যারা মাথায় গোলাপি টুপি আর সবুজ পালক, নাম বলেছে হারুণ আল রশিদ, সে একই রকম হাসিমুখে বলল, "কী বলো তো? বাঘ-সিংহ-হাতি-গণ্ডার হরেক জন্তু জানোয়ার নিয়ে আমার বরাবরের কারবার। আগে ইস্কুলে পড়াতাম। সেখানে এত তাড়াতাড়ি এত ছেলে মানুষ হয়ে যেত শুরু করল যে সরকার থেকে আমায় আলিপুর চিড়িয়াখানায় পাঠিয়ে দেয়। সেখানে দুটো হাতি এমন বাঁদরামি শুরু করেছিল।"
তারপর একটু থেমে বলল, "কিন্তু মুশকিল হল, সব জানোয়ার মানুষ হয়ে গেলে চিড়িয়াখানা চলবে কী করে? তাই চিড়িয়াখানা ছেড়ে আমি সার্কাস কোম্পানি খুললাম।" তারপর লোকটা ডানহাত আর বামহাত রামধনুর মতো মাঝখান থেকে অর্ধবৃত্তাকারে দু-প্রান্তে নিয়ে গেল, যেন তার সার্কাসের সাইনবোর্ড — "হারুণ আল রশিদের দারুণ আল সার্কাস।"
সার্কাসের নাম শুনে বাঘ মুকমুক করে হেসে বলল, "তা এখানে কী করতে এসেছ তুমি?"
হারুণ আল রশিদ তার পেছনের সেই গোবেচারা লোকটার দিকে দেখিয়ে বলল, "অলোক আমায় বলছিল ও নাকি বনের মধ্যে একটা বাঘকে বন্দুক চালাতে দেখেছে। তাই ভাবলাম গিয়ে দেখে আসি কেমন সে বাঘ।"
ছয়
হারুণ আল রশিদ আসলে শুধু বাঘকে দেখতেই আসেনি, সে এসেছে বাঘকে নিজের সার্কাসে নিয়ে যেতে। সেই কথাটাই সে শেষমেশ পাড়ল— "ভাবছিলাম যদি আমার সার্কাসে আপনি একবারটি আসেন। আপনি মনের সুখে বন্দুক চালাবেন। একটা বাঘের চাকরি এমনিই খালি আছে।" এই কথাটা যেই না বলেছে, অমনি বুড়ো সেই বাঘ হুংকার দিয়ে এগিয়ে এল— "এত বড় সাহস! বাঘকে চাকরি! আমরা তোমার চাকর?" ঘ্যাঁক করে ঝাঁপ দিল সে হারুণ আল রশিদের মাথা লক্ষ্য করে। তার ইচ্ছে ছিল থাবার এক ঘায়ে মুন্ডুটা উড়িয়ে দেয়। কিন্তু আশ্চর্য ভঙ্গিতে হারুণ আল রশিদ একপাশে সরে গেল। আর বুড়ো বাঘ তাকে ছুঁতেও পারল না, থপ করে গিয়ে পড়ল মাটিতে।
তারপর আবার হারুণ আল রশিদের দিকে ঘুরে দাঁত কিড়মিড় করে যেই বলেছে "ঘ্র্যাঁ-অ্যা-অ্যা-অ্যা!"; হারুণও অমনি হাত বাড়িয়ে বাঘের কানের পেছন থেকে তুড়ি মেরে নিয়ে এল একটা গাঁদা ফুল। বাঘেদের আসলে গাঁদা ফুল খুব পছন্দ। হারুণ তাই ফুলটা বুড়ো বাঘের নাকের কাছে ধরল। বুড়ো বাঘও আর কোনও কথা না বলে খপ করে ফুলটা মুখে নিয়ে চিবোতে শুরু করল।
হারুণ মুচকি হেসে বলল, "সার্কাসে আমি ম্যাজিক দেখাই।"
বাঘ আগে কখনও ম্যাজিক দেখেনি। তাই তার মুখ হাঁ হয়ে গেল। সুযোগ বুঝে একটা মাছি বোঁ করে তার মুখের মধ্যে ঢুকে একটা ডিগবাজি খেয়ে আবার বেরিয়ে এল। যে সার্কাসে শূন্য থেকে ফুল এনে এমন ম্যাজিক দেখানো হয়, সেখানে সে বন্দুক চালাবে এটা ভাবতেই বাঘের রোমাঞ্চ হল। তাই সে জিজ্ঞাসা করল, "তোমার সার্কাসে আর কী কী হয়?"
হারুণ আল রশিদ তার দাড়ি চুলকোতে চুলকোতে বলল, "একটা গণ্ডার আছে, তার নাম র্যাম্বো। সে ট্রাপিজের খেলা দেখায়। শূন্যে ডিগবাজি খেতে খেতে এক দোলনা থেকে আরেক দোলনায় যায়।" তারপর এক মুহূর্ত থেমে গিয়ে জিভ কেটে বলল, "সরি, ট্রাপিজের খেলা দেখায় জিপসি নামের একটা জেব্রা। র্যাম্বো তার শিঙের সঙ্গে দড়ি বেঁধে বড় বড় লরি-ট্রাক টেনে নিয়ে যায়।"
বাঘ দারুণ উৎসাহ পেয়ে বলল, "আর? আর?"
"তারপর ধরো একটা হাতি," হারুণ আল রশিদও চকচকে চোখে আবার শুরু করেছে, "সে শুঁড়ে একসঙ্গে পাঁচটা ছুরি পাকড়ে ছুঁড়ে দেয়। সামনে রাখা পাঁচটা টেবলে পাঁচটা আপেলের ঠিক মাঝখানে গিয়ে লাগে সেই ছুরিগুলো।"
বাঘ নিজের কানকে বিশ্বাসই করতে পারছে না। সে ছোট থেকেই সুন্দরবনে মানুষ। তার জীবনে বন্দুক আসার আগে সবথেকে রোমাঞ্চকর ঘটনা ছিল একটা শেয়ালকে নিয়ে। সেই শেয়াল নদীর পাড়ে পাঁকে ঘেঁটে কালো ভূত সেজে এসে বাঘেদের দারুণ ভয় দেখিয়েছিল। তাই উড়ন্ত জেব্রা, পালোয়ান গণ্ডার আর নিশানাবাজ হাতির কথা শুনে তার আর তর সইছিল না। সে আগ্রহ ভরে জিজ্ঞাসা করল, "আমি সেখানে গেলে আমায় যত খুশি বন্দুক চালাতে দেবে? এখানে আমার গুলি প্রায় শেষ।"
হারুণ আল রশিদ মাথা নেড়ে বলল, "আলবাত!"
বাঘ জিজ্ঞাসা করল, "আর আচার?"
হারুণ আল রশিদ এই প্রশ্নটা বুঝতে না পেরে বলল, "আচার মানে?"
বাঘ তখন কামালের দাদির দেওয়া আচারের বয়ামটা এনে দেখাল, "এই দ্যাখো ঠাকুমার দেওয়া আচারও প্রায় শেষ। আমার কিন্তু আচার দরকার মাংসের সঙ্গে।"
হারুণ আল রশিদ পা ঠুকে বলল, "জরুর!"
শেষে বাঘ বলল, "আর আমার কিন্তু তোমার মতো একটা টুপিও দরকার। লাল রঙের, তার ওপর থাকবে একটা হলুদ পালক। আর একটা কোট, সবুজ রঙের।"
হারুণ আল রশিদ বুক চাপড়ে বলল, "মঞ্জুর!"
বাকি বাঘদের বিদায় জানিয়ে হারুণ আল রশিদ আর অলোকের সঙ্গে আমাদের গল্পের বাঘ গিয়ে বসল একটা নৌকায়। বাঘ সঙ্গে এনেছে তার বন্দুক আর গুলির ব্যাগ। আচারের বয়ামটা সে দিয়ে এসেছে বুড়ো বাঘকে। ক-দিন ধরেই বলছে খাবারে রুচি নেই। দাদির লেবুর আচার খেয়ে মুখে যদি স্বাদ ফেরে। আর কালো ছাতাটা সে রেখে এসেছে একটা গাছের ওপর একটা কোটরের পাশে। সেখানে একটা মা-পাখি তার দুটো বাচ্চাকে নিয়ে থাকে। ঝড়-জল বা শীতে হয়তো ওদের কাজে আসবে।
নৌকায় মোটর লাগানো। অলোক নৌকা চালানোর জন্যে বসল পেছনে। হারুণ আল রশিদ গেল সামনে। আর মাঝে বসল বাঘ। ভুট ভুট করতে করতে কিছুক্ষণের মধ্যেই নদী পেরিয়ে তারা এসে পড়ল মানুষের এলাকায়। পাড়ে উঠেই হারুণ আল রশিদ অলোককে তার টাকা পয়সা মিটিয়ে দিয়ে বলল, "ওই দ্যাখো, আমার গাড়ি।" বাঘ দেখল লাল রঙের একটা চৌকো লম্বা জিনিস, তার নিচে চারটে গোল কালো জিনিস। বাঘ তো এর আগে কখনও গাড়ি দেখেনি, তাই জিজ্ঞাসা করল, "আমরা এর পিঠে চাপব?"
হারুণ আল রশিদ তখন দরজা খুলে তাকে বসাল পেছনের সিটে। তারপর নিচে সামনে গিয়ে ড্রাইভারের সিটে বসল। গাড়ি চালু হল ঘ্র-র-র-র শব্দে। বাঘ সেই আওয়াজের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ডাকল– "গ্র-র-র-র!"
রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে সামনে একপাল ছাগল পড়ল। হারুণ গাড়ির হর্ন বাজাল 'প্যাঁ-পোঁ প্যাঁ-পোঁ'। বাঘ দারুণ মজা পেয়ে নকল করে ডাকতে লাগল— "ঘ্যাঁকো! ঘ্যাঁকো!" বাঘের এমন বিচিত্র ডাকে ছাগলের দল এক নিমেষে ছুট। আর যে রাখাল তাদের নিয়ে আসছিল, সে গাড়ির মধ্যে বাঘ বসে আছে দেখে চোখ কপালে তুলে তাকিয়ে রইল।
তারপর রাস্তায় পড়ল একটা বড় স্পিডব্রেকার। গাড়ি যেই লাফিয়ে উঠেছে, বাঘও ধুপ করে সিট থেকে পড়ে গেছে। তারপর ঘ্যাঁ-ঘ্যাঁ করে সে কী হাসি তার! হারুণের কাছে বায়না জুড়ল— "আবার! আবার!"
এভাবে নানা মজার জিনিস ঘটতে লাগল সারা রাস্তা। বাঘ শেষে ক্লান্ত হয়ে পেছনের সিটে চার পা তুলে লেজটা গুছিয়ে নিয়ে ঘুমিয়েই পড়ল। তার নাক ডাকতে লাগল— ফু-র-র-র! ফু-র-র-র! সে বুঝতেই পারল না কখন হারুণ আল রশিদের গাড়ি এসে পৌঁছেছে কলকাতা শহরে।
বাঘের ঘুম ভাঙল যখন একটা বড় আর উঁচু হোটেলের সামনে এসে গাড়ি থামল। সে হাই তুলে মাথা চুলকোতে চুলকোতে জিজ্ঞাসা করল, "আমরা সার্কাসে এসে গেছি?" হারুণ আল রশিদ বলল, "সার্কাসে আমরা কাল যাব। এখন এই হোটেলে আজকের দিনটা থাকতে হবে।" সে গাড়ির দরজা খুলতে বাঘ নেমে এল। তারপর দুজনে হোটেলের দরজার দিকে এগোতেই দারোয়ানের তো চোখ ছানাবড়া। একটা আস্ত রয়াল বেঙ্গল টাইগার তাদের হোটেলে! সেই বাঘের কাঁধে আবার বন্দুক। কোনোরকমে সে বলল, "মাই ঘড!" তারপর জ্ঞান হারিয়ে ধুপ করে পড়ে গেল।
বাঘ তাকে ডিঙিয়ে হোটেলের লবিতে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে হোটেলের ম্যানেজার এগিয়ে এসে সবগুলো দাঁত বের করে কান পর্যন্ত হেসে হারুণ আল রশিদকে বলল, "স্যর, এটা মানুষের হোটেল। এখানে বাঘ একেবারেই রাখা যাবে না। আয়াম সরি!" সেই শুনে বাঘ বলল, "গ্র-র-র-র!" ম্যানেজার আবারও একই রকম হেসে বাঘের দিকে তাকিয়ে বলল, "অবশ্য আপনি যদি বলেন গ্র-র-র-র, তাহলে আমার সত্যিই কিছু করার নেই।"
পনেরোতলার ওপর একটা ঘর বুক করে হারুণ আর রশিদ আর বাঘ এগোল লিফটের দিকে। বোতাম টিপতে একটা লিফটে দরজা খুলে গেল। ভেতরে যে লিফটম্যান ছিল, সে বলল, "স্যর, লিফটে তো বাঘ ঢুকতে দেওয়া যায় না।" সেই শুনে বাঘ বলল, "গ্র-র-র-র!" তখন লিফটম্যান বলল, "অবশ্য বাঘ গ্র-র-র-র করলে তাকে ঢুকতে দেওয়াই যায়।" হারুণ আল রশিদ আর বাঘ গিয়ে পৌঁছাল পনেরোতলায়। দুজনের দুটো আলাদা ঘর। বাঘকে হারুণ বলল, "তুমি স্নান সেরে নাও। তারপর নিচে খেতে যাব একসঙ্গে।"
সাত
বাঘ এর আগে কখনও হোটেলের ঘরে থাকেনি। সত্যি বলতে কী, সে কোনও ঘরেই কখনও থাকেনি। তাই সে প্রথমে বেডরুমে এসে বড় ঢাউস বিছানায় উঠল। কী নরম! বনের লম্বা ঘাসগুলোর ওপর গড়ালে এরকম লাগে। এতক্ষণ পরে এই প্রথম তার ছেড়ে আসা বনের জন্যে একটু মন কেমন করল। তারপর দেখল বিছানার ঠিক সোজাসুজি একটা বড় কালো কাচ লাগিয়ে রেখে গেছে কেউ। বাঘ সেদিকে এগিয়ে গেল। অস্পষ্টভাবে ওদিকে আর একটা বাঘ। সে জানে ওটা তার ছায়া, নদীতে জল খেতে গিয়েও দেখেছে সে। বাঘেরা অত বোকাও নয়, যতটা ভাবছ।
কিন্তু এই বড় কালো কাচটা যে আসলে একটা টেলিভিশন, সেটা তো বাঘ জানে না। এদিকে বিছানার ওপর রাখা ছিল টিভির রিমোট কন্ট্রোল। বাঘ আর এক পা এগোতেই তাতে পা পড়ে টিভি চালু হয়ে গেল বিকট শব্দে। টিভিতে তখন রোদ্দূর রায় নামে একজন গান গাইছিল। সেই গান শুনে পড়িমরি করে বাঘ গিয়ে ঢুকল বাথরুমে। ধাম করে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে একটু শ্বাস নিয়ে বাঘ আরও অবাক হল।
ভেতরে একটা বড় আয়না। তাতে তার গোঁফ থেকে লেজ সব দেখা যাচ্ছে। বাথরুমের একদিকে একটা বড় চৌবাচ্চা। সেটাতে কী হয় বাঘ জানে না। তাই সে গিয়ে বসল চৌবাচ্চার মধ্যে। চৌবাচ্চার একদিকে দুটো হাতল।
বাঘ একটা হাতল ধরে টানতেই ওপর থেকে জল পড়তে শুরু করল। আচমকা এমন বৃষ্টি শুরু হয়েছে দেখে বাঘ হাঁচোড়পাঁচোড় করে চৌবাচ্চা থেকে উঠতে গেল। কিন্তু খুব পিছল কি না, তাই আবার সে এসে পড়ল চৌবাচ্চার মধ্যেই। ততক্ষণে জলে তার গোঁফ, কান, মাথা, পিঠ সব ভিজে গেছে। আর লাফালাফি করতে গিয়ে পাশে রাখে একটা শ্যাম্পুর বোতল পড়েছে জলে। তার থেকে যখন জলে ফেনা বের হতে শুরু করল বাঘ দারুণ অবাক হয়ে গেল।
নদীতে এর আগে সে যে গা ডুবিয়ে বসে থাকত না, তা নয়। কিন্তু এখানে দারুণ মজা। কী রকম ভুসভুসে জলে থুসথুসে ফেনা। বাঘ জলে থাবা চালাতে চালাতে বেশ আনন্দ পেয়েছে। তাই মনের সুখে সে তার জানা একমাত্র গানটা গাইতে শুরু করল—
কতদিন পরে এল বাঘ
জঙ্গল পেরিয়ে আজ
ঘরে রোদ্দূর রায়ের গান, বাথরুমে বাঘের গান। হোটেলের সেই ফ্লোরে যত লোক ছিল, সবাই একযোগে ফোন করে রুম সার্ভিসে খবর দিল হোটেলে হয় ডাকাত পড়েছে, নাহলে ভূমিকম্প হচ্ছে। ভয়ে তারা ইতিমধ্যেই আধমরা। এরপর অজ্ঞান হয়ে গেলে যেন ধরে হাসপাতালে দিয়ে আসা হয়।
এমন অভিযোগ পেয়ে রুম সার্ভিসের লোক দৌড়ে এল বাঘের কামরায়। প্রথমে সে টিভির সুইচ বন্ধ করল। তারপর বাথরুমে গিয়ে শাওয়ার বন্ধ করল। বাঘ তখনও নিজের মনেই চৌবাচ্চার জল থাবড়ে থাবড়ে গান গাইছে। রুম সার্ভিসের যে লোকটা এসেছিল, তার নাম মুর্জা। সে দু-বার গলাখাঁকারি দিতে বাঘ চুপ করল। তারপর একটু ধাতস্থ হয়ে জিজ্ঞাসা করল, "কী ব্যাপার?"
মুর্জা বলল, "আসলে স্যর আপনি সামান্য জোরে গান গাইছিলেন, তাই হোটেলের আর সবাই কমপ্লেন করছে।"
বাঘ একটু লজ্জা পেল, "আসলে আমি কোনোদিন এমন ফেনাওয়ালা জলে চান করিনি কি না। তাই খুব আনন্দ হচ্ছিল।"
মুর্জা বুঝল বাঘ কখনও শ্যাম্পু-সাবান মাখেনি। তখন সে তার জামার হাতা গুটিয়ে বেশ খানিকটা শ্যাম্পু নিয়ে বাঘের মাথায় ঘষে ঘষে মাখাতে শুরু করল। আরামে বাঘের চোখ বুজে এল। তারপর চোখ খুলে দেখে তার মাথায় একগাদা ফেনা, যেন বাবরি চুল। মুর্জা তখন কানের দুদিকে ফেনা দিয়ে লম্বা দুটো শিং বানিয়ে দিল। সেই দেখে বাঘ হি-হি করে হাসতে শুরু করল। এভাবে আরও আধঘণ্টা শ্যাম্পু দিয়ে সাবান মেখে স্নান করার পর বাঘের গা থেকে সে কী খোশবই ছড়াতে শুরু করল। মুর্জা একটা হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে বাঘের লোম শুকোতে শুরু করল। বাঘ আরামে গলা দিয়ে গ-র-র-র গ-র-র-র আওয়াজ শুরু করল।
হঠাৎ তার দরজায় এসে টোকা দিল হারুণ আল রশিদ। তারা এবার নিচে খেতে যাবে। হোটেলের নিচের তলাতেই আছে বড় রেস্তোরাঁ। বাঘ মুর্জার কাছে গা-টা শুকিয়ে আবার গিয়ে চড়ল লিফটে। গল্পের ঠিক এই জায়গায় এসে বাঘ আর হারুণ আল রশিদের সঙ্গে আমার পরিচয় হল। আমি ছিলাম সেই হোটেলের দশতলায়। আমিও যাচ্ছিলাম রেস্তোরাঁয়। তাদের লিফটে উঠতেই প্রথমে মনে হল খিদের চোটে ভুল দেখছি। কলকাতার এমন নামজাদা হোটেলের লিফটে কি আর সত্যিই বাঘ চড়ে? কিন্তু ভুল ভাঙল রেস্তোরাঁয় ঢুকে। নাহ! সত্যিই বাঘ। তোমরা তো জানোই আমি কী ভীষণ রকম বাঘ ভালোবাসি। তাই নিজে থেকেই গিয়ে আলাপ করলাম, "আমার নাম রোহণ কুদ্দুস।" বাঘ একগাল হেসে বলল, "আমি বাঘ।" হারুণ আল রশিদও তার নাম বলল।
আমি এর আগে কোনোদিন বাঘের সঙ্গে বসে খাইনি। আমি নিশ্চিত তোমরাও কেউ খাওনি। তাই সেই সুযোগ ছাড়তে চাইলাম না। একটা ভালো টেবল দেখে আমি বাঘ আর হারুণ আল রশিদের সঙ্গে গিয়ে বসলাম। ওয়েটার এগিয়ে এল সঙ্গে সঙ্গে মেনু কার্ড নিয়ে। কিন্তু বাঘকে দেখেই মাথা নাড়ল— "স্যর, এখানে তো বাঘেদের বসে খাওয়ার নিয়ম নেই।" বাঘ চাপা গলায় বলল, "গ্র-র-র-র!" ওয়েটার সঙ্গে সঙ্গে কাঠ-কাঠ হেসে বলল, "অবশ্য বাঘ যদি গ্র-র-র-র বলে তাহলে কেউ আপত্তি করবে না।"
আমি মেনু কার্ড দেখতে দেখতে বললাম, "আমি খাব পাস্তা। তুমি কী খাবে?" পাস্তা কাকে বলে বাঘ জানে না। তাই জিজ্ঞাসা করল, "হরিণ পাওয়া যাবে? আমি একটা বড় ঠ্যাঙ খাব।" আমি ঘাড় নাড়লাম।
"তাহলে খরগোশ?"
আমি আবারও ঘাড় নাড়লাম।
"তাহলে কী পাওয়া যাবে?"
আমি একটু ভেবে বললাম, "তুমি বরং একটা মাটন বিরিয়ানি নাও।"
"সঙ্গে দাদির তৈরি লেবুর আচার পাওয়া যাবে?"
ততক্ষণে ওয়েটার আবার এসে হাজির হয়েছে অর্ডার নিতে। সে দাদির আচারের কথা শুনে ঘাড় নাড়ল— "এখানে আচার পাওয়া যাবে না।"
বাঘ আবার চাপা গলায় বলল, "গ্র-র-র-র!"
ওয়েটার সঙ্গে সঙ্গে সুর বদলাল, "আমি খোঁজ নিচ্ছি আচারের জারটা কোথায় রাখা আছে।"
একটু পরেই আমাদের টেবিলে এসে হাজির হল আমার পাস্তা, হারুণ আল রশিদের অর্ডার দেওয়া সাদা ভাত আর লাল-লাল মুরগির ঝোল। আর সবার শেষ এল বাঘের জন্যে মাটন বিরিয়ানি। সঙ্গে একটা ছোট বাটিতে লেবুর আচার। সেটা অবশ্য দাদির বানানো আচারের মতো অত ভালো নয়। কিন্তু কলকাতা শহরের অত বড় হোটেলে ওর থেকে বেশি কিছু আশা করাও উচিত নয়। বাঘ তাই বেজার মুখে একবার বিরিয়ানি আর একবার আচার খেতে শুরু করল।
এর মধ্যে হয়েছে কী, বাঘ মাটনের হাড় চিবোতে গিয়ে সেটা তার হাত আর দাঁত ফসকে গিয়ে পড়েছে আমাদের পরের টেবলের একটা ছোকরার গায়ে। সেও তেরিয়ে হয়ে 'তবে রে!' বলে তার হাতের গলদা চিংড়ি ছুঁড়ে মারল। চিংড়ির দাঁড়া গিয়ে আটকাল হারুণ আল রশিদের দাড়িতে। সেও তার হাতের কাছে রাখা মাংসের ঝোল ছুঁড়ে মারল। সেটা পাশের টেবলের ছোকরার গায়ে না লেগে গিয়ে পড়ল অন্য আর একটা টেবলে একটা মোটাসোটা লোকের মাথায়।
সেই লোকটা তার স্যালাডের বাটি উপুড় করে দিল পাশের এক মহিলার ওপর। এইভাবে মুহূর্তের মধ্যে সারা রেস্তোরাঁর মধ্যে কুরুক্ষেত্র বেধে গেল। এ ওকে মাছ ছুঁড়ে মারে, তো সে তাকে মুরগির ঠ্যাং দিয়ে পেটায়। আর একজন তার ডালের বাটি ধাঁ করে মিশাইলের মতো ছুঁড়ছে তো অন্যদিক থেকে দই আর আইসক্রিম বোমার মতো এসে পড়ছে।
এমন খাদ্যযুদ্ধ থেকে প্রাণ হাতে নিয়ে আমরা তিনজন দৌড়ে বেরিয়ে এলাম রেস্তোরাঁ থেকে। টুপি থেকে তরকারির টুকরো ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে হারুণ আল রশিদ বাঘকে বলল, "চলো, তোমার জন্যে সুট বানানোর অর্ডার দিয়ে আসি। কাল লাগবে।"
- [গল্পটি Shel Silverstein-এর Lafcadio, the Lion Who Shot Back থেকে অনুপ্রাণিত]
- (বাকি অংশ আগামী সংখ্যায়)