গল্প: অচেনা আবেগ
যে কেউ হলে ওই মুহূর্তে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যেত। কিন্তু রেহনুমা কিভাবে যেন আতঙ্কে অস্থির হয়ে যেতে যেতে তার সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অসাড় হয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে ডুবন্ত মানুষের খড় কুটো আঁকড়ে ধরার মতো প্রাণ শক্তিতে ভর করে জেগে উঠে। এক ধাক্কায় লোকটাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে ছুটে যায় বাড়ির মূল দরজার দিকে। করিডোর ধরে ছুটে যেতে যেতে এতো দীর্ঘ মনে হয় পথ! যেন আর ফুরোবেই না। তারপর হঠাৎই নাগাল পায় সিঁড়িটার। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে প্রায় গড়িয়ে পড়তে পড়তে টাল সামলায় কোনো রকমে। সিঁড়িটা যেন স্কেলেটর সিঁড়ির মতো চলছে। ক্রমাগত ওপরের দিকে উঠে আসছে সিঁড়ির ধাপগুলো। রেহনুমার গন্তব্য নিচে সে উল্টো স্রোতে দাঁড় বইবার মতো নিচে নামছে। যত দ্রুত সম্ভব হয়। কিন্তু এভাবে কি নামা যায়! পাশের হাতল আঁকড়ে ধরতে যায় কিন্তু হাতলটা যেন ক্রমাগত দূরে সরে যেতে থাকে। সে কিছুতেই তার নাগাল পায় না। তারপরও থেমে থাকে না সে, হোচট খেয়ে, গড়িয়ে মড়িয়ে কোনোক্রমে নিচে নামার চেষ্টা করে। সিঁড়ির ল্যান্ডিংএ পৌঁছতে না পৌঁছতে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা অর্ধনগ্ন জলপরীর মুর্তিটা ওর ওপর আছড়ে পড়ে। রেহনুমা তাকে দুহাতে ঠেলে সরিয়ে দেয়। কী অসম্ভব ভারী মনে হয় তখন মূর্তিটাকে! যেন গায়ে পড়ে তার সাথে লড়তে আসছে এভাবে সেটা আরো একবার তার ওপরে গড়িয়ে পড়ে। রেহনুমা পাশ কাটিয়ে ছুটে যেতে চেষ্টা করে। এমন সময় ড্রইংরুমে গ্রানাইটের সাইড টেবিলের ওপরে উড়ার চেষ্টায়রত পেতলের বিশাল বাঁজ পাখিটা উড়ে এসে তার নখ দিয়ে তাকে ক্ষত বিক্ষত করতে থাকে। রেহনুমা দু'হাত দিয়ে ওর ওই ধারাল নখের আঁচড় থেকে নিজেকে রক্ষা করতে করতে ছোটে। এবং এক সময়ে বাড়ির মূল দরজাটা তার নাগালের মধ্যে এসে পড়ে। কিন্তু ওটার ছিটকিনিটা এতো উঁচুতে যে সে কিছুতেই ছুতে পারে না। সে লাফিয়ে লাফিয়ে ছিটকিনি ছোবার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। সে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ে। সে চিৎকার করতে চায় কিন্তু ততক্ষণে পেছন থেকে কেউ এসে তার মুখ চেপে ধরে। সে ফাঁদে পড়া পশুর মতো ছটফট করে। এক সময় তার সব প্রাণ শক্তি ফুরিয়ে আসে; সে ঢলে পড়ে।
২
সকালবেলা শাশুড়ি মা এসে হাজির হন। এসেই প্রশ্নবাণ, কি বৌমা, তুমি নাকি কাল রাত্রেও..! তারপর পরামর্শের ভঙ্গিতে বলেন, শোন মা, এইটা নিয়া চিন্তা করার কিছু নাই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এইটা জ্বীন-ভুতের কাজ। তুমি হয়ত জানো না, এই বাড়িতে ভুত আছে। এইটা একেবারে পরীক্ষিত সত্য। জানো, আমরা যখন এই বাড়িতে থাকি না তখন অনেকেই ছাদে তাদের হাঁটাহাটি করতে দেখছে। এমন কি দারোয়ান আর তার বৌ প্রায়ই শোনে, আটকা ঘরে জিকির করে। কেউ কেউ আবার নাচ-গানও শুনছে।
রেহনুমার ধীরে ধীরে মুখ শুকিয়ে যেতে থাকে।
সেদিকে তাকিয়ে শাশুড়ি আবার বললেন, আরে তুমি কি আমার কথা শুনে ভয় পাইতেছ নাকি? ভয়ের কিছু নাই। যখন মানুষ থাকে তখন কিন্তু এরা কিছু করে না। আচ্ছা মা শোনো তো তুমি কি কিছু দেখছো নাকি?
কি, কি দেখব?
না, মানে রাত্রি হইলে তোমার হয় কি বলত? আমার খুব জানার ইচ্ছা। জানো, সেই কবে থেকে শুধু শুনেই আসতেছি এখানে ভুত আছে, জ্বিন আছে, কিন্তু দেখা পাইলাম না। অথচ দেখ তুমি নতুন বৌ, তোমারে কি না ধইরা বসল। নাও এখন এইটা রাখ।
কি এটা?
তাবিজ। আর এই বোতলে পানি পড়া।
রেহনুমা এই ব্যপারে কোনো কৌতুহল দেখায় না। সে তাবিজটা নিয়ে খাটের সাইড টেবিলের ড্রয়ারে রাখতে যায়।
এমন সময় হা-হা করে ওঠেন শাশুড়ি। আরে কী করো, কি করো! তুমি ওটা ওইখানে রাখতেছ কেন? যাও এক্ষুনি গিয়া গোসল কইরা আসো, তারপর পানি পড়াটা খাইয়া তাবিজটা ডান হাতের বাজুতে বাঁধতে হবে।
হাতে কেন মা, কোমরে বাঁধলে হবে না? অসহায় ভঙ্গিতে বলে সে।
না, হুজুর বার বার বলে দিয়েছেন, তাবিজ যেন বাজুতে বাঁধা হয়। মেয়ে মানুষের কোমরে তাবিজ কোনো কাজে দেয় না। কেন দেয় না জানো?
রেহনুমা জানে না। তবে সে আন্দাজ করতে পারে। এই ভদ্রমহিলা এখন একটা অশ্লীল ইঙ্গিত করতে যাচ্ছেন। তাই সে তাড়াতাড়ি বলল, হ্যাঁ, বুঝতে পারছি।
কিন্তু বললেই কি আর ছাড় আছে, মহিলা গলা নিচু করে বলে যেতে থাকেন, শোনো হায়েজ-নেফাজ হলো নাপাক জিনিস, তারপর ধরো স্বামী-স্ত্রী সহবাসের সময়। ওই সময়ে কোমরে তাবিজ থাকা মানে তাবিজও নাপাক হইয়া যাওয়া। কি বুঝ নাই? তারপর ওই তাবিজ আর কাজ করে না।
রেহনুমা মনে মনে প্রমাদ গোনে। এর হাত থেকে নিস্তার নেই। এখন এই ভদ্রমহিলা তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক নিয়েও একগাদা প্রশ্ন করবেন। অশ্লীল ধরণের সব প্রশ্ন। শুনে রেহনুমার গা গুলোতে থাকবে। সে এই ঘর থেকে বের হয়ে যেতে চাইবে কিন্তু এই অতি উৎসাহী শাশুড়ির হাত থেকে তার নিস্তার নেই। সে পিছু পিছু হাঁটবে আর জিজ্ঞেস করতেই থাকবে। বল মা, সব কিছু খুইলা বল। হুজুরকে সব কিছু খুলে বলতে হবে তো!
রেহনুমা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, এসব কথা আপনি বলবেন তাকে?
তাতে কি হইছে? হুজুরকে পুরুষ ভাববার কোনো কারণ নাই। উনি হইল ডাক্তারের মতো ওনাকে সবই বলা যায়। তা একটু খুইলা বলতে হয় এই আর কি। ডাক্তারের মতো ওরা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ বোঝে না আর কি। বোঝো তো ওনাদের কাজ কারবার একটু আধ্যাত্মিক লেভেলে।
রেহনুমা তার শাশুড়ি আর তার ছেলের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য খুঁজে পায় না। আড়তদারির ব্যবসা করে এদের শুধু টাকা আর টাকাই হয়েছে। রাজ্যের খাদ্য খাবার ইমপোর্ট করে করে গুদাম ভর্তি করেছে। মাঝে মাঝে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। টাকার ওপর ভাসছে এরা। পুঁথিগত শিক্ষাও আছে কিন্তু সেখানে রুচি আর আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। বিয়ের পর থেকে তার স্বামী রানাও তার সাথে এমন অদ্ভুত সব আচরণ করে যাচ্ছে।
প্রথম রাত পার হতেই সে ল্যাপটপে একটা সিডি চালিয়ে দিয়ে বলল, চলো একটা ছবি দেখি। তুমি তো দেখি কিছুই জানো না। দেখো, এইটা দেখলে কাজে দিবে।
রেহনুমা প্রথমে বুঝতে পারে না, সে কি জানে না, যা ফিল্ম দেখে শিখতে হবে! আর এরাই বা ফিল্ম দেখে কি শিখেছে। কিন্তু ফিল্ম যত সামনে এগোতে থাকে রেহনুমার হাত-পা ক্রমাগত শক্ত হয়ে যেকে থাকে। সে তেতো স্বরে বলে, এসব কি!
পর্ণগ্রাফি। না, ধরে নাও কামসূত্র, আর এই সূত্র ধরেই এগোতে হবে। দেখো এর মধ্যে কোনো অশ্লীলতা নাই। তবে এরে অশ্লীলও করে তোলা যায়। কিছু কিছু ফিল্মে দেখো নাই সামান্য জিনিসকে কিভাবে প্রেজেন্ট করে!
রেহনুমার কানে এখন আর কোনো কথা যায় না। ধীরে ধীরে তার দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ওপরে শুরু হয় ছেড়া খোঁড়ার কাজ। আল্টিমেট প্লেজারের নামে যে পৈশাচিকতা চলে তা সহ্য করা কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব না! আর সেই সময়ে সে এই গোর খোদককে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে ছুটে পালাতে চেষ্টা করে।
ধীরে ধীরে তার এই ব্যাপারটা প্রায় অসুখে দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু তার শাশুড়ি তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে নারাজ। এই বিষয়ে তার স্বামীও মায়ের ওপরে কথা না বলার ভান দেখায়। হুজুরের দাওয়াইয়ের ডোজ আরো বাড়িয়ে দেয়া হয়। বিচিত্র সব চিকিৎসা পদ্ধতি রেহনুমার ওপরে প্রয়োগ হতে থাকে। প্রায় ভোর রাতে উঠে গোসল করো। তারপর এক কাপড়ে দাঁড়িয়ে থাকো সূর্যের দিকে মুখ করে। তার ওপরে বিশাল এক তেজপাতার ডাল এনে ঝাড় পোছের নামে চলে পিটুনি। প্রায় দিনভর তাকে না-না গাছের ক্বাথ খাওয়ার নাম করে প্রায় না খাইয়ে রাখা হয়। তার জন্য বাইরে কোথাও বের হওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে। এর পরও রেহনুমার রোগ সারার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। সে দিন দিন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেতে লাগল। গলার স্বরও অস্পষ্ট। কথা বলার সময় চি-চি শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। অবশেষে অবস্থা বেগতিক দেখে তার বাবা-মাকে খবর দেয়া হয়।
মেয়ের এই অবস্থা দেখে রেহনুমার বাবা প্রায় কেঁদে ফেলেন। তিনি তখনই মেয়েকে নিয়ে যেতে চান।
রেহনুমার শশুর বাড়ির লোকজনের আচরণ একেবারেই স্বাভাবিক। যেন কিছুই হয় নাই এমন ভঙ্গিতে তার শাশুড়ি পান চাবাতে চাবাতে টিভিতে হিন্দি সিরিয়াল দেখছেন। রেহনুমার বাবাকে দেখে গালের কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানের রস আঁচলে মুছে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেন, বেয়াই সাহেব খাওয়া দাওয়া করেছেন? তা মেয়েকে কি করবেন ভাবছেন? তাকে বরং নিয়ে যান। ওকে দেখলে আমার ছেলেই এখন ভয় পায়। একটা পাগল মেয়ে গছিয়ে দিয়েছেন আমার ছেলের ঘাড়ে। এখন গিয়ে পাগলের ডাক্তার টাক্তার দেখিয়ে বেড়ান। আইন আদালত করে তো কোনো লাভ হবে না, মেয়ে তো পাগল।
রেহনুমার বাবা কতগুলো কড়া কথা বলতে গিয়েও বললেন না। কারণ তার মেয়ে এখনো এদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের কথা বলে নাই। এই না বলার ভেতরে কতটা অভিমান কতটা অনুযোগ রয়েছে এটা তিনি জানেন। তাই মেয়েকে নিয়ে তিনি নিঃশব্দে বেরিয়ে এলেন।
৩
বাবার বাড়িতে ফিরে নিজেদের ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় বেল টিপতেই রেহনুমার সারা শরীরে এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল। পাশের ফ্ল্যাটে ওরা কি আছে? ওদের জন্যই আজ তার এই অবস্থা। ওরা যত নষ্টের গোড়া। ওরা তার চিন্তার গতি ও রুচিবোধটাকে আমূল বদলে দিয়েছে। তাই কি সে আর খাপ খাওয়াতে পারেনি সাধারণ চিন্তাধারার অতি সাধারণ মানুষদের সাথে! রেহনুমা এখনো সে দিনটার কথা ভুলতে পারে না।
একদিন ডোর বেল শুনে দরজা খুলতেই দেখল দুজন অচেনা তরুণ দাঁড়িয়ে আছে। একজন লম্বা, একজন ফর্সা। তাদের বেশভূষা একটু আলাদা ধরণের। হলিউডের ওয়েস্টার্ন ছবির হিরোদের মতো। লম্বা ছেলেটার লম্বা চুল ঝুটি বাঁধা। ফর্সা ছেলেটার চুলও ঝুটি বাঁধা মুখে ফ্রেঞ্জকাট দাড়ি। দুজনেই ছেড়া জিন্স, টি শার্ট আর পায়ে স্নিকার পরা। রাত তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা। এতো রাতে এই অচেনা ছেলেগুলো তাদের বাড়িতে এসেছে! না, হতেই পারে না। তাই রেহনুমা বলল, আপনারা কি এই ফ্ল্যাটে এসেছেন?
ফর্সা ছেলেটা তৎক্ষণাৎ বলল, আমরা মদ খেয়ে এসেছি।
মানে!
লম্বা ছেলেটা তখন ফর্সা ছেলেটার কাঁধে আলতো করে হাত রাখল। ফর্সা ছেলেটা তাতে চুপ করে গেল। তারপর লম্বা ছেলেটা বিনীত ভঙ্গিতে বলল, সরি, আপনি কিছু মনে করবেন না। আমরা পাশের ফ্ল্যাটে থাকি, ভুল করে এখানে নক করে ফেলেছি।
চলে যেতে যেত ফর্সা ছেলেটা লম্বা ছেলেটাকে বলল, কিন্তু আমাদের দরজা খুলবে কে? আমাদের ঘরে তো আর কেউ নেই। হা-হা-হা। নিজের কথায় নিজেই হাসছে সে।
লম্বা ছেলেটা সান্তনার স্বরে বলল, আমি খুলব, আমার পকেটে চাবি আছে। লম্বা ছেলেটা তখন পকেট হাতড়াচ্ছে।
রেহনুমা তাদের দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের ঘরে ঢুকে যাওয়া দেখল। পুরো ব্যাপারটাই ওর কাছে কেমন স্বপ্নের মতো মনে হলো। এক অদ্ভুত ভালো লাগা আচ্ছন্ন করে ফেলল তাকে। ভীষণ কৌতুহলি হয়ে উঠল সে ছেলে দুটোর প্রতি।
সেদিন থেকে রেহনুমা প্রতিবার ঘর থেকে বের হওয়ার সময় ওদের ফ্ল্যাটের দিকে উকি দেয়। কিন্তু ওদের কাউকে আর দেখতে পায় না। একই এ্যাপার্টমেন্টে পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকে তারা অথচ লিফটে বা প্যাসেজে কোথাও তাদের সাথে একবারও দেখা হয় না! অদ্ভুত তো! তাহলে কি রেহনুমা সেদিন ভুল দেখেছে? পুরো ব্যপারটাই তার কল্পনা ছিল! না, তা হতে পারে না, কল্পনা এতো স্পষ্ট হয় না। তাছাড়া মা তো অনেক বকাবকিও করেছে তাকে সেদিন। 'কারা এসেছিল? এতো রাতে অচেনা মানুষকে দরজা খুললি কেন তুই? তোর আর বুদ্ধি সুদ্ধি কবে হবে?' ইত্যাদি ইত্যাদি। তার মানে কোনো হেলুসিনেশান না। সত্যি, পুরো ব্যাপারটাই সত্যি ছিল।
এবং রেহনুমার বিশ্বাসকে সত্যি করে দিয়ে বেশ কিছুদিন পর একদিন লিফটে দেখা হয়ে গেল ওদের সাথে।
লম্বা ছেলেটা তাকে দেখে হাসল। ফর্সা ছেলেটা বলল, কেমন আছেন?
রেহনুমা বলল, ভালো। আচ্ছা আপনারা কি এখানে থাকেন না?
হ্যাঁ থাকি তো। বলল ফর্সা ছেলেটা।
তবে কিছুদিন ছিলাম না। আমরা আমাদের কাজে ঘর ছেড়েছিলাম। বলল, লম্বা ছেলেটা।
আপনাদের কাজে! আপনারা কি কাজ করেন?
এ কথার জবাবে হাসল দুজনে। হা-হা-হা। লিফট কাঁপিয়ে হাসি। সেই হাসি থামার আগেই লিফটটা এসে থামল তার গন্তব্যে। ওরা সবাই নেমে পড়ল।
এর পর থেকে ওদের সাথে প্রায়ই দেখা হয় রেহনুমার। এই দেখা হতে হতেই ওদের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে যায় তার। ওরা দুজন বন্ধু। একজন আর্টিস্ট অন্যজন কবি। ওরা দুজনেই আবার প্রবন্ধ লেখে। কবি আর্ট ক্রিটিক করে আর শিল্পী আবার সাহিত্যের সমালোচনা করে। দুজনেই আবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যে যার বিষয়েরও সমালোচক। ওরা ওদের সমালোচনার মারপ্যাচে বড় বড় শিল্পী সাহিত্যিককে ধরাসায়ী করতে ওস্তাদ। রেহনুমা এই ঘরানার মানুষ না হলেও ওদের সাথে তার বন্ধুত্বটা খুব জমে যায়। কারণ ওরা দুজনেই খুব ইন্টারেস্টিং মানুষ। সে ওদের সাথে সবখানে ঘুরে বেড়ায়। সেমিনারে যায়, আর্ট এক্সিবিশনে যায়, মঞ্চ নাটক দেখতে যায়, ফিল্ম সোসাইটির ওয়ার্কশপে যায়। আইজেনস্টাইন, তারকোভস্কির ফিল্ম দেখে। জাক দেরিদা আর মিশেল ফুকোকে নিয়ে তুমুল তর্কের মাঝে সেও এখন দু একটা মন্তব্য ছুড়ে দিতে পারে। ইউটিউবে স্লাভোই জিজেকের বক্তৃতা শোনে। বাদিয়্যুর বই পড়ে। পিকাসো আর কিবরিয়ার ছবির কিউবিজমের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে বের করতে পারে। মিশেল বাসকিয়ার ছবিকে আর হিজিবিজি মনে হয় না। এই দুই তরুণের সংস্পর্শে এসে ওর চেনা জগৎটা কেমন বদলে যেতে থাকে। পৃথিবীটা কণে দেখা আলোর মতো মায়াময় আর আকর্ষনীয় হয়ে ওঠে। সব কিছু কেমন অর্থপূর্ণ মনে হয়। কোনো কোনো দিন দুপুর বেলায় সে ওদের সাথে খিচুড়ি রান্নায় যোগ দেয়। ওদের আরো অনেক বন্ধু আছে, ছেলে এবং মেয়ে। তারাও আসে যখন তখন।
রেহনুমা ওদের দুজনের প্রেমে পড়ে যায়। তবে নির্দিষ্ট করে কাকে ভালোবাসে বুঝতে পারে না। ওরাও তাকে ঠিক প্রেমিকা ভাবে কি-না রেহনুমা জানে না। তবে সে ওদের ভালোবাসে। ওদের সবকিছু সে ভালোবাসে। ওরা তাকে নিয়ে কবিতা লেখে, ছবি আঁকে। কিন্তু ওরা কি তাকে ভালোবাসে? রেহনুমা জানে না।
এই বোঝা না বোঝার মাঝেই একদিন হুট করে রেহনুমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। ছেলের বাবা বিশাল বড়লোক, কোটিকোটিপতি। এই বিয়ে ঠিক হওয়াটা যেন অনিবার্য হয়ে পড়েছিল তার মায়ের জন্য। মা ওদের সাথে মেয়ের মেলামেশা একদম সহ্য করতে পারতেন না। মা-ই চাপ দিয়ে বাবাকে দিয়ে এই কাজটা করিয়েছে রেহনুমা বুঝতে পারে। বাবা শুরুতে মায়ের কথা মানতে চাননি। তিনি বলতেন, ছেলেগুলোর বেশভূষা একটু অদ্ভুত ঠিকই কিন্তু ওরা খুব ভালো। অনেক জ্ঞানী, আমি কথা বলে দেখেছি।
মা খিচিয়ে ওঠেন, রাখো তোমার জ্ঞানী! এদের নিয়ে ভবিষ্যৎ ভাবা যায় না।
ভবিষ্যৎ ভাবার দরকার কি? সব সম্পর্কের মধ্যে পরিণতি খোঁজো কেন?
বলে কি লোকটা, পাগল হয়ে গেল নাকি? মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে না? সারাদিন দুটো অর্ধ উন্মাদ ছেলের সাথে ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়ানো মেয়েকে কেউ বিয়ে করবে? তোমার ওসব তত্বকথা তখন কেউ শুনবে? আর ও দুজনেরও তো কোনো মাথামুণ্ডু ঠিক নেই। চাল নেই চুলো নেই। শিল্প করতে নেমেছে! ওদের কাছে প্রেম ভালোবাসা নিত্য দিনের খাদ্য-পানীয়-ধুমপানের মতো একটা বস্তু। ওদের কাছে এর কোনো বিশেষত্ব আছে নাকি? ওরা সব কিছুতে বৈচিত্র খোঁজে। তুমি আজই মেয়ের বিয়ে ঠিক করবা, আজই।
মায়ের কথার ওপরে বাবা সেদিন কোনো কথা বলতে পারেনি। রেহনুমার তাই মায়ের ওপর ভীষণ অভিমান হলো। একই সাথে অভিমান হলো ওদের ওপরেও। সত্যিই তো ওরাতো কেউ তাকে কিছু বলেনি কখনো। সে এতো সুন্দর একটা মেয়ে, একবার দেখলে লোক ওর দিকে দ্বিতীয়বার ফিরে তাকায়। ওদের ক্লাসে গ্রাম থেকে একটা মেয়ে পড়তে এসেছে; গ্রাম থেকে অনেকেই এসেছে তবে সেই মেয়েটা ওর দিকে সব সময় তাকিয়ে থাকত। একদিন ওকে তাকিয়ে থাকার কারণ জানতে চাইলে বলল,'তুমিতো অনেক সুন্দর একই সাথে স্মার্ট বুদ্ধিমতি, তাই দেখি, গ্রামে তো এতো সুন্দর কাউকে দেখিনি কখনো।' অথচ ওরা দুজন পুরুষ তার ওপরে শিল্পী, ওদের কি কখনো তার প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করেনি? না কি ওরা পড়েছে রেহনুমা বুঝতে পারেনি। এমন একটা দ্বিধা দ্বন্দের মধ্যে একদিন রেহনুমা ওদেরকে তার বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার কথা জানালো।
খবরটা শুনে ওদের মধ্যে খুব একটা ভাবান্তর দেখা গেল না। ফর্সা ছেলেটা শুধু বলল, আহা রেহনুমা, তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল! লম্বা ছেলেটা বলল, কংগ্রাচুলেশনস।
রাগে রেহনুমার তখন গা জ্বলে যাচ্ছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল ডেট-ফেটের তোয়াক্কা না করে তখনই ওই বড়লোকের ছেলেটাকে বিয়ে করে ফেলে। তার ব্যাপারে এতোটা উদাসীন কি করে হতে পারে ছেলে দুটো! হতে পারে ওদের অনেক রকম বন্ধু আছে, জগৎ আছে, আড্ডা আছে, তাই বলে কি ওদের মন নেই! ওরা কি তাকে বুঝতে পারে না একটুও? এ কেমন কবি, এ কেমন শিল্পী?
আজ এই বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সেদিনের সেই অভিমান আবারো ডেলা পাকিয়ে ওঠে রেহনুমার গলার কাছে। সে মুখ ফিরিয়ে নিতে চায় ওই বন্ধ দরজার ওপর থেকে। কিন্তু পারে না। সে ভাবে এই বুঝি ওরা কেউ দরজা খুলে বের হয়ে আসবে। বা এমন যদি হতো, ও যদি ভুল করে নক করতে পারত ওই দরজায়!
রেহনুমাকে ওভাবে ওদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বাবা বললেন, ওরাতো ওখান থেকে চলে গেছে মা।
নিমেষে যেন রেহনুমার পৃথিবীটা টলে উঠল। সে বলল, কোথায়? কবে বাবা?
জানি না মা, তোর বিয়ের পর পরই তো চলে গেল। তোর মা হয়ত জানতে পারে, তুই চলে যাওয়ার পর, সে তো ওদের সাথে মাঝে মাঝেই কথা বলত!