ঢাকা ’৭১: রক্তাক্ত স্মৃতিকথা
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টি পাকিস্তানের ইতিহাসের অন্যতম স্পর্শকাতর এবং করুণ অধ্যায়। বিভক্তির যন্ত্রণা এখন অতীত হয়ে গেলেও ১৯৭১ সালের বিভিন্ন ঘটনার স্মৃতি আজও সেই সময় পেছনে ফেলে আসা মানুষকে কষ্ট দেয়।
ঘটনার দুটো অত্যন্ত জোরালো ভাষ্য আছে, কিন্তু ইতিহাস দ্ব্যর্থহীন। হয়তো সে-কারণেই পাকিস্তানের ভাঙনের সময়ের সাংবাদিকরাই সেই ভয়ানক বছরের ভুলভ্রান্তির স্মৃতিচারণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি জুৎসই অবস্থানে ছিলেন।
২৩ শে মার্চ ১৯৭১ পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়। আলি আহমেদ তখন ঢাকার একজন সাংবাদিক ছিলেন।
'আমি জারিদা নামে একটি উর্দুভাষী প্রগতিশীল পত্রিকায় কাজ করতাম। পত্রিকাটি লাগাতার পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার এবং সামরিক শাসনের বদলে গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের পক্ষে কথা বলত,' এক ধরনের আন্তরিকতার সুরে বলেছেন তিনি।
তবে স্মৃতিচারণ বিষণ্ণতার দিকে বাঁক নিতেই দু চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে তার।
'সেটা ছিল ২৫ শে মার্চের রাত। ঢাকায় উর্দুভাষী এলাকায় আমাদের বাড়ি থেকে গুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম আমরা,' বললেন তিনি। শ্রমিক শ্রেণীর বাঙালীদের বস্তি এলাকার দিকে আগুনের দাউদাউ শিখা জ্বলতে দেখেন তিনি।
'ধোঁয়ায় চারপাশ ভরে গেছে। আকাশটা পুরো লাল হয়ে উঠেছিল। অপারেশন সার্চলাইট সম্পর্কে এটাই মনে আছে আমার,' স্মৃতিচারণ করলেন তিনি।
'আমাদের পরিবারটি ছিল দুভাগের, কেউ থাকতো পূর্ব পকিস্তানে, আবার কেউ পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের পারিবারিক বাসস্থান ছিল দিনাজপুর শহরে। অপারেশনের পরে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়ে যাওয়ায় গোটা দেশ যেন সহিংসা প্রতিক্রিয়ায় বিস্ফোরিত হলো। বহু উর্দুভাষী পরিবার আক্রান্ত হয়েছে তখন। ঢাকায় হাজির হওয়া লোকমুখে ওখানকার ভয়ানক সহিংসতার ঘটনার কথা জানতে পারি।'
'একটি ট্রেনে চড়ে দ্রুত পরিবারের কাছে ছুটে যাই আমি। মনে আছে, বাগানের ভেতর দিয়ে এগোনোর সময় বাবা-মায়ের অতিযত্নে লাগানো আনারসের গন্ধ নাকে আসছিল। পুরো বাড়িটাই ভূমিসাৎ হয়ে গেছে। আমাদের সমস্ত জিনিসপত্র সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছিল: বাবার বইপত্র, ভাইয়ের রেকর্ড আর অ্যালবাম....লুটতরাজ চালানো হয়েছে ওখানে,' দাঁতে দাঁত চেপে বললেন তিনি।
'পড়শীরা বলল আমার মা পার্বতীপুরে আমার বোনের কাছে গেছে। বাবা এবং ভাই নিখোঁজ। কিন্তু বিশদ কিছু বলতে পারল না কেউ। অবশ্য ওরা সবাই মারা গিয়েছিল।'
এখন, সেই রক্তাক্ত ঘটনার ৪৩ বছর পর অ্যাবোটাবাদে দৃষ্টিনন্দন বাড়িতে বসে আমাদের সাথে কথা বলার সময় মনে হল, জনাব খান যেন যন্ত্রণাময় সেই অতীতের সাথে রফা করেছেন। এমনকি 'ব্যাপারটা অনিবার্য ছিল,' বলে হাসলেনও তিনি।
'আওয়ামী লীগ ১৯৭০ এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় লাভ করার পর জাতীয় সংসদেও অধিবেশন আহ্বান না করায় এছাড়া আর কী ঘটতে পারতো,' বললেন তিনি।
নিজের বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তিনি পরিষ্কার। তার চোখে পশ্চিমের লোকজনের কর্মকাণ্ডের কারণেই রক্তাক্ত বিচ্ছেদ ঘটে।
"পূর্ব পাকিস্তানের শেষ গভর্নর অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ আহসান স্মৃতিচারণের সময় বলেছেন, ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনার জন্যে হাজির হওয়ার পর অ্যাডমিরালের কাছে জানতে চান, 'ছয়দফাগুলো কী'।"
অ্যাডমিরাল দলিলপত্র পাঠানোর কথা বললে ইয়াহিয়া প্রত্যখ্যান করে বলেন, 'না, না, ও আমি সামলে নেবো।' এখানেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সাথে আলোচনায় গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে অবহেলার ব্যাপারটা বোঝা যায়।'
তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং বাঙালীদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সমর্থন করায় পরিবারের কেউ কেউ তাকে ত্যাগ করেছিল।
'ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমার বেলায় যেটা ঘটেছে, সেটা কষ্টকর, কিন্তু কোনও শক্তি যখন একটি জাতির মৌলিক অধিকার অস্বীকার করে, তখন এই ধরনের প্রতিক্রিয়াই প্রত্যাশিত।'
ঢাকার পতনের দিন সিলোসিয়া জায়দীর বয়স ছিল মাত্র দশ বছর, কিন্তু, 'ছোটবেলায় আমরা যা দেখেছি, আমাদের মনের ভেতর সেটা অনারোগ্য ক্ষত রেখে গেছে। সেসব মনে করা ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক বলে আমরা কথা বলতে চাই না। কিন্তু চুপ থাকলে তো আর যা ঘটে গেছে তাকে পাল্টানো যাবে না,' বলেছেন তিনি।
এখন ইসলামাবাদ ভিত্তিক সাংবাদিক মিস জায়েদী ১৯৭১ সালের বেশ কিছু ভয়াবহ নৃসংশতা প্রত্যক্ষ করেছেন।
'মনে অছে আমাদের হিন্দু ধোপার অপূর্ব সুন্দরী একটা মেয়ে ছিল। একদিন দেখি আমাদের বাড়ির গেটের সামনে বসে অঝোরে কাঁদছে সে। গেটে পাহারায় থাকা সেনাবাহিনীর লোকজন ওকে ঢুকতে দিচ্ছিল না। মাকে যখন জিজ্ঞেস করলাম মেয়েটা কাঁদছে কেন, মা কিছুই বলেনি। আজ আমি জানি ও এবং ওর মতো আরও অগুনতি মেয়ের ভাগ্যে কি ঘটেছিল,' বলেন তিনি।
শেখ মুজিব যেদিন বাঙালীদের উদ্দেশ্যে চূড়ান্ত আহবান জানিয়ে স্বাধীনতার যুদ্ধে নামার আহবান জানান সেই দিনের কথা তার মনে আছে।
'আমার বাসার জানালা দিয়ে হাতে তৈরি অস্ত্রশস্ত্র হাতে চতুর্দিক থেকে লোকজনকে বেরিয়ে আসতে দেখি। আমাদের বয়স্ক দুধওয়ালাকেও বর্শা হাতে এগিয়ে যেতে দেখেছি। এরপর মহাশোরগোল বেঁধে গিয়েছিল,' বললেন তিনি।
'অসন্তোষ ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে, অবশ্যই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয়। হাজার হোক, বাংলাও পাকিস্তান ছিল। মুসলিম লীগের জন্মস্থানও ওটা।'
'বাঙালীরা গর্বিত জাতি, তারা তাদের সংস্কৃতি এবং ভাষা নিয়ে গর্ব করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিরা সবসময় বাঙালীদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে। তাদের প্রতি ভীষণ বৈরী ছিল ওরা। এটিই অসন্তোষের বীজ বপন করে।'
মিস জায়েদীর বাবা ক্যাপ্টেন আসগর হোসেন জায়েদী ছিলেন সংসদ সদস্য এবং আইয়ুব খানের মন্ত্রীসভার সদস্য। বাঙালী হলেও অখণ্ড পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন তাকে মুক্তিবাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে।
'ওদের (মুক্তিবাহিনী) আমরা ভাইয়া আর চাচা ডাকতাম। নানান রাজনৈতিক পক্ষপাত নিয়ে আমাদের একটি প্রাণবন্ত পরিবার ছিল। আমার দাদা-চাচারা আওয়ামী লীগ করতেন, স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন তারা।'
কিন্তু সমস্যা দেখা দেওয়ার পর দাদা গোটা পরিবারকে গ্রামে চলে যাওয়ার সুচিন্তিত পরামর্শ দেন।
'শহর থেকে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বিস্তৃত নদীর তীর আর হাজার হাজার সাধারণ গ্রাম চোখে পড়ার কথা মনে আছে। ঠিক ওই মুহূর্তে হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। সেনাবাহিনী আমাদের কেন গুলি করছে, মাকে সেকথা জিজ্ঞেস করার কথা মনে আছে। মা বলেছিলেন, ওদের অবস্থান থেকে কারা নির্দোষ বুঝতে পারছে না ওরা,' চোখজোড়া চকচক করে ওঠে তার, আবেগর ঝিলিক ফুটে ওঠে।
[১৬ই ডিসেম্বর, ২০১৪ তারিখের দৈনিক ডন-এ প্রকাশিত]
- রূপান্তর: শওকত হোসেন