১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা পরিচালনার জন্য পাকিস্তানের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনার জন্য পাকিস্তানের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সন্তানেরা।
বিশ্বখ্যাত কার্ডিওলজিস্ট শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. ফজলে রাব্বির কন্যা ড. নুসরাত রাব্বি বাসসকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বলেন, "১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনার জন্য পাকিস্তানকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।"
আজ ২৫ মার্চ। জাতীয় গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালি জাতির মুক্তির পথকে চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করে দিতে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশে 'অপারেশন সার্চলাইট' নামে সারাদেশে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়।
২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশে এই দিনটিকে 'জাতীয় গণহত্যা দিবস' হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
জাতীয় জেনোসাইড দিবসের প্রাক্কালে ড. নুসরাত বলেন, "বাংলাদেশে গণহত্যা চালানোর জন্য পাকিস্তান সরকারকে এর দায়ভার স্বীকার করে নিতে হবে। তাদের কৃতকর্মের জন্য বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।"
সম্প্রতি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মুখে 'বাংলাদেশের প্রশংসা'র কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, "আমরা প্রশংসা চাইনা। আমরা চাই স্বীকৃতি। আমরা চাই ক্ষতিপূরণ। পাকিস্তানের মাটিতে আমাদের শহীদদের স্মরণে স্ট্যাচু চাই। ওদের ইতিহাস বইতে 'বাংলাদেশ' নামে একটা চ্যাপ্টার চাই। যাতে ওদের দেশের জনগণ তথা নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসটা জানতে পারে।"
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্বাচনী অঙ্গীকারের মধ্যে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে ঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয়টি নিয়ে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেওয়ার কথা অন্তর্ভূক্ত করার আহ্বান জানান শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ছেলে আসিফ মুনির।
প্রজন্ম একাত্তরের সভাপতি আসিফ মুনির বলেন, "সবার আগে পাকিস্তানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। ২৫ মার্চ রাতের 'অপারেশন সার্চলাইট' থেকে শুরু করে ৯ মাসের 'সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয়' এবং ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।"
"তবে টাকার অঙ্কে এই ক্ষতিপূরণ হিসেব করা যাবে না। ভুক্তভোগী পরিবারের জন্য বাংলাদেশ সরকার এককালীন অনুদান চাইতে পারে, যা দুঃস্থ যুদ্ধাহত, শহীদ ও বীরাঙ্গনা পরিবারদের পুনর্বাসন ও কল্যাণে ব্যয় করা হবে," যোগ করেন তিনি।
এছাড়াও তিনি জাতীয় গণহত্যা দিবস সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির জন্য প্রতিবছর ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট শুরু হওয়ার মুহূর্তের স্মরণে ২-৩ মিনিটের জন্য সারাদেশে জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ বন্ধ রাখার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান।
শহীদ সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেনের ছেলে, গণহত্যা গবেষক তৌহিদ রেজানুর বাসসকে বলেন, "একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে পুরো একাত্তর জুড়ে পাকিস্তানী হানাদারবাহিনী ও তার দোসররা বাংলাদেশের ওপর যে জেনোসাইড পরিচালনা করেছিলো, সেজন্য পাকিস্তানের কাছে প্রথম দাবি হবে তারা যেন স্বীকার করে যে বাংলাদেশের ওপর তারা হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলো। এ কর্মকাণ্ডে জন্য পাকিস্তানকে দুঃখ প্রকাশ করতে হবে। এটি লোক দেখানো ভণিতা যেন না হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।"
একাত্তরের নয় মাসে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে বাংলাদেশের অপূরণীয় ক্ষতির ক্ষতিপূরণ দাবি করে তৌহিদ বলেন, "জীবনের বিনিময় তো কিছু দিয়ে হয়না, জীবন অমূল্য। কিন্তু পাকিস্তান যুদ্ধের নয় মাসে হত্যা-লুন্ঠনের পাশাপাশি বাংলাদেশের অবকাঠামোগত ক্ষতিও করেছে। ব্যাংক ডাকাতি করেছে। বাংলাদেশ সরকার সেসব একটা হিসেব করে বর্তমান সময়ের আর্থিক মূল্যের সাথে সঙ্গতি রেখে পাকিস্তানের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে।"
"আর পাকিস্তান যদি সেই ক্ষতিপূরণ দিতে প্রস্তত থাকে তাহলে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সেই ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়ে দুঃস্থ শহীদ পরিবারের সদস্য, বীরাঙ্গনা, যুদ্ধাহত ও দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে ব্যয় করতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন প্রকল্পের জন্যও ব্যয় করতে পারে।"
তিনি পাকিস্তানের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের বিষয় বিবেচনা করে বলেন, "প্রশ্ন উঠতেই পারে যে পাকিস্তান একটি দরিদ্র রাষ্ট্র। তারা এখন এই ক্ষতিপূরণ কিভাবে দেবে।"
তৌহিদ রেজানুর পাকিস্তানকে এই ক্ষতিপূরণের অর্থ যোগাতে তাদের মিত্র দেশগুলোর কাছে সাহায্য চাওয়ার পরামর্শ দেন।
তিনি বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যেকার কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে তাদের পূর্বসুরীদের অপরাধের দায়মুক্ত হতে পাকিস্তানের বর্তমান নেতত্বকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, "তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে এই অন্যায় স্বীকার করে নেবে এবং ক্ষমা চাইবে। এতে তাদের ইতিহাসের দায়মুক্তি ঘটবে। দুই রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কেরও কোন ক্ষতি হবে না।"
বাংলাদেশের গণহত্যা দিবসের প্রাক্কালে বাসসকে দেওয়া এক অনলাইন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, "বাংলাদেশে সংঘটিত ১৯৭১ সালের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয়ে, বিশেষ করে রাষ্ট্রের দিক থেকে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা অত্যন্ত জরুরি। শুধুমাত্র রাষ্ট্র নয়, বাংলাদেশ এবং দেশের বাইরে যারা আমাদের মিত্র আছে, ডায়াসপোরা সংগঠন আছে তাদের সাথে নিয়ে একটি সুপরিকল্পিত ও সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।"
তিনি বলেন, "সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন ছড়িয়ে আছে। তা সংরক্ষণ করার জন্য অতিসত্বর উদ্যোগ নেওয়া দরকার। মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সাথে তরুণদের যুক্ত করে দেয়া দরকার। টেস্টিমনি দরকার।"